নিজস্ব প্রতিবেদক : শৈত্যপ্রবাহ ও শীতের প্রকোপ উপেক্ষা করে মানুষের ঢল নেমেছে গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগপাড়ে। বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে মুসল্লিদের পদচারণে মুখর পুরো ইজতেমা ময়দান।
শুক্রবার সকালে ফজরের নামাজের পর পাকিস্তানের মাওলানা খোরশেদ আলমের আমবয়ানের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় এই পর্বের ইজতেমা। এ পর্বে ইজতেমায় অংশ নিয়েছেন মাওলানা সাদ কান্ধলভীর বিরোধী পক্ষ হিসেবে পরিচিত মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা।
প্রথম পর্বে ইজতেমা চলবে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত। আর দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে ১৭ জানুয়ারি। চলবে ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত। গত বছরের ২৮ অক্টোবর সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
মুসল্লিরা দূর-দূরান্ত থেকে আসতে শুরু করেছেন বুধবার থেকেই। এর মধ্যে আজ শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হয় মানুষের ঢল।
সকালে ইজতেমা ময়দান ঘুরে দেখা যায়, দলে দলে ইজতেমা মাঠে প্রবেশ করছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মুসল্লিরা। তাদের কারো মাথায়, কারো কাঁধে, আবার কারো হাতে একাধিক ব্যাগ। অনেকে এরই মধ্যে খিত্তায় থাকার জায়গা প্রস্তুত করে নিয়েছেন।
এছাড়া বৃষ্টি ও শীতের বিষয় মাথায় রেখে আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন অনেকে। অনেক মুসল্লির সাথে বৃষ্টি প্রতিরোধী পলিথিন দেখা গেছে। কেউ কেউ আবার শীতের একাধিক পোশাকও নিয়ে এসেছেন সঙ্গে করে।
দুপুরে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে একসঙ্গে লাখো মুসল্লি জুমার নামাজ আদায় করেছেন। দুপুর ১২টার দিকে মাঠ উপচে আশপাশের খোলা জায়গাসহ সব স্থান জনসমুদ্রে পরিণত হয়। মাঠে স্থান না পেয়ে অনেকে মহাসড়ক ও অলি-গলিসহ যে যেখানে পেরেছেন পাটি, চটের বস্তা, খবরের কাগজ বিছিয়ে জুমার নামাজে শরিক হয়েছেন। ফলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বেশ কিছুক্ষণের জন্য যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে শুরু হওয়া জুমার জামাতে ইমামতি করেন বাংলাদেশের তাবলীগ জামাতের সূরা সদস্য, শীর্ষ মুরুব্বি, কাকরাইল মসজিদের খতিব মাওলানা মোহাম্মদ যোবায়ের আহমদ। জুমা নামাজের পর বয়ান করবেন মাওলানা শেখ ইউনুস, বাদ আছর বয়ান করবেন পাকিস্তানের মাওলানা এহসান ও বাদ মাগরিব বয়ান করবেন ভারতের মাওলানা আহমদ লাট।
জুমা নামাজে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক এমপি, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ এমপি, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি অ্যাড., মো. আজমত উল্লা খান, সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম, ঢাকা রেঞ্জ ডি আই জি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, গাজীপুর মেট্রো পলিটন পুলিশ কমিশনার মো. আনোয়ার হোসেনসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অনেকেই অংশ নেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ব ইজতেমাকে ঘিরে হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং স্পিড বোটসহ তিন স্তরের বহুমাত্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এবারের ইজতেমাকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের নিরাপত্তার ঝুঁকি নেই। হেলিকপ্টার এবং ড্রোনের মাধ্যমে আকাশপথে সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে প্রশাসনের।
তাছাড়া আজ মুসল্লিদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। একই সঙ্গে বিশ্ব ইজতেমার আশপাশের সড়ক দিয়ে যাতায়াতের ক্ষেত্রে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ইজতেমা ময়দানের চারপাশে র্যাব ও পুলিশের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে কড়া নজরদারি চলছে। আগতদের দেহ তল্লাশি করে ময়দানে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে।
প্রথম পর্বের গণমাধ্যম বিষয়ক সমন্বয়কারী জহির ইবনে মুসলিম জানান, প্রায় দুই মাস ধরে প্রস্তুতির কাজ চলেছে। তুরাগ নদের দুই তীরেই আগত পুণ্যার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নদের পূর্ব ও পশ্চিম তীরের বিস্তৃত ভূমিতে চটের তৈরি বিশাল শামিয়ানা ৯১টি খিত্তায় বিভক্ত করে বিভিন্ন জেলার মুসলিমদের অবস্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। ময়দানের উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রায় ১০ হাজার বিদেশি মেহমানের থাকার ব্যবস্থা রেখে আন্তর্জাতিক নিবাস নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশ-বিদেশের প্রতিবন্ধী মুসলিমদের জন্য পৃথক নিবাস তৈরি করা হয়েছে।
আগত বিদেশি মেহমানদের সব ধরনের সেবাদানে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে জহির জানান, তাদের নিজ দেশীয় আবহাওয়া ও রুচির দিকে লক্ষ রেখে থাকার ব্যবস্থা ও শতাধিক আইটেমের খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তুরাগ নদের এপার-ওপার দুই তীরে সহজ যাতায়াতের জন্য সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগ সাতটি ভাসমান সেতু নির্মাণ করেছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আনোয়ার হোসেন জানান, ইজতেমা উপলক্ষে টঙ্গীজুড়ে কঠোর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ৯ হাজার পুলিশ সদস্যসহ র্যাব ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রায় ১০ হাজার সদস্য নিয়োজিত করা হয়েছে। ময়দানের চারপাশে প্রায় ৪০০ সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, মুসল্লিদের ব্যবহারের জন্য ৩১টি ভবনে আছে ৮ হাজার ৩৩১টি শৌচাগার। ১৭টি গভীর নলকূপ দিয়ে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে মুসল্লিদের। তিনটি গ্রিড থেকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। ৪টি শক্তিশালী জেনারেটর প্রস্তুত রয়েছে। মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্থে ১০টি বিশেষ ট্রেন চালু করা হয়েছে এবং সব ট্রেনের টঙ্গী রেলস্টেশনে যাত্রাবিরতি দেয়ার কথা আছে। এবার পুরো ইজতেমাকে ৯২টি খিত্তায় ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৪ জেলার লোকজন খিত্তা অনুসারে বসবেন।
ইজতেমার এই পর্বে মুসল্লিরা যে সব খিত্তায় থাকবেন: গাজীপুর (খিত্তা-১), টঙ্গী (খিত্তা-২,৩ ও ৪), ঢাকা (খিত্তা-৫-১৯ ও ২৪, ২৫, ২৭, ২৮, ২৯,৩২), রাজশাহী (খিত্তা-২০), নওগাঁ (খিত্তা-২১), নাটোর (খিত্তা-২২), চাঁপাইনবাবগঞ্জ (খিত্তা-২৩), সিরাজগঞ্জ (খিত্তা-২৬), টাঙ্গাইল (খিত্তা-৩০)। নড়াইল (খিত্তা-৩১), রংপুর (খিত্তা-৩৩), নীলফামারী (খিত্তা-৩৪), কুড়িগ্রাম (খিত্তা-৩৫), লালমনিরহাট (খিত্তা-৩৬), গাইবান্ধা (খিত্তা-৩৭), মুন্সিগঞ্জ (খিত্তা-৩৮), মাগুরা (খিত্তা-৩৯), ঝিনাইদহ (খিত্তা-৪০), বগুড়া (খিত্তা-৪১), নারায়ণগঞ্জ (খিত্তা-৪২), ফরিদপুর (খিত্তা-৪৩), যশোর (খিত্তা-৪৪), সাতক্ষীরা (খিত্তা-৪৫), বাগেরহাট (খিত্তা-৪৬), নরসিংদী (খিত্তা-৪৭), ভোলা (খিত্তা-৪৮), জামালপুর (খিত্তা-৪৯), ময়মনসিংহ (খিত্তা-৫০,৫১), মেহেরপুর (খিত্তা-৫২), চুয়াডাঙ্গা (খিত্তা-৫৩), নেত্রকোনা (খিত্তা-৫৪), কিশোরগঞ্জ (খিত্তা-৫৫), গোপালগঞ্জ (খিত্তা-৫৬), বরিশাল (খিত্তা-৫৭), রাজবাড়ি (খিত্তা-৫৮), শেরপুর (খিত্তা-৫৯), শরীয়তপুর (খিত্তা-৬০)। মাদারীপুর (খিত্তা-৬১), সিলেট (খিত্তা-৬২), কক্সবাজার (খিত্তা-৬৩), রাঙমাটি (খিত্তা-৬৪), খাগড়াছড়ি (খিত্তা-৬৫), বান্দরবান (খিত্তা-৬৬), ফেনী (খিত্তা-৬৭), নোয়াখালী (খিত্তা-৬৮), লক্ষ্মীপুর (খিত্তা-৬৯), চাঁদপুর (খিত্তা-৭০), বি. বাড়িয়া (খিত্তা-৭১), খুলনা (খিত্তা-৭২), পটুয়াখালী (খিত্তা-৭৩), বরগুনা (খিত্তা-৭৪), চট্টগ্রাম (খিত্তা-৭৫), কুমিল্লা (খিত্তা-৭৬), পিরোজপুর (খিত্তা-৭৭), ঝালকাঠি (খিত্তা-৭৮), সুনামগঞ্জ (খিত্তা-৭৯), হবিগঞ্জ (খিত্তা-৮০), মৌলভীবাজার (খিত্তা-৮১), পাবনা (খিত্তা-৮২), ঠাকুরগাঁও (খিত্তা-৮৩), পঞ্চগড় (খিত্তা-৮৪), দিনাজপুর (খিত্তা-৮৫), জয়পুরহাট (খিত্তা-৮৬), কুষ্টিয়া (খিত্তা-৮৭)। এছাড়া ৮৮-৯২ নম্বর খিত্তা সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
তিন মুসল্লির মৃত্যু
এবারের ইজতেমায় এ পর্যন্ত তিনজন মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দিনে ও রাতে দুজন মুসল্লি ও আজ একজন মুসল্লির মৃত্যু হয়। তাঁরা হলেন মো. ইয়াকুব শিকদার (৭৫), মোহাম্মদ আলী (৭০), মোহাম্মদ খোকা মিয়া (৬০)। এর মধ্যে ইয়াকুব আলীর বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায়, মোহাম্মদ আলীর চট্টগ্রাম ও খোকা মিয়ার বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলায়। প্রাথমিকভাবে জানা যায়, তিনজনই বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছেন।
প্রসঙ্গত, গতকাল বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেছেন, বিশ্ব ইজতেমা মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ সুদৃঢ়করণে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্ব ইজতেমার মতো মহান ধর্মীয় সমাবেশ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রাখবে।