সোহানের কন্যা সামিয়া রহমান সৃষ্টির মরদেহ  উদ্ধার হওয়া যাত্রাবাড়ীর সেই রংধনু আবাসিক হোটেল নিয়ে নানা প্রশ্ন

Uncategorized অপরাধ আইন ও আদালত ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী

নিজস্ব প্রতিবেদক :  প্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের মেয়ে সামিয়া রহমান সৃষ্টির মরদেহ যেখান থেকে উদ্ধার হয়েছিল, যাত্রাবাড়ীর সেই রংধনু আবাসিক হোটেলটি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এখানে নারী ও শিশুদের আটকে রেখে অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হয়। হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে জিম্মি এসব নারী-শিশু কথা না শুনলে চলে শারীরিক নির্যাতন। ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।


বিজ্ঞাপন

গত রবিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর রংধনু আবাসিক হোটেলের একটি কক্ষ থেকে সামিয়া রহমানের লাশ উদ্ধার করে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। এ ঘটনায় একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা হয়েছে। পুলিশ মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করতে তদন্ত করছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে বলে জানিয়েছে তারা।
লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন একই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) তামান্না আক্তারী। তবে সুরতহাল প্রতিবেদনের সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সামিয়া রহমান সৃষ্টির মরদেহ উদ্ধারের পরদিন সোমবার দুপুর ১২টার দিকে পাঁচতলা এই হোটেলটিতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে কর্মচারীদের আচরণ সন্দেহজনক। সাংবাদিক পরিচয় জানার পর তারা এ প্রতিবেদককে অসহযোগিতা করেন। দোতলার যে কক্ষ থেকে সামিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে সেটি দেখতে চাইলে কর্মচারীরা বাধা দেন। এসময় এক ব্যক্তি ইশারা দিয়ে অন্যদেরকে বলেন এই প্রতিবেদককে সরিয়ে নিতে। একপর্যায়ে প্রতিবেদককে হোটেল থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করা হয়।

হোটেলটিতে যাতায়াত করা কয়েকজন পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ঢাকা টাইমসকে জানান, নানা ফাঁদে ফেলে নারীদের জিম্মি করা হয়ে থাকে হোটেলটিতে। একাধিক সূত্র মতে এখনও রংধনু হোটেল কর্তৃপক্ষের হাতে জিম্মি রয়েছে অন্তত ১০ জন নারী ও শিশু। তাদেরকে চাহিদা অনুযায়ী এই হোটেল ছাড়াও বিভিন্ন হোটেলে পাঠিয়ে অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হয়।

এসব হোটেলের মধ্যে রয়েছে যাত্রাবাড়িতে অবস্থিত- নিউ পপুলার প্যালেস আবাসিক, নিউ বলাকা (সাবেক প্রভাতি) আবাসিক, নিউ মেঘনা আবাসিক, পদ্মা আবাসিক হোটেল, আয়শা মনি আবাসিক, রোজ ভিউ আবাসিক হোটেল। হোটেল শাহিন আবাসিক, নাহিদ আবাসিক হোটেল, আল হায়াত আবাসিক। এছাড়া রয়েছে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারের ফ্যাসিন হোটেল। এসব হোটেলের যখন যেখানে প্রয়োজন সেই অনুযায়ী নারী-শিশুদের পাঠানো হয়। নারী-শিশুদের জিম্মি করার তথ্য এ প্রতিবেদকের কাছে ফাঁস হওয়ায় হোটেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে তৎপরতা শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে হোটেলটির একটি সূত্র।

রংধনু হোটেলের ভবন মালিকের নাম আল আমিন। হোটেলটি ভাড়ায় নিয়েছেন আল আমিন নামে আরেক ব্যক্তি। হোটেলটিতে এসব কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারীর নাম সাজ্জাদ। তিনি যাত্রাবাড়ী এলাকায় ‘ডিবি পুলিশের ক্যাশিয়ার’ হিসেবে পরিচিত। তার আরেক সহযোগী শাহজাহান কচি, তিনি ‘মাদকের কেমিস্ট’ হিসেবে পরিচিত।

এছাড়াও তাদের সঙ্গে মিলে আবুল কালাম জয়, পাপন, মিঠু, জামাল, পলাশ, সাইদুল ইসলামসহ অনেকে মিলে নিয়ন্ত্রণ করছেন আশপাশের অন্তত আরও চারটি হোটেল। অনৈতিক কাজে বাধ্য করার জন্য তাদের রয়েছে টর্চার সেল। সেখানে মেয়েদের ওপর অত্যাচার করেন সাইদুল ও জামাল নামে দুজন।

অভিযুক্ত সাজ্জাদকে একাধিকবার মুঠোফোনে হোটেলের নিচ থেকে কল করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি। পরর্বতীতে মুঠোফোনে একজন অসহায় নারী সেজে ক্ষুদেবার্তা দেওয়া হলে তিনি ফিরতি ফোন করেন এবং যাত্রাবাড়ী যেতে বলেন। পরে হোটেলের নিচে প্রতিবেদকের উপস্থিতি টের পেয়ে ‘চিনি না’ বলে পরবর্তী কল কেটে দেন।

রংধনু হোটেলে উপস্থিত শান্ত নামে একজন নিজেকে হোটেলের কর্মচারী বলে পরিচয় দেন। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হোটেলটিতে পরিবারের বিস্তারিত তথ্য দিয়ে যে কেউ কক্ষ ভাড়া নিতে পারেন। সামিয়া রহমান সৃষ্টির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুপুর ২টার পর পাঠাও মোটরসাইকেল দিয়ে তিনি হোটেলে আসেন। তাকে নিচ থেকে রিসিভ করে নেওয়া হয়। এরপর রুমে গিয়ে জায়নামাজ চান। জায়নামাজ না থাকায় পরিষ্কার বেডশিট দেওয়া হয়। এরপর ইফতারি আনার জন্য ৫০০ টাকা দিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে দেন সামিয়া। ইফতারি দিতে গিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় সামিয়ার গলায় ফাঁস দেওয়া।

তবে সামিয়া রহমানের মরদেহ খাটে বসা অবস্থায় গলায় ফাঁস নেওয়া ছিল। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করলে তিনি দ্রুত হোটেলে চলে যান রেজিস্ট্রার খাতা আনতে। সেখানে দেখা যায়, রংধনু হোটেলের রেজিস্ট্রারে লেখা আছে, নাম সামিয়া রহমান সৃষ্টি। পিতার নাম সোহানুর রহমান সোহান। মাতার নাম প্রিয়া রহমান। বাসার ঠিকানা উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরে। বয়স ৩৩ বছর। পেশা চাকরি। আগমনের উদ্দেশ্য চিকিৎসা। আগমনের সময় ও তারিখ নির্দিষ্ট করে লেখা রয়েছে, যা অন্য কোনো বর্ডারের ক্ষেত্রে লেখা নেই। রুম নম্বর ২১০। ভোটার আইডি ৪১৭১১…..৯৩ এবং ফোন নম্বর ০১৭৭……..৭৮৯। পাশে সৃষ্টির স্বাক্ষর।

সামিয়া রহমানের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) তামান্না আক্তারী। বাস্তবতার সঙ্গে সুরতহালের মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সুরতাহাল প্রতিবেদনে বলা হয়, সামিয়া রহমানের মাথা ও কপাল স্বাভাবিক। কপালের মাঝখানে পুরোনো কাটা দাগ আছে। মুখমণ্ডল স্বাভাবিক, চোখ অর্ধখোলা। দুই ঠোঁটের মাঝখানে জিহ্বা অর্ধকামড়ানো অবস্থায়। গলায় অর্ধচন্দ্রাকার কালো দাগ। কাঁধ স্বাভাবিক, দুই হাত লম্বালম্বি অবস্থায় হাতের আঙুল অর্ধমুষ্ঠি। বুক, পেট, পিঠ, স্বাভাবিক। কোমরে হালকা কালশিরা দাগ। দুই পা লম্বালম্বি অবস্থায় স্বাভাবিক। দুই পায়ের আঙুল স্বাভাবিক। যৌনাঙ্গ স্বাভাবিক, হালকা সিমেন (বীর্য) পরিলক্ষীত হয়। মলদ্বার স্বাভাবিক।

তবে ঘটনার পরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ঢাকা টাইমসের এ প্রতিবেদক কৌশলে গিয়ে দেখতে পান, সৃষ্টির মুখে দুই গালে নীলাভ দাগ। বাম পাশের চোখের নিচে নীলচে কালো জখম দাগ। বুকের বাম পাশের স্তনে কামড়ের দাগ। কোমড়ের দিকে নখের সুঁচারু অনেক দাগ। এছাড়াও তার এক পায়ে একটি অ্যাংলেট পরানো ছিল। এই বিষয়গুলো পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ ছিল না। মর্গে লাশের এমন অবস্থার ছবি তোলা যায়নি।

এছাড়াও সুরতহালে লেখা রয়েছে, দুই পা মরণোত্তর স্বাভাবিক। কিন্তু ঢাকা টাইমসের কাছে থাকা ১২ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সবুজ চাদর বিছানো বক্স খাট। দুটো লাল কভারের বালিশ। আর বিছানার মাঝ থেকে ডান পাশ পর্যন্ত জানালা, যা পর্দা দিয়ে ঘেরা। সেই জানালার সঙ্গেই গিঁট দেওয়া নিজের গায়ের ওড়নার এক প্রান্ত, অন্য প্রান্ত গলায় পেঁচানো। আর সামিয়া দুই হাঁটুর ওপর অর্ধবসা অবস্থায় এক হাত পেটের দিকে, অন্য হাত এক হাঁটুর সঙ্গে। মাথা বাম দিকে হেলানো। পাশেই রয়েছে কালো বোরকা ও খয়েরি রংয়ের ব্যাক কাভার লাগানো একটি মোবাইল ফোন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে সামিয়ার লাশ দেখতে আসা তার চাচা ওবায়দুর রহমানের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা টাইমসের। তিনি চোখের নিচে কালো নীলা জখমের দাগ দেখেছেন বলে জানান। ওবায়দুর রহমান বলেন, সোহানুর রহমানের ছোট একটা ব্যাংক লোন ছিল ক্রেডিট কার্ডের। সেটা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে কিছুটা কথা কাটাকাটি হয় সৃষ্টির। তবে সে মা-বাবাকে একসঙ্গে হারিয়ে শোকে ছিল। মায়ের কথাটা বেশি মনে করত। (তথ্য সূত্র ও ছবি : ঢাকা টাইমস২৪ডটকম )


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *