নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের দুগ্ধ শিল্প বিকাশে সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে ঋণ সুবিধাসহ সম্প্রসারণ সেবা ও ন্যায্যমূল্যে বাজারে দুধ বিক্রি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন দুগ্ধ খামারিরা।
তাদের দাবি, দেশে পর্যাপ্ত চাহিদা থাকা সত্ত্বেও যথাযথ নীতিমালা ও সংশ্লিষ্ট পরিসেবার অভাবে এ শিল্পটির বৃদ্ধি ক্রমাগত ব্যাহত হচ্ছে।
বুধবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে অক্সফাম ও বাংলাদেশ ডেইরি ডেভেলপমেন্ট ফোরাম (বিডিডিএফ) আয়োজিত ‘প্রান্তিক দুগ্ধ খামারিদের বিকাশে সরকারি-বেসরকারি নীতিমালা ও সেবা : সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক জাতীয় সভায় তারা এ কথা বলেন।
সভায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু, নীলফামারী-১ আসনের সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকার, বিডিডিএফের সভাপতি অ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম স্মৃতি, এলডিডিপি প্রকল্প পরিচালক কাজী ওয়াছি উদ্দিন, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক আবদুল জব্বার শিকদার, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. নাথুরাম সরকার, দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (কর্পোরেট ফাইন্যান্স) উজমা চৌধুরী, ব্র্যাক ডেইরি পরিচালক আনিসুর রহমান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের যুগ্ম কমিশনার মাহফুজ আহমেদ, এসিআই’র এমডি ড. এফএইচ আনসারি, সাধারণ বীমা করপোরেশনের ম্যানেজার এম এ করিমসহ এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি এবং দেশের বিভিন্ন জেলার খামারিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় মূল নিবন্ধ পাঠ করেন বিডিডিএফের প্রচার সম্পাদক ও অক্সফামের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার মো. মুতাসীম বিল্লাহ।
তিনি বলেন, দেশে তরল দুধের উৎপাদন বিগত ১০ বছরে বেড়েছে চার গুণেরও বেশি। দেশে বর্তমানে বাণিজ্যিক খামারের সংখ্যা প্রায় এক লাখ এবং দুধের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৯৯ লাখ টন। উৎপাদনের এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে, যা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সক্ষম হবে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন অক্সফামের ইকোনমিক জাস্টিস ও রেসিলিয়েন্স প্রোগ্রাম ম্যানেজার ড. খালিদ হোসাইন। অনুষ্ঠানে প্রান্তিক নারী খামারিরা তাদের সমস্যা তুলে ধরেন।
কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার খামারি আমেনা বেগম বলেন, প্রান্তিক জনপদে পর্যাপ্ত চিলিং প্লান্ট না থাকায় উৎপাদিত দুধ প্রায় নষ্ট হচ্ছে। তিনি এ শিল্পে জড়িতদের জন্য চিলিং প্লান্ট স্থাপনসহ সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ঋণ সুবিধার দাবি জানান।
দেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের অন্যতম একটি সম্ভাবনাময় খাত ডেইরি শিল্প। বর্তমানে এ খাত বাণিজ্যিকভাবে সফল শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। দেশে বর্তমানে এক লাখেরও বেশি নিবন্ধিত খামারি রয়েছেন, যার প্রায় অর্ধেকই উচ্চশিক্ষিত যুবকদের উদ্যোগে পরিচালিত। গত এক দশকে দেশে উৎপাদিত দুধের পরিমাণ প্রায় সাড়ে চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে গবাদি পশুর মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় সাতগুণ। দেশে দুধের মোট চাহিদার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই এখন দেশীয় উদ্যোক্তারা সরবরাহ করছেন। এমন একটি সম্ভাবনাময় শিল্পখাত কেবল অসম অন্ধ নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে এ খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত কয়েক লাখ মানুষের ওপর।
অনুষ্ঠানে ডেইরি শিল্পে জড়িত উদ্যোক্তারা বলেন, দেশে আমদানিকৃত গুঁড়া দুধের সঙ্গে উৎপাদিত দুধের অসম প্রতিযোগিতা বন্ধে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাল্ক আকারে আমদানি করা গুঁড়া দুধের ওপর শুল্ক বৃদ্ধিতে সরকারের কাছে জোর দাবি জানানো হয়।
উন্নয়নের এ ধারা টেকসই ও মজবুত করতে সরকারের পাশাপাশি ডেইরি শিল্পসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যেমন- দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত ও বিপণনী প্রতিষ্ঠান, গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজননকারী প্রতিষ্ঠান, প্রাণিখাদ্য বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান, দুগ্ধ খামারি, বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংক, ব্যবসায়ী সংগঠন, গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংস্থার সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অক্সফাম চার দশক ধরে দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে আসছে। অক্সফাম বাংলাদেশের ডেইরি শিল্পের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে সংস্থাটি দেশের চরাঞ্চলের দুর্যোগপীড়িত খামারিদের নিয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের আওতায় দেশের উত্তরাঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত পাঁচ জেলায় (গাইবান্ধা, রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, জামালপুর) ক্ষুদ্র দুগ্ধ খামারিদের ঋণ সুবিধা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, বাজারে অভিগমন ও সম্প্রসারণ সেবা নিশ্চিতের মাধ্যমে প্রায় তিন হাজার খামারির জীবন মানোন্নয়নে কাজ করছে। ওই প্রকল্পে খামারিদের বিভিন্ন সফলতা, প্রতিবন্ধকতা ও শিক্ষণসমূহ সরকারি-বেসরকারি স্টেকহোল্ডারদের ডেইরি শিল্পের উন্নয়নে কাজ করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু বলেন, এ খাত এগিয়ে নিতে প্রান্তিক খামারিদের সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি চিকিৎসার ওপর নির্ভর না হয়ে খামার ব্যবস্থাপনার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। আগের তুলনায় এ খাত অনেক দূর এগিয়েছে। সামনে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। তাই নেতিবাচক প্রচারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ডেইরি খাতে উন্নয়নে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, এগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশ দুধে স্বংয়সম্পন্ন হবে।
দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট ফাইন্যান্স) উজমা চৌধুরী বলেন, আমরা যেখানে বাস করি সেটা হলো গ্লোবাল ভিলেজ। এখানে যদি আমরা দুধ উৎপাদন করি আর অন্য কোনো দেশে যদি তার চেয়ে কম টাকায় একই মানের দুধ পাওয়া যায় তাহলে সেই দুধ আমাদের এখানে কোনো না কোনোভাবে চলে আসবে-এটা স্বাভাবিক। এটা ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই। গ্লোবালাইজেশনের জন্য এটা হবে। এটাকে আমরা ঠেকাতে পারব না। কিন্তু আমাদের ডেইরি ক্ষেত্রটা রুরাল এবং ন্যাশনাল ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। এটাকে এগিয়ে নিতে দুটি দিক (কস্ট এবং কোয়ালিটি) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে ইমপোর্টেট পাউডার দুধ আসছে আমরা যদি সেই দুধের চেয়ে কম দামে দিতে পারি তাহলে আমাদের দেশে এটার চাহিদা বেড়ে যাবে। একজন জানান, ৩৩০ টাকা কেজি পড়ে ইমপোর্টেট দুধের দাম। আমাদের দেশে সেই দুধের দাম পড়ে ৪০০ টাকা। তাই আমাদের দাম ও কোয়ালিটি নিয়ে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের এ ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক লেয়ার আছে যেমন- খামারি আছেন, বিপণনকারী আছেন। এছাড়া যারা এ খাতকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে দুগ্ধ খামারিদের জন্য অনেকগুলো রেভোলেশন আছে, সেগুলো প্রসেসর বা খামারিরা একযোগে ব্যবহার করতে পারছে না। যদি আমরা একসঙ্গে ব্যবহার করতে না পারি তাহলে তা ন্যাশনাল সেন্টার উন্নয়ন লাভ করে না। বিষয়টির দিকে নজর রেখে আমাদের এমন সুবিধা দিতে হবে, যাতে আমরা একসঙ্গে সবাই মিলে লাভবান হতে পারি। আমাদের সবাইকে কোয়ালিটির দিকে নজর দিতে হবে নিজ নিজ জায়গা থেকে।