গণফোরামে অসন্তোষ

রাজধানী রাজনীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক : জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। দলটির নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীর অনুগত কয়েক নেতা মিলে দলের সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া ও যুগ্ম সম্পাদক মুশতাক আহমদকে সাময়িক বহিষ্কারের চিঠি দিয়েছেন। গণফোরামের প্রবাসীবিষয়ক সম্পাদক আবদুল হাছিব চৌধুরীর নামে চিঠিটি ইস্যু করা হয়েছে গত ২৮ জানুয়ারি। তবে দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, সাময়িক বহিষ্কারের চিঠিটি প্রকাশ্যে আসে মঙ্গলবার বিকালে। মতিঝিলে ইডেন বিল্ডিংয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নোটিশ বোর্ডে এই চিঠিটি সাঁটিয়ে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে গণফোরামের প্রবাসীবিষয়ক সম্পাদক আবদুল হাছিব চৌধুরী বলেন, গত ২৬ এপ্রিল বিশেষ কাউন্সিলের পর স্বৈরাচার এরশাদের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, এমন কয়েকজনকে কো-অপ্ট করে দলে নেওয়া হয়েছে। গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে এটা কেন করা হয়েছে, তা দেখিয়ে সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়া ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুশতাক আহমদকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে সেক্রেটারি হওয়ার পর থেকে কেন্দ্রীয় কমিটি, প্রেসিডিয়াম বা সম্পাদক পরিষদের কোনও বৈঠক ডাকতে পারেননি রেজা কিবরিয়া। গত ২৮ জানুয়ারি সম্পাদক পরিষদের বৈঠকেই তাদের দুজনকে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
প্রতিক্রিয়ায় গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি মহসিন রশিদ বলেন, আমরা ইতোমধ্যে জানতে পেরেছি, যারা এটা করেছেন তাদের কোনও গঠনতান্ত্রিক অধিকার নেই এ ধরনের চিঠি ইস্যু করার। আমরা দলের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবো।
গণফোরামের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলটির অভ্যন্তরীণ সংকট সৃষ্টি হয় গত বছরের ২৬ এপ্রিল বিশেষ কাউন্সিলের পর। ওই কাউন্সিলে সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়া সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী ও তার অনুগত কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বিষয়টিকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। এই অংশের নেতাদের ভাষ্য রেজা কিবরিয়া সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর কিছু নেতাকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে কো-অপ্ট করেছেন, যাদের অনেকেই বিগত দিনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। এতে করে দলের আদর্শিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, কী করা যাবে, এগুলো জানিও না। অভিযোগ আছে আপনিই এর নেপথ্যে আছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে সুব্রত চৌধুরী বলেন, এখানে আমার কী করার আছে। এটা সেক্রেটারির সঙ্গে প্রবলেম। বহুদিন ধরে তাকে বলা হচ্ছিল গঠনতন্ত্র ও সংবিধান মোতাবেক কাজ করেন। কিন্তু ৯-১০ মাস ধরেই তো তিনি উল্টাপাল্টা করছেন। যাই হোক, আমি জানি না এগুলো কতদূর যাবে।
রেজা কিবরিয়াবিরোধী অংশের নেতা লতিফুল বারী হামীম বলেন, দলে রাজনৈতিক বিভক্তির কারণে এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটছে। গণফোরামের রাজনৈতিক ধারার বাইরের লোকজন ও দলে পাকিস্তানপন্থী কিছু লোক, যারা একাত্তরকেও মানে না, আবার বঙ্গবন্ধুকেও মানে না- তারা দলকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করছে। আদর্শবিরোধী গ্রুপ কুক্ষিগত করতে চাচ্ছে। আশা করি, ড. কামাল হোসেন এই বিষয়গুলো বুঝে সঠিক পদক্ষেপ নেবেন।
যদিও রেজা কিবরিয়া ও পরে যুক্ত হওয়া নেতারা বলছেন, দল প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত যারাই সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন সুব্রত চৌধুরী ও তার অনুগতরা। সর্বশেষ ২০১১ সাল থেকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মোস্তফা মোহসীন মন্টু। তার বিরুদ্ধেও এই অংশটি সোচ্চার ছিল। এরআগে, সাইফুদ্দিন মানিকের বিরুদ্ধেও তারা তৎপর ছিলেন। দলের নেতারা জানান, ১৯৯২ সালে দল গঠনের পর থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি গণফোরামের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা হলেন প্রকৌশলী আবুল কাশেম, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবুল মুহিত।
গণফোরামের একাধিক প্রভাবশালী নেতা জানান, ১০ দিন আগে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে লতিফুল বারী হামীম, অ্যাডভোকেট হেলাল ও খান সিদ্দিককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন সাধারণ সম্পাদক রেজা কিবরিয়া। তারা শোকজের কোনও উত্তর দেননি।
সাময়িক বহিষ্কার হওয়া যুগ্ম সম্পাদক মুশতাক আহমদ বলেন, তাদের তিন জনকে নোটিশ দেওয়ার পর হাস্যকরভাবে ব্যাকডেট দেখিয়ে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। এ ধরনের চিঠি ইস্যু বা বৈঠক তো গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে। তাদের বৈঠকের বিষয়ে দলের সভাপতিই জানেন না। ইতোমধ্যে দলের সভাপতি ড. কামাল হোসেন এ বিষয়ে সেক্রেটারিকে নির্দেশনা দেওয়ার পরই তাদের (সুব্রত চৌধুরীর অনুগত গ্রুপ) বিরুদ্ধে শোকজ নোটিশ ইস্যু করা হয়। তারা ওইটার কোনও উত্তর দেননি।
মুশতাক আহমদ বলেন, এগুলো খুব ছোটখাটো ব্যাপার, দুই-তিন দিন প্রবলেম করবে, তারপর ঠিক হয়ে যাবে আশা করি।
নেতাদের কারও কারও দাবি, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর থেকে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দলের নেতাদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। কোনও কোনও নেতাকে বিভিন্ন কার্যক্রমে বেশি প্রাধান্য দেওয়ায় প্রতিপক্ষ গ্রুপ সক্রিয় হয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। আর রেজা কিবরিয়া পারিবারিক কারণে দেশের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। দলের একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, রেজা কিবরিয়া গত ৩১ জানুয়ারি সিঙ্গাপুর যান, সেখানে তার স্ত্রীর চিকিৎসা চলছে।
এর আগে, জানুয়ারিতে রেজা কিবরিয়াসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সিলেট, হবিগঞ্জসহ কয়েকটি জায়গায় গণফোরামের সভা অনুষ্ঠিত হয়, জানান নির্বাহী সভাপতি মহসিন রশিদ। উল্লেখ্য, মহসিন রশিদ দীর্ঘদিন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন।
দল ভাঙনের মুখে পড়লো কিনা, এমন প্রশ্নে গণফোরাম নেতা সুব্রত চৌধুরী বলেন, ভাঙনের মুখে পড়বে না। কিন্তু সমাধান করা দরকার। মিটিং-টিটিং তো ডাকা হয় না গত কয়েক মাস ধরে। পদায়ন, পদোন্নতি, নিয়োগ সমানে চালাইতেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, ভাবলাম অক্সফোর্ডের লোক, দলটাকে ভালোভাবে চালাবেন। কিন্তু কী থেকে কী হচ্ছে।
এদিকে, গণফোরামের কেন্দ্রীয় এক নেতা জানান, আজকালের মধ্যেই ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে সৃষ্ট সমস্যাগুলো নিয়ে বৈঠক হবে। এরপরই সাংগঠনিকভাবে নেতাদের বিরোধ সমাধানের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এই প্রক্রিয়ায় কেউ কেউ বহিষ্কার হতে পারেন, এমন আশঙ্কার কথাও জানালেন এই নেতা।


বিজ্ঞাপন
👁️ 20 News Views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *