মোঃ হাসানুজ্জামান : বলা হয়ে থাকে, ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ কিছুটা গাদ্দার। বিশেষ করে বাংলাদেশ সহ আশেপাশের বাঙালিদের এই তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। পলাশীর যুদ্ধই আমাদের সে-কথা মনে করিয়ে দেয়।
আচ্ছা আমরা বাংলাদেশের বাঙালি হিসেবে কতোটা উচ্চ শ্রেণির ? সম্প্রতি ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাকের বিষয়েই তা বিবেচনা করা যাক। কারণ কথিত দেশপ্রেমীদের ফেইসবুকে ভারত বিরোধী প্রচারণার আচঁ কি আদৌ ভারতে স্পর্শ করেছে ? না, মোটেই তা ভারতকে প্রভাবিত করেনি। বরং পবিত্র ঈদ উল ফিতর ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ভারতীয় পণ্য কেনায় রীতিমতো ধুম পড়ে গিয়েছিল। এমনকি লম্বা ছুটিতে ভারতের দর্শনীয় স্থানে ছিলো বাংলাদেশের পর্যটকদের হিড়িক। আর রমজানেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে বিএসএফ চালিয়েছে গুলি। তাহলে বলুন- বাংলাদেশী হিসেবে আমরা গর্বিত নাকি লজ্জিত ?
পর্যবেক্ষণ কি বলছে ? সম্প্রতি পবিত্র ঈদ উল ফিতর, বৈশাখ ও শপিং নিয়ে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। ঈদ ও বৈশাখের কেনা-কাটা চলেছে পুরোদমে। যদি সহজ বাংলায় বলি তাহলে সরকার বিরোধী পক্ষগুলো ‘ভারতীয় পণ্য বর্জনের’ আহ্বানের কতটুকু প্রভাব পড়েছে তা দেখতে রাজধানীর শপিংমল, সুপার শপ গুলোতে ঘুরে ঘুরে দেখার ইচ্ছা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশকে উদ্ধার করে ফেলা এই জাতির কেনাকাটার যে গতি দৃষ্টিগোচর হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে জনগন এই ‘বর্জন’ আন্দোলনে মোটেই সাড়া দেয়নি। শুধু পোষাকপরিচ্ছদেই নয়, নিত্যপণ্যের বেলায়ও চিত্র একই। বিশেষ করে কোনো প্রসাধনী সামগ্রী ক্রয়ে বাঙালি ভারতীয় পণ্যকেই ব্রান্ড হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছে বেশি। অথচ দেশি পণ্যের প্রতি এখনো অনীহা।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ও পরবর্তী : বাজারের চিত্র বলছে- জাতীয় নির্বাচন বর্জনের পর ‘ভারতীয়পণ্য বর্জনে’র ডাক স্পষ্টত:ই খুব বেশি হালে পানি পায়নি। নির্বাচনে অংশ না নেয়া সিদ্ধান্ত সঠিক ছিলো কিনা সেটা ইতিহাসের সমীক্ষা ও বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা সিদ্ধান্ত নিবেন। ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক বাস্তব সম্মত ছিলো কিনা সেটা ক্ষমতাসীনদের বিরোধী পক্ষ এখন হারে হারে টের পাচ্ছে। দিনকে দিন এ জাতিকে সবাই আরো ভালভাবে চিনবে ও জানবে। কারণ গাদ্দার শব্দটা ভুলে গেলে চলবে না।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক : ভারত বাংলাদেশের বন্ধু না শত্রু এ নিয়ে অহেতুক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এদেশের জনগণই। সীমান্ত হত্যা, আমদানি, রপ্তানি নীতি, ক্রিকেট খেলার সময় বৈরিতা সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে মতানৈক্য, বাড়ছে অন্তর্দ্বন্দ্ব। তবে সে প্রভাব কি সরকারি ও বিরোধী দলগুলোকে প্রভাবিত করে ? মোটেই না। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো সবসময় তাদের সুবিধা নিয়ে ব্যস্ত।
ইতিহাস সত্য-মিথ্যা, পক্ষ-বিপক্ষ, আপাতদৃষ্টিতে সত্য, মনের বৈরিতা সবকিছুই পরম যত্নে আগলে রাখে। তবে আবহাওয়ার কারণে তা চাইলেও অনেক সময় প্রকাশ করা যায় না। আবার দেশের স্বার্থে অনেক কিছুই এড়িয়ে চলতে হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ নানা সংকটে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত পাশে দাড়িয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে ভারত সরকার আওয়ামী লীগের প্রতি দুর্বল ছিলো অথবা বিরোধী-দলের প্রতি বৈরী ছিলো এ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু ভারতীয়পণ্য বর্জনের আহ্বানের মধ্য দিয়ে সরকার বিরোধী শিবির কি বার্তা দিতে চেয়েছে? এই বর্জন কর্মসূচী কতটুকু জনস্বার্থে, কতটুকু নিছক ভারত বিরোধিতা- সে বিষয়টি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে বলে মনে হয়নি। অবশ্য এবিষয়ে রয়েছে ভিন্নমতও।
বাজার বাস্তবতা : উপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট এই জাতির জন্য ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের বাজারে না পাওয়া গেলে কোন দেশের পণ্য আমদানি করলে দেশবাসি সংকটাপন্ন হবে না সেটি বিরোধী পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়নি। ‘পণ্য বর্জনের’এই ঘোষণার পর সংগতকারণেই এই আশংকা তৈরী হয়েছিলো যে বাজার অস্থিতিশীল হবে। সুযোগ বুঝে কালোবাজারি বা অসাধূ ব্যবসায়ীরা কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি করে সাধারন মানুষের পকেট কাটবে। বাজারে কোনসংকট ছিলো না, একথা বললে ভুল হবে। তবে একশ্রেণির অসাধু চক্র কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছিলো, কথাও অস্বীকার করার উপায় নেই। আর যদি বাস্তবতার কথা বলি, তাহলে দারিদ্র্যে জর্জরিত সাধারণ মানুষ এই “বর্জন” কর্মসূচীকে পুরোপুরি সমর্থন করতে পারেনি, কেউবা সমর্থন করতে চায়নি। তবে হ্যা, নিত্য পণ্যের বাজারে জনভোগান্তি ছিলো চরমে।
একটা বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশের বাজারে যেসব ভারতীয় পণ্য বিক্রি হয় সেগুলো ভারত সরকার উৎপাদন করে না। ভারতের কৃষকদের একটা বড় অংশ নিত্য পণ্য উৎপাদন করে। ‘বর্জন’ কর্মসূচী ভারতের ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে নাকি পণ্য উৎপাদনকারী কৃষক কুল বা শ্রমিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সেটা ভেবে দেখার অবকাশ অবশ্যই ছিলো।
নতুন বিতর্কের জন্ম : মূলত ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক ভারত বিরোধীতারই বহিঃপ্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী পাকিস্তান আমলে ভারত নামক জুজুর ভয় দেখিয়ে পাকিস্তানীরা এই অঞ্চলের মানুষকে ভারত বিরোধী করার সকল প্রয়াস চালিয়েছে। পাকিস্তানীদের আস্ফালন চূর্ণ করে বাংলাদেশের মানুষ মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছে। তাছাড়া ভারতীয় হিন্দুদেরকে মোক্ষম ঢাল বানাতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি। কারণ এ অঞ্চলের মানুষ ছিলো হুজুগে বাঙালি, আবেগী মুসলমান। আর নামে মুসলিম হলেও ক’জনই বা ইসলামকে আকঁড়ে ধরেছে ?
মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে এদেশের সাধারণ মানুষ পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক করলেও স্মরণ অবশ্যই করে। বাংলাদেশকে শত্রু মুক্ত করতে হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্য এ দেশের মাটিতে যুদ্ধ করে। মুক্তি বাহিনী আর মিত্র বাহিনীর সদস্যদের সর্বাত্নক চেষ্টায় দেখা মেলে লাল সবুজের পতাকা। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ভারতের নানা কর্মকান্ড নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। তবে সে বিতর্ক পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
ভারতে বাংলাদেশি পর্যটক : ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাকের মধ্যেই আগমন ঘটে ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখ। গত ১০ এপ্রিল (বুধবার) থেকে ১৪ এপ্রিল (রবিবার) পর্যন্ত সরকারি ছুটিতে যশোরের বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত ভ্রমণে পাসপোর্টধারীদের চাপ ছিলো চোখে পড়ার মতো। চিকিৎসা, ব্যবসা, দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ ও স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে কেউ যাচ্ছেন ভারতে আবার অনেকে আসছেন বাংলাদেশে। তবে এই যাতায়াতের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা। এখন প্রশ্ন- ভারত বৈরিতায় সুফল আসলো না কেনো ?
এবছর পবিত্র ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ১০ এপ্রিল থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ছুটি ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার। বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানও সরকারি ছুটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বন্ধ দেয়। ফলে লম্বা ছুটি পেয়ে চিকিৎসা, ব্যবসা, দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ ও স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে অনেকে গিয়েছেন ভারতে আবার অনেকে আসেন বাংলাদেশে। এতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেড়েছে যাত্রীদের চাপ। যাত্রী নিরাপত্তায় বন্দরে কাজ করছে বিভিন্ন প্রশাসনিক দফতরের নিরাপত্তা কর্মীরা। মূলকথা- যোগাযোগ কমেনি, বরং ভারত প্রীতি বাড়ছেই।
সরজমিন প্রতিবেদন : ভারতগামী যাত্রীদের অনেকে বলেন, ভারত ভ্রমণে বাংলাদেশ সরকার নিচ্ছে ১ হাজার ৫৫ টাকা ভ্রমণ কর ও ভিসা ফি বাবদ ভারতীয় দূতাবাসগুলো নিচ্ছেন ৮৫০ টাকা। ভ্রমণের ক্ষেত্রে বছরে বছরে এ অর্থের পরিমাণ দুই দেশ বাড়ালেও সেবা বাড়ানোর দিকে তাদের নজর নেই। এতে নানান দুর্ভোগ সইতে হচ্ছে। সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে না পেরে ক্ষতির মুখে পড়ছেন পাসপোর্টধারীরা। তবে বাংলাদেশ অংশের কার্যক্রম কোনো রকমে শেষ হলেও ভারত অংশে জনবল সংকটে পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ। অর্থাৎ দুর্ভোগ, ভোগান্তি, বাড়তি খরচ সবকিছু মেনে নিয়েই চলছে ভারতে যাতায়াত, কেনাকাটা, ভ্রমণ।
এনামুল হক নামে একজন বলেন, “এদেশের অধিকাংশ পাবলিক হুজুগে মাতাল। মুখে লেকচার দিচ্ছে ভারতীয় পণ্য বয়কট করুন। অথচ এরাই ভারতে ঘুরতে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আবার কেউবা ডাক্তার দেখাতে বাধ্য হয়ে যাচ্ছেন ভারতে। কারণ আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো না৷ আর ঈদের কেনাকাটাতো দেখতেই পাচ্ছেন। মূলকথা ভারতীয় পণ্য বয়কট ওই ফেইসবুকেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবে না।”
বাস্তবতা কি বোঝায় ? প্রতিবেদনের স্বার্থে কথা হয় যশোরের বেনাপোল আমদানি-রফতানি সমিতির একজন দায়িত্বশীলের সঙ্গে। তিনি জানান, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় প্রতিবছর বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রায় ২০ লাখ পাসপোর্টধারী যাতায়াত করে থাকেন। ভ্রমণ কর বাবদ বাংলাদেশ সরকারের প্রায় ১০০ কোটি টাকা ও ভিসা ফি বাবদ ভারত সরকারের ১৫০ কোটি টাকা আয় হয়। তবে কাঙ্ক্ষিত সেবা বাড়েনি। অর্থাৎ সেবা বাড়েনি, কিন্তু ভ্রমণ কমেনি।
বাংলাদেশ ও ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থা দিনকে দিন সহজ হচ্ছে। তবে তাদের আচরণে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন হয়নি। ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ বৈরি আচরণ পেলেও মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ ভারতের ওপর ওতোপ্রোতভাবে নির্ভরশীল। সামান্য তিস্তা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ কতোটা নাজেহাল হচ্ছে- এটাই তার প্রমাণ।
এ যাবতকালে শুধুমাত্র বিএসএফের গুলিতেই মারা গিয়েছে অনেক বাংলাদেশি। বাদ যায়নি এদেশের সীমান্তরক্ষী সদস্যরাও। তবুও আমরা ভারতের ওপরই নির্ভরশীল। নানা দিক চিন্তা করে হয়তো দেশের স্বার্থেই বাংলাদেশ সরকার ভারতের সাথে একটি সুসম্পর্ক রাখতে চান। সেখানে কোনো মহল বা সাধারণ জনগণের ভারত বিরোধী আচরণ সরকারকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করবে না। বলতে অস্বস্তি বোধ হলেও যারা দেশপ্রেমের সজ্ঞাই জানে না। তারা কি করে দেশের পণ্য-স্বার্থ বিবেচনা করে ভারতীয় পণ্য বয়কট করবে ? যারা শুধুমাত্র ফেইসবুকে লম্বা বুলি আউড়ে সকালে গুম থেকে উঠে ভারতীয় পণ্য দিয়ে নাস্তা করে। তাদেরকে দিয়ে আর যাই হোক, ভারতীয় পণ্য বয়কট হবে না, সম্ভব না। তাই এদেশের সাধারণ জনগণকে বলির পাঠা বানিয়ে রাজনৈতিক মহলের স্বার্থ হাসিলের নাটক বন্ধ করার জোর দাবি তোলার এটাই সময়।