বিজিবি’র ১০০তম রিক্রুট ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত

Uncategorized আইন ও আদালত চট্টগ্রাম জাতীয় বিশেষ প্রতিবেদন সারাদেশ

 

নিজস্ব প্রতিবেদক  :  আজ ৫ ডিসেম্বর,  চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বায়তুল ইজ্জতে অবস্থিত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর ঐতিহ্যবাহী প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার এন্ড কলেজ (বিজিটিসিএন্ডসি)-এর বীর উত্তম মজিবুর রহমান প্যারেড গ্রাউন্ডে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর ১০০তম রিক্রুট ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়েছে।


বিজ্ঞাপন

বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান, বিএএম, এনডিসি, পিএসসি,  প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে নবীন সৈনিকদের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও অভিবাদন গ্রহণ করেন। এসময় বিজিবি’র উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসন ও পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

সকাল ১০ টায় বিজিবি মহাপরিচালককে সশস্ত্র সালাম প্রদানের মধ্য দিয়ে নবীন সৈনিকদের শপথ গ্রহণ ও প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ শেষে বিজিবি মহাপরিচালক নবীন সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণের শুরুতে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবসহ ৭৫ এর ১৫ আগস্ট শাহাদতবরণকারী তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। একইসাথে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল বীর শহীদসহ বিজিবি’র জীবন উৎসর্গকারী ২ জন বীরশ্রেষ্ঠ, ০৮ জন বীর উত্তম, ৩২ জন বীর বিক্রম এবং ৭৭ জন বীর প্রতীকসহ ৮১৭ জন অকুতোভয় বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, ১৯৭৪ সালের ৫ই ডিসেম্বর পিলখানায় অনুষ্ঠিত এই বাহিনীর ৩য় রিক্রুট ব্যাচের সমাপনী কুচকাওয়াজে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেছিলেন এবং বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশ্যে ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই একই দিনে অদ্য ৫ই ডিসেম্বর তারিখে বাহিনীর ১০০তম রিক্রুট ব্যাচের passing Out প্যারেড অনুষ্ঠিত হওয়ায় আজকের দিনটি সবার জন্য অত্যন্ত স্মরণীয় ও মর্যাদাপূর্ণ।

বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, কিংবদন্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই বাহিনী সাফল্যের প্রথ পরিক্রমায় আজ একটি সুসংগঠিত, চৌকস, সুশৃঙ্খল ও পেশাদার দেশপ্রেমিক বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। বিজিবি ‘সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী’ হিসেবে বাংলাদেশের ৪,৪২৭ কি.মি. দীর্ঘ সীমান্ত সুরক্ষার পাশাপাশি সীমান্তে চোরাচালান ও মাদক পাচাররোধ, নারী ও শিশু পাচারসহ যেকোনো আন্ত:সীমান্ত অপরাধ দমনে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে। স্বাধীনতার পর দেশ গঠন এবং দেশ মাতৃকার সেবায় এ বাহিনীর সদস্যরা গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে যেকোন দুর্যোগময় মুহুর্তে জনগণের সেবায় তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং সাধারণ মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে। অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং অসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রেও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে বিশ্বস্ততা ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করে বিজিবি আজ সকলের আস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিজিবি মহাপরিচালক আরও বলেন, বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সানুগ্রহ পৃষ্ঠপোষকতা ও দূরদর্শী দিকনির্দেশনায় বিজিবি আজ একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও অত্যাধুনিক সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। বিজিবি দিবস-২০১৯ এর অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন- ‘জাতির পিতার হাতে গড়া এই প্রতিষ্ঠান আগামীতে সারা বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে মর্যাদা অর্জন করবে-সে বিশ্বাস আমার আছে।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই প্রত্যাশা বিজিবি’র আধুনিকায়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়েছে।

উন্নয়নের ক্রমধারায় বিজিবি’র সাংগঠনিক কাঠামোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং বিজিবি আজ ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে জল, স্থল ও আকাশপথে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনে সক্ষম। বিজিবিতে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার, এপিসি, এটিভি, আরসিভি, এয়ার বোট, অত্যাধুনিক এন্টি ট্যাংক অস্ত্র, জলযানসহ আধুনিক সরঞ্জামাদি। ডিজিটাল বাংলাদেশের সাথে তাল মিলিয়ে বিজিবি’র রিক্রুটিং ব্যবস্থাকে ই-রিক্রুটিং এ রূপান্তর করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বিওপিসমূহকে যোগাযোগের আওতায় আনা হয়েছে। নির্মান করা হয়েছে ৭৩টি আধুনিক কম্পোজিট বিওপি। দৃষ্টিনন্দন নারায়ণগঞ্জ ব্যাটালিয়নের মত আরো নতুন নতুন ব্যাটালিয়ন নির্মানের প্রকল্প চলমান রয়েছে। ক্যাপাসিটি ম্যাক্স এবং রিপিটারের মাধ্যমে সারাদেশে বিজিবি’র যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। অভিযানিক দায়িত্ব পালনে বিজিবি সদস্যদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বহুমুখী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ নতুন নতুন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে কুমিল্লায় বর্ডার গার্ড স্কুল অব ইন্টেলিজেন্স এবং খুলনায় বর্ডার গার্ড টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও ক্রমবর্ধমান বিজিবি বাহিনীর প্রশিক্ষণ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে চুয়াডাঙ্গায় আরও একটি আধুনিক প্রশিক্ষণ সুবিধা সম্বলিত ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

নবীন সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, “শৃঙ্খলাই সৈনিকের মূলভিত্তি। আদেশ ও কর্তব্য পালনে যে কখনো পিছপা হয় না সে-ই প্রকৃত সৈনিক, বীরযোদ্ধা। সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠা, আনুগত্য ও নির্ভরযোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা ও কর্মতৎপরতা, তেজ ও উদ্দীপনা একটি বাহিনীর শৃঙ্খলা ও পেশাগত দক্ষতার মাপকাঠি।” নবীন সৈনিকরা এসব গুণাবলির প্রতিফলন ঘটিয়ে বাহিনীর ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখবে বলে বিজিবি মহাপরিচালক আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বিজিবি’র চারটি মূলনীতি-‘মনোবল, ভ্রাতৃত্ববোধ, শৃঙ্খলা ও দক্ষতা’-এ উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়ে বিজিবি’র ওপর অর্পিত যেকোন দায়িত্ব সুশৃঙ্খল ও সুচারুরূপে পালন করে দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষার সুমহান দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। বিজিবি মহাপরিচালক সততা, আনুগত্য, কর্তব্যনিষ্ঠা ও শৃঙ্খলা- এই চারটি গুণের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ‘সবার আগে দেশ, এরপর বাহিনীর স্বার্থ, অতঃপর অধীনস্থ ও সহকর্মীদের স্বার্থ এবং সর্বশেষে নিজের স্বার্থ’কে বিবেচনায় রেখে সবাইকে কাজ করার নির্দেশ দেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ৫ ডিসেম্বর বাহিনীর ৩য় ব্যাচের সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “আজ আপনাদের কাছে আমি অনেক বড় কর্তব্য দিয়েছি, অনেক বড় কাজ দিয়েছি। এ কাজ হলো- চোরাচালানী বন্ধ করা। তোমাদের কাছে আমার হুকুম-স্মাগলিং বন্ধ করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি-তোমরা পারবা।” জাতির পিতা সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের বিদায়লগ্নে নবীন সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “যারা নতুন আজকে বিডিআর-এ যোগদান করেছো, যারা শপথ গ্রহণ করলা, তাদের কাছে আমার কথা রইলো- ঈমানের সাথে কাজ করো, সৎপথে থেকো, দেশকে ভালোবাসো।” বিজিবি মহাপরিচালক জাতির পিতার এই চোরাচালান বিরোধী ও প্রেষণামূলক অমূল্য কথাগুলোকে হৃদয়ে ধারণ করে সীমান্তে চোরাচালান রোধসহ পেশাগত দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সাথে নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান।

বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, বঙ্গবন্ধু একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়- একটি উন্নয়নশীল দেশ। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি স্বপ্নের প্রকল্পসমূহ আজ দৃশ্যমান। বাংলাদেশ আজ স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার পথে হাঁটছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত সমৃদ্ধ রাষ্ট্র। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশিত উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিজিবির প্রতিটি সদস্য দেশপ্রেম, সততা ও নিষ্ঠার সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে বলে বিজিবি মহাপরিচালক আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বিজিবি’র নবীন সৈনিকদের প্রদর্শিত তেজোদীপ্ত কুচকাওয়াজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং নতুন জীবনে পদার্পনের শুভলগ্নে তাদেরকে স্বাগত জানান।

বিজিবি মহাপরিচালক প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান শেষে ১০০তম রিক্রুট ব্যাচের সর্ববিষয়ে সেরা চৌকস রিক্রুট হিসেবে ১ম স্থান অধিকারী বক্ষ নম্বর-৩৭২ রিক্রুট (জিডি) ইমরান হোসেন সুয়েব, সর্ববিষয়ে ২য় ও শারিরীক উৎকর্ষতা (মহিলা) বিষয়ে ১ম স্থান অধিকারী বক্ষ নম্বর-৭১৩ সিপাহী খাদিজা খাতুন, ফায়ারিং-এ শ্রেষ্ঠ রিক্রুট বক্ষ নম্বর-৩৭৭ সিপাহী মোঃ উজ্জল হোসেন এবং শারিরীক উৎকর্ষতা (পুরুষ) বিষয়ে ১ম স্থান অধিকারী বক্ষ নম্বর-১৪২ সিপাহী জনি হোসেন এর হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন। এরপর নবীন সৈনিকদের চৌকসদল কর্তৃক বিজিবি মহাপরিচালককে আবারও সশস্ত্র সালাম প্রদানের মাধ্যমে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। পরিশেষে বিজিবি’র প্রশিক্ষিত সদস্যদের অংশগ্রহণে আকর্ষণীয় ট্রিক ড্রিল এবং বিজিবি’র সুসজ্জিত বাদকদল কর্তৃক মনোজ্ঞ ব্যান্ড ডিসপ্লে প্রদর্শন করা হয়।

উল্লেখ্য, বিজিবি’র ১০০তম রিক্রুট ব্যাচের মৌলিক প্রশিক্ষণ গত ১৮ জুন ২০২৩ তারিখে বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার এন্ড কলেজ (বিজিটিসিএন্ডসি)-তে শুরু হয়। প্রশিক্ষণ ভেন্যুতে সর্বমোট ৫৮২ জন রিক্রুটের মধ্যে ৫৪৪ জন পুরুষ এবং ৩৮ জন নারী রিক্রুট মৌলিক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছে। দীর্ঘ ২৪ সপ্তাহের অত্যন্ত কঠোর ও কষ্টসাধ্য এ প্রশিক্ষণ সফলভাবে শেষ করে আজ আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ ও সমাপনী কুচকাওয়াজের মাধ্যমে তাদের সৈনিক জীবনের শুভ সূচনা হলো।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *