নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর স্বল্প দূরত্বের যানবাহন হিসেবে সর্বোচ্চ ঝুঁকি আর চরম ভোগান্তির অপর নাম লেগুনা পরিবহন বা হিউম্যান হলার। নিকটতম যাত্রী পরিবহনে গন্তব্যে পৌছাতে বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের বাহনও এই অবৈধ লেগুনাকে ধরা হয়। তবে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে যাত্রীবাহী এই অবৈধ লেগুনা পরিবহন চলাচলে ডিএমপির পক্ষ থেকে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাস্তবে সেই নিষেধাজ্ঞা পালনে নেই প্রয়োজনীয় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। যাত্রীসেবার নামে রাজধানীর মিরপুরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রুট পারমিটহীন, ফিটনেস ও লাইসেন্সবিহীন প্রায় ৫০০ যাত্রীবাহী অবৈধ লেগুনা পরিবহন।
ট্রাফিক পুলিশের নাকের ডগাতেই মিরপুর বিভিন্ন রুটে বীরদর্পে চলছে এসব ফিটনেসবিহীন অবৈধ যাত্রীবাহী লেগুনা পরিবহন। তবে এর পেছনের কারণ হিসেবে রয়েছে প্রতিমাসে আদায়কৃত লাখ লাখ টাকার চাঁদা। সরেজমিনে রাজধানীর মিরপুর- ১, ২, ১০, ১৪, ভাষানটেক, দিয়াবাড়ি, গাবতলী, গিয়ে দেখা যায়, যাত্রী পরিবহনে বিভিন্ন রুটে চলছে প্রায় চার’শ অবৈধ লেগুনা পরিবহন। যাত্রী ওঠানামায় নির্ধারিত কোনো স্টপেজ না থাকা সত্বেও ফুটপাতসহ মূল সড়কের উপরেই বিশৃঙ্খলভাবে ডাইমেনশন, এপার ওপার, হাসান মটরস, সোহাস, গ্রামীন মিনি, আমিন বাজার ও ফার্স্ট টেন, মহানগর সিটি, ও ইন্দিরা ব্যানারে, কয়েক শতাধিক গাড়ি পার্কিং করে রাখা রয়েছে।
দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মিরপুর- ১ নম্বরে শুধু ছয়টি ব্যানারের ছয়টি অবৈধ লেগুনা স্ট্যান্ড রয়েছে। এর মধ্যে ডাইমেনশন নামীয় ব্যানার চলে মাজার থেকে চারাবাগ পর্যন্ত। এখান থেকে আগে ৭০-৮০ টি গাড়ি চললেও বর্তমানে ৫০ টি গাড়ি চলে ।
৫০ টা গাড়ি থেকে লাইন ম্যান জাকির ও আসাদের মাধ্যমে প্রতিদিন চাঁদাবাজির অবৈধ টাকা (যা জিপি নামে বলা হয়) গাড়ি প্রতি ৭২০ টাকা আদায় করা হয়। এবং জিরাবো স্টান্ডে আদায় করা হয় ৩৪০ টাকা।
সুহাস নামের ব্যানার চলে মিরপুর-১ থেকে দুয়ারীপাড়া পর্যন্ত। এখান থেকে প্রতিনিয়ত ৬০ থেকে ৬৫ টি গাড়ি চলে। এই গাড়িগুলো থেকে জিপি বাবদ ৭০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করে লাইনম্যান মামুন। দুয়ারীপাড়া স্ট্যান্ডে আদায় করা হয় ৪৬০ টাকা।
গ্রীন মিনি নামের ব্যানারে লেগুনা চলে মিরপুর-১ থেকে দুয়ারীপাড়া পর্যন্ত। এখানে আগে প্রতিনিয়ত ৮-১০ টা গাড়ি চললেও, এখন চলে ৩-৪ টা, লাইনম্যান হামিদ বলেন, বৈধ অনুমতি থাকার পরেও সুহাস ব্যানারের কারণে লাইন চালাতে পারছেন না, জিপি হিসেবে ৪০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। হাসান মোটরস নামের ব্যানারে মিরপুর-১ থেকে মাজার রোড পর্যন্ত চলে, এখানে প্রতিনিয়ত ৩০-৩৫ টি গাড়ি চলে, লাইনম্যান ইদ্রিসের মাধ্যমে জিপি হিসাবে চাঁদা আদায় করা হয় ৮০০ টাকা।
এপার ওপার নামের ব্যানারে মিরপুর ১ থেকে গাবতলী পর্বত পর্যন্ত চলে, এখানে ৪০ থেকে ৪৫টি গাড়ি লাইনম্যান মোহাব্বত ও আহাম্মদের মাধ্যমে জিপি হিসেবে চাঁদা আদায় করা হয় গাড়ি প্রতি ৮০০ টাকা। আমিন বাজার নামের ব্যানারে গাড়ি চলে মিরপুর-১ থেকে আমিন বাজার পর্যন্ত , এ রুটে ১৮ টি গাড়ি চলে, লাইনম্যান স্বপনের মাধ্যমে জিপি হিসেবে প্রতি গাড়ি থেকে ৮০০ টাকা চাঁদা হিসেবে আদায় করা হয়।
ফার্স্ট টেন নামীয় ব্যানার থেকে প্রতিদিন মিরপুর ১৪ থেকে গাবতলী পর্যন্ত ৩০-৩৫টি গাড়ি চলে, মিরপুর ১ নম্বরের লাইন ম্যান সুরুজের মাধ্যমে টাকাগুলো লেনদেন হয়, ফার্স্ট টেনের একজন ড্রাইভার বলেন, আমি যে গাড়িটা চালাচ্ছি, ১২ বছর আগে তার ফিটনেস ফেল, ড্যামেজ হিসেবে পড়ে থাকার কথা, কিন্তু সেটা এখনো চলছে প্রশাসনের চোখের সামনে।
এছাড়া মিরপুর ৬০ ফুটের মাথা থেকে, মহানগর সিটির ব্যানারে শ্যামলী পর্যন্ত গাড়ি চলে প্রায় ১২০ টি, লাইনম্যান মির্জার মাধ্যমে প্রতি গাড়ি থেকে জিপি’র চাঁদা আদায় করা হয় ৫৬০ টাকা। একই জায়গা থেকে ইন্দিরা নামক ব্যানারে ফার্মগেট পর্যন্ত লেগুনা চলে প্রায় ১৫০ টি গাড়ি, লাইনম্যান চুন্নুর মাধ্যমে প্রতি গাড়ি থেকে জিপি হিসেবে চাঁদা আদায় করা হয় ১১০০ টাকা।
লাইনম্যান হিসেবে পরিচিত এই মানুষগুলো দৈনিক ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা বেতন পান বলে তারা দাবি করেন।
এ সকল গাড়ির মালিক ও ড্রাইভাররা নিয়ম না মেনে রাস্তা বন্ধ করে রেখে গাড়ি চালায়, এদের খামখেয়ালির কারণে ছোট বড় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। দিয়াবাড়ি মোড়ের সোহাগ বলেন, লেগুনার সঙ্গে যখন কোন গাড়ির বা মোটরসাইকেল এর ধাক্কা ঘটে, তখন ওই লেগুনা কোম্পানির সকল ড্রাইভার হেলপাররা এক হয়ে ভুক্তভোগী গাড়ির বা মোটরসাইকেল ড্রাইভার এর উপর আক্রমণাত্মক আচরণ করে, তখন স্থানীয় দায়িত্বরত সার্জেন্টদের দেখা যায় লেগুনাওয়ালাদের পক্ষ নিতে।
অবৈধ এই লেগুনার বিষয়ে একাধিক রিকশাচালক বলেন, সন্ধ্যার পরে বেশিরভাগ লেগুনা চলে হেডলাইট নষ্ট অবস্থায় অন্ধকারে, কখনো দেখা যায় দুইটা লাইট বন্ধ কখনো বা একটা লাইট বন্ধ, প্রশাসনের নজরদারি না থাকার কারণে অহরহ সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে। মহানগরীতে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও কিভাবে তারা মহানগরীতেই এই অবৈধ লেগুনা চালান এমনটি প্রশ্ন সবার। তবে এক ড্রাইভার বলেন, মালিকেরা বিভিন্ন রুটে এ সকল অবৈধ লেগুনা পরিবহন চালাতে স্থানীয় নেতা ও প্রশাসনের অনেককেই ম্যানেজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। রাস্তায় গাড়ি চালাতে লাইন খরচ বাবদ প্রতিদিন গাড়ি প্রতি সর্বনিম্ন ৭০০/৮০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়।
সূত্রমতে, শুধুমাত্র রাজধানীর মিরপুরে চলমান প্রায় ৫০০ লেগুনা থেকে গাড়ি প্রতি আদায়কৃত দৈনিক চাঁদা আদায় হয় প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকা যার মাসিক চাঁদার হিসাব করলে দেখা যায় সেটা প্রায় দেড় কোটি টাকা।এই লেগুনা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে গত বছর ১৫ অক্টোবর দারুস সালাম থানা এলাকায় শাহ আলম নামে একজনের নিহত হন। সেই মামলায় দারুস সালাম থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোহাম্মদ ইসলাম-সহ অনেকেই আসামী হয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিরপুর জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি ট্রাফিক) মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ডিএমপির মূল সড়কে অবৈধ কোন গাড়ি চালানোর সুযোগ নাই, তিনি সাথে সাথে মিরপুর ডিভিশনের দায়িত্বরত টিআইদেরকে ওয়ারলেসের মাধ্যমে লেগুনা সম্পর্কে বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করেন। ভাঙ্গা গাড়ি, শিশু ড্রাইভার, হেলপার যেন না থাকে সে বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করেন, এবং আগামীতে রুট পারমিটহীন ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করবেন বলে জানান।
এবিষয়ে বিআরটিএ মিরপুর সার্কেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক (ইঞ্জি) মো. শহিদুল্লাহ’র বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি পরে জানাবেন বলে জানান তবে মাসিক দেড় কোটি টাকার চাঁদাবাজির ভাগ কোথায়-কোথায়, কার-কার কাছে যায় জানতে এবিষয়ে তিনি কোন প্রকার মন্তব্য করতে রাজি হন নাই।