নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন নিয়ে নগরবাসী যতটা না উৎসাহী তার চেয়ে বেশি বিরক্তির উদ্রেক হয়েছে। সাধারণত দীর্ঘ বিরতির পর নির্বাচন নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দেয়। কিন্তু এই উৎসাহ ভাটা পড়েছে এবার শব্দদূষণে। পাড়া-মহল্লায় এবং গলিতে গলিতে উচ্চ শব্দে মাইকসহ বিভিন্ন শব্দযন্ত্রের হুংকারে রীতিমতো অতিষ্ঠ নগরবাসী।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পোস্টার ইস্যু। এবারের নির্বাচনে রাস্তাঘাটে এত বেশি পোস্টার লাগানো হয়েছে যে, পথচারীদের রীতিমতো বিড়ম্বনায় পড়ছে হচ্ছে। পোস্টারে পোস্টারে ঢেকে গেছে বাসা-বাড়ির হোল্ডিং নম্বর, এমনকি কোনো কোনো এলাকায় সারিবদ্ধ পোস্টারের কারণে যান চলাচলে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
বিশেষ করে গোপীবাগ থেকে সোবহানবাগ, মিরপুর থেকে মাহুতটুলী—যেখানে যাবেন, সড়কে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখা কঠিন হয়ে পড়েছে। দৃষ্টি ঢাকা পড়ছে সারি সারি পোস্টারে। নির্বাচন কমিশনের আইন মেনে মেয়র ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থীরা সাদাকালো পোস্টার লাগিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু পোস্টারের গায়ে জামা হিসেবে পরিয়েছেন স্বচ্ছ পলিথিন। শীতের হিমেল বাতাসে বা যানবাহনের সঙ্গে লেগে পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার ঝরে ঝরে পড়ছে। ভোরে বা সন্ধ্যার পরে নগরের ছিন্নমূল বাসিন্দারা তা কুড়িয়ে সড়কের পাশে জড়ো করে আগুন ধরিয়ে উত্তাপ নিচ্ছেন।
শুধু তাই নয়, আগারগাঁও থেকে শুরু করে খিলগাঁও—যেখানেই যাবেন। নির্বাচনী প্রচারে মাইকের বদলে দেখতে পাবেন কাভার্ডভ্যানে বসানো সাউন্ডবক্স। সেখান থেকে বিকট শব্দে প্রার্থীর পক্ষে চটুল ভাষায় গান বাজছে। সরকারি বা বিরোধী দলের, তিনি যে-ই হোন—নির্বাচনের প্রচারে একই পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোমলমতি শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে হাসপাতালের রোগী—কেউ-ই ওই বিকট শব্দের উৎপাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
এ পরিস্থিতিতে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) থেকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারে পরিবেশদূষণ নিয়ে একটি জরিপ করা হয়েছে। মূলত পোস্টারে পলিথিনের ব্যবহার ও উচ্চশব্দে প্রচার চালানো—এ দুটি বিষয়ে তারা জরিপটি করে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদারের নেতৃত্বে জরিপটি হয়েছে।
জরিপে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়া ৩০ জন প্রার্থীর পোস্টারে ৯ থেকে ১৮ দশমিক ৫ গ্রাম করে পলিথিন ব্যবহার করা হয়েছে। ২৫ লাখ পোস্টারে পলিথিন ব্যবহার হয়েছে উল্লেখ করে জরিপটিতে বলা হয়েছে, এতে মোট ৩৩ দশমিক ৬৮ টন পলিথিন ব্যবহূত হয়েছে। পোস্টার ও পলিথিন মিলিয়ে নির্বাচন উপলক্ষে মোট ৭৩ দশমিক ২৫ টন আবর্জনা তৈরি হবে।
জানতে চাইলে কামরুজ্জামান মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, সিটি করপোরেশনের সম্ভাব্য মেয়র ও কাউন্সিলররা প্রচারণার সময়েই যে পরিমাণে দূষণ চালাচ্ছেন, জয়ী হওয়ার পর কী করবেন, তা নিয়ে এখনই নগরবাসীর মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে।
পলিথিনসহ এসব আবর্জনা রাজধানীর বিভিন্ন নালা-নর্দমায় গিয়ে জমা হচ্ছে। ফলে তা একদিকে যেমন পরিবেশকে দূষিত করবে, অন্যদিকে রাজধানীর বৃষ্টির পানি আটকে রেখে জলাবদ্ধতা তৈরিতেও ভূমিকা রাখবে। অনেক ক্ষেত্রে এসব আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলা হয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, এতে রাজধানীতে ভয়াবহ পরিবেশদূষণ দেখা দিতে পারে।
যদিও ২১ জানুয়ারি উচ্চ আদালতের এক আদেশে দুই সিটি করপোরেশনের প্রার্থীদের পোস্টার থেকে পলিথিন সরিয়ে নেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। ২২ জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর করার নির্দেশ দেয়া হয়। এর পরপরই ২২ ও ২৩ জানুয়ারি পলিথিন ও শব্দদূষণ নিয়ে জরিপটি করা হয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম রফিক আহমেদ বলেন, ‘পোস্টার থেকে পলিথিন সরিয়ে ফেলার জন্য উচ্চ আদালত থেকে প্রার্থীদের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমরা আশা করি তারা তা পালন করবেন। আমরা এ ব্যাপারে একটি চিঠি নির্বাচন কমিশনের কাছেও পাঠাচ্ছি। তবে সবার আগে আমাদের সবাইকে পলিথিন ও শব্দদূষণের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।’
শব্দদূষণ নিয়ে জরিপটি করা হয়েছে রাজধানীর ২০টি স্থানে। এর মধ্যে সব কটি স্থানে সরকারের মানমাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ প্রার্থীরা মাইক ও সাউন্ডবক্সের মাধ্যমে যে প্রচার চালাচ্ছেন, তা মারাত্মক শব্দদূষণ ঘটাচ্ছে। ধানমন্ডি, জিগাতলা, কাজীপাড়া, মুগদাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শব্দ মাপার যন্ত্র দিয়ে ওই দূষণ পরিমাপ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি স্থানে ১২০ ডেসিবেলের চেয়ে বেশি মাত্রায় শব্দ পাওয়া গেছে। এই মাত্রায় শব্দ কেউ যদি ঘণ্টাখানেক শোনে, তাহলে তার স্থায়ীভাবে বধির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, নির্বাচনের প্রচারে পলিথিন ও শব্দদূষণ থেকে আমরা বুঝতে পারলাম তারা জয়ী হওয়ার পর আমাদের কেমন একটি শহর উপহার দেবেন।