নিজস্ব প্রতিবেদক : নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপ বিক্রির প্রতিরোধে আমদানিকারকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীবৃন্দ ও অংশীজনের অংশগ্রহণে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে, এ খবর সংশ্লিষ্ট সুত্রের।
জানা গেছে, গতকাল রবিবার ১১ ফেব্রুয়ারি, দুপুর সাড়ে ১২ টায় জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কর্তৃক অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সভাকক্ষে নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপ বিক্রয় প্রতিরোধে আমদানিকারকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীবৃন্দ ও অংশীজনের অংশগ্রহণে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। উল্লেখিত মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান।
এছাড়াও সভায় উপস্থিত ছিলেন অধিদপ্তরের পরিচালক (কার্যক্রম ও গবেষণাগার) ফকির মুহাম্মদ মুনাওয়ার হোসেন, অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় ও ঢাকা জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ, এনএসআই এর প্রতিনিধি, এফবিসিসিআই এর পরিচালক জনাব প্রীতি চক্রবর্তী, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মাহবুব হোসেন, বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের সচিব মুহাম্মদ মাহবুবুল হক, বাংলাদেশ কেমিস্টস্ এন্ড ড্রাগিস্টস্ সমিতির পরিচালক মোঃ তোফাজ্জল হোসেন, বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড সার্জিক্যাল এসোসিয়েশনের জয়েন সেক্রেটারি মোঃ জসিম উদ্দিন, কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সাধারন সম্পাদক এডভোকেট হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া, আমদানীকারকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীবৃন্দ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ।
স্বাগত বক্তব্যে অধিদপ্তরের পরিচালক (কার্যক্রম ও গবেষণাগার) ফকির মুহাম্মদ মুনাওয়ার হোসেন সভায় উপস্থিত সকলকে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, ডায়াবেটিসকে বলা হয় অন্যান্য রোগের মূল কারণ। তিনি মেডিসিন সেক্টরে ব্যবসায়ীদের জেনে বুঝে সততার সাথে ব্যবসা করা কথা বলেন। এই সেক্টরটিকে নির্ভরযোগ্য করার জন্য মতামত প্রদানের পাশাপাশি অধিদপ্তরের কার্যক্রমে সকলের সহযোগিতা কামনা করে তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।
সভার শুরুতে অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল অধিদপ্তর কর্তৃক নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপ বিক্রয় বিষয়ে পরিচালিত অভিযানের সংক্ষিপ্ত তথ্য তুলে ধরেন। এক্ষেত্রে তিনি বলেন, অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশনা অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে নকল ডায়াবেটিস মাপার স্ট্রিপ (আকুচেক) এর ব্যাচ যাচাই করার জন্য গত ৬ ফেব্রুয়ারি, ফার্মা সলুউশন নামক প্রতিষ্ঠানে প্রধান কার্যালয়ে অভিযান পরিচালিত হয়। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ঐ ব্যাচের স্ট্রিপ তাদের প্রতিষ্ঠানের নয় বলে তদারকি টিমকে জানানো হয়। এরপর লাজ ফার্মার কাকরাইল শাখায় তদারকিতে গিয়ে দেখা যায় উল্লেখিত ব্যাচের স্ট্রিপ প্রতিষ্ঠানটি ফার্মা সলুউশন থেকে ক্রয় করেছে এবং তার ভাউচার তদারকি টিমকে প্রদান করেন।
উল্লেখ্য, নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপের উক্ত ব্যাচ নম্বর দিয়ে এর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান Roche (প্রসিদ্ধ জার্মানি ঔষধ ও মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান) বরাবর ই-মেইল করে জানা যায় উক্ত ব্যাচের স্ট্রিপ তাদের প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত হয়নি। সে প্রেক্ষিতে গত ৭ ফেব্রুয়ারি, ফার্মা সলুউশনের এর কুনিপাড়া বিক্রয় কেন্দ্রে অভিযানে গিয়ে যাচাই করে প্রমাণিত হয় যে, উক্ত প্রতিষ্ঠান লাজ ফার্মা কাকরাইল শাখাকে বর্ণিত নির্দিষ্ট ব্যাচের নকল ডায়াবেটিস মাপার স্ট্রিপ সরবরাহ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি জনস্বার্থে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি, অধিদপ্তরে অনুষ্ঠিত শুনানিতে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য থেকে জানা যায় তারা নয়াপল্টনে অবস্থিত প্রিন্ট ওয়ান নামক প্রতিষ্ঠান থেকে এ সকল নকল ডায়াবেটিস মাপার স্ট্রিপের মোড়ক তৈরী করেছেন। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নয়াপল্টনে অবস্থিত প্রিন্ট ওয়ান নামক প্রতিষ্ঠানে সরজমিনে তদারকিতে এর সত্যতা পাওয়া যায়। অত:পর জরিমানা আরোপসহ প্রতিষ্ঠানটি জনস্বার্থে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
সভায় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মাহবুব হোসেন নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপের উপর অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত অভিযানের জন্য তিনি অধিদপ্তরকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপসহ অন্যান্য নকল ঔষধ ও ডিভাইস সনাক্তকরণে সকলের সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন।
আলোচনায় বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের সচিব জনাব মুহাম্মদ মাহবুবুল হক বলেন, খুবই স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আমরা আজ সভা করছি। চিকিৎসার পূর্বে যথাযথভাবে রোগ নির্ণয় করা জরুরি। নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপের মাধ্যমে সঠিকভাবে ডায়াবেটিসের মাত্রা নিরুপণ করা যাবে না। এতে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে।
সভায় কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সাধারন সম্পাদক এডভোকেট হুমায়ুন কবীর ভূঁইয়া সভা আয়োজনের পাশাপাশি নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপের বিষয়ে অভিযানের জন্য অধিদপ্তরকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, মানুষ হত্যার চেয়েও নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপ তৈরী করা জঘন্যতম অপরাধ। তিনি আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে এই সকল অপরাধ নির্মূলের কথা বলেন।
সভায় এফবিসিসিআই এর পরিচালক প্রীতি চক্রবর্তী বলেন, জীবন কেড়ে নেয়ার অধিকার কারো নেই। তিনি সভায় ঔষধ ও মেডিকেল ডিভাইস আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা তুলে ধরেন। তিনি ঔষধ ও মেডিকেল ডিভাইস সামগ্রী আমদানির ক্ষেত্রে এলসির বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়ার অনুরোধ জানান। তিনি চাল, ডাল ও তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি ঔষধ সেক্টর নিয়ে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করায় অধিদপ্তরকে ধন্যবাদ জানান।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তাঁর বক্তব্যের শুরুতে সভায় উপস্থিত সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ভোক্তা অধিকারের ব্যাপ্তি এমন যেখানে ভোক্তার অধিকার রয়েছে সেখানেই অধিদপ্তর কাজ করবে। তিনি আরও বলেন, জাতির জন্য দূর্ভাগ্যজনক যে আমাদের এমন বিষয় নিয়ে সভা করতে হচ্ছে। আমরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছি। দেশে প্রায় ৩০ মিলিয়ন ডায়াবেটিস রোগী রয়েছে। এই রোগীদের বড় একটি অংশ বাসায় বসে ডায়াবেটিস স্ট্রিপ দেয়ে ডায়াবেটিস চেক করে থাকেন। নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপ দিয়ে পরীক্ষা করলে সঠিক ফলাফল আসবে না। এই ফলাফলের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা করা হলে রোগী মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়বেন। এছাড়াও বিদেশি ঔষধ ও মিডিকেল ডিভাইস নকল করা হলে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে ফার্মেসি সেক্টরে উল্লেখ্যযোগ্য সম্পসারণ হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় ১৬৫-১৭০ টি দেশে ঔষধ রপ্তানি করে থাকে। তবে কিছু ঔষধ ও ইকুইপমেন্ট আমদানি করতে হবে। অত:পর তিনি ঔষধ ও মেডিকেল ডিভাইসের উপর অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত অভিযানে প্রাপ্ত অসংগতিসমূহ যথাক্রমে, আমদানিকৃত ঔষধ ও ইকুইপমেন্টে খুচরা বিক্রয়মূল্যসহ আমদানিকারকের তথ্য না থাকা, মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক নির্ধারিত সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে ডিভাইস বিক্রয়, মেয়াদোত্তীর্ণ ডিভাইস পাওয়া, ফ্রিজে ডিভাইস ও ঔষধের সাথে কাঁচা সবজিপণ্য সংরক্ষণ করে রাখা, পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিক্রয় রশিদে কার্বন কপি ব্যবহার না করা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেন।
মহাপরিচালক সভায় সার্বিক আলোচনার পর বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে সাতটি সুপারিশ করেন সুপারিশ সমুহ যথাক্রমে, ঔষধ ও ইকুইপমেন্ট আমদানির ক্ষেত্রে কাস্টমস পয়েন্টগুলোতে নজরদারি বৃদ্ধি করা। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃক এ বিষয়ে গভীর পর্যালোচনা করে নজরদারি বৃদ্ধি করা। এক্ষেত্রে মূল কাজ করবে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর এবং ভোক্তা অধিদপ্তর সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। নকল ঔষধ ও ইকুইপমেন্ট প্রস্তুত, সরবরাহ ও বিক্রয়ের সাথে জড়িত আমদানিকারকদের লাইসেন্স বাতিল করা। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় তথা তাদের প্রতিনিধি হিসেবে এফবিসিসিআই এর পক্ষ থেকে জোরালো প্রতিবাদ করা। কেননা অসাধু ব্যবসায়ীদের কর্মকান্ডের জন্য সৎ ব্যবসায়ীগণ টিকতে পারছে না। বৈধ সোর্স থেকে ঔষধ ও মেডিকেল ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করা। বাংলাদেশ ফার্মাসি কাউন্সিল অভিযুক্ত ফার্মেসির ফার্মাসিস্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে এবং ভোক্তা অধিদপ্তর সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে করনীয় বিষয়ে সুপারিশ করবে।
সভার সভাপতি অধিদপ্তর কর্তৃক অভিযানে প্রাপ্ত নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপের উল্লেখিত ব্যাচের সকল স্ট্রিপ মার্কেট থেকে প্রত্যাহার করার নির্দেশনা প্রদান করেন। গতকালের সভা থেকে সকলের মতামত পর্যালোচনাপূর্বক সুপারিশসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর/সংস্থা বরাবর পত্র প্রেরণ করা হবে বলে তিনি জানান।তিনি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দকে সকল ক্ষেত্রে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ জানান।
পরিশেষে মহাপরিচালক প্রতিটি ঔষধ ও মেডিকেল ইকুইপমেন্ট যেন নিরাপদ হয় সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করে উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।