!! সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী হত্যা মামলায় আসামী ছিলেন !! নিজেকে জড়িয়েছিলেন অস্ত্র-মাদক ও সোনা চোরাচালানে !! ৫৬বিইউ ফ্লাটে নারীসহ ৩ জনের আড়াই ঘণ্টার গোপন মিশন !! বাংলাদেশ পুলিশের দেয়া তথ্যমতেই কলকাতার ফ্লাটে উদ্ধার অভিযান চালায় ভারত পুলিশ !!
নিজস্ব প্রতিবেদক : কলকাতায় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন রাঘব বোয়ালকে বিশেষ নজরদারিতে রেখেছে গোয়েন্দারা। দেশের সোনা চোরাচালান ও হুন্ডি চক্রের তারাই মূল হোতা। এ তিনজনের প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের সঙ্গে এমপি আনারের ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততার বিষয়ও গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
চিকিৎসার জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ হন এমপি আনার। বাংলাদেশের দর্শনা সীমান্ত দিয়ে গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য তিনি দেশ ত্যাগ করেন। ওই দিন বেলা ১১টার দিকে তিনি দর্শনা চেকপোস্ট পার হয়ে ভারতের গেদে স্টেশনে প্রবেশ করেন। সেখানে আনুষ্ঠানিকতা শেষে অল্প সময়ের মধ্যে একটি লাগেজ নিয়ে ওপারের একটি ইঞ্জিনচালিত রিকশায় রওনা হন।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বাস বিল্ডার্স এর দুলাল বিশ্বাস, বেনাপোলের এমপি আফিল উদ্দিন, সোনা কারবারি ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের দিলীপ কুমার আগরওয়ালা ও আনোয়ারুল আজিম এমপি মিলেমিশে স্বর্ণ ও হুন্ডির শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন বাংলাদেশে। প্রায় দেড় দশক ধরে তাদের সিন্ডিকেট বহাল রয়েছে দেশের হুন্ডি ও স্বর্ণ ব্যবসায়। এপার-ওপারের চোরাচালানকেন্দ্রিক বিরোধের জেরে এমপি আনার কোনো ফাঁদে পড়েছিলেন কিনা তা নিয়েও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত চলছে। খোজ নিয়ে জানা গেছে, এমপি আনার নিখোজ হওয়ার পর থেকেই হদিস মিলছে না দেশের দুই শীর্ষ ব্যবসায়ীর। তাদের একজন স্বর্ন ব্যবসায়ী, আরেকজন ডেভলপার ব্যাবসায়ী।
এদিকে ভারতের রাজ্য সরকারের শুল্ক দফতরের এক কর্মকর্তার কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন্সের ৫৬বিইউ ফ্ল্যাটেই এমপি আনারকে হত্যা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ভারতীয় গোয়েন্দারা। সেই ফ্ল্যাটেই গত ১৩ মে উঠেছিলেন এমপি আনার।
সূত্রে জানা যায়, দেশ থেকে যাওয়ার পর নিখোঁজের অভিযোগের পর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সন্দেহভাজন দুজনকে আটক করে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, এমপি আনারের মরদেহ আছে সঞ্জিভা গার্ডেনে। বাংলাদেশ পুলিশের তরফ থেকে কলকাতা পুলিশকে তথ্যটি দিলে বুধবার আনারের হত্যার আলামত পায় ভারত পুলিশ। তারা জানিয়েছে, সঞ্জিভা গার্ডেন্সই এমপি আনারের শেষ লোকেশন ছিল। এরপরই পুলিশের তদন্তকারী দল সেখানে যায় এবং সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখে। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এমপি আনার ওই ফ্লাটে একাই সেখানে গিয়েছিলেন। এরপরই ওই ফ্ল্যাটে ঢোকেন একজন নারীসহ পরপর তিনজন। এরপর প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর তিনজন বেড় হয়ে যায়। ভারতীয় গোয়েন্দারা ইতোমধ্যে কয়েকজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন বলেও জানা গেছে।
এমপি আনার খুন ও আরো কিছু অজানা কাহিনী : নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার আনোয়ারুল আজিম আনার এমপি দুনিয়া থেকে চিরতরে বিদায় নেয়ার পরেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, গত নির্বাচনে ঝিনাইদহ-১ আসনের এক প্রার্থীকে ভোটের ফলাফল উল্টে নিশ্চিত পাশ করিয়ে দিতে নাকি পাঁচ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন।
ওই সূত্রটি আরও জানায়, এমপি আনার বলেছিলেন, চুয়াডাঙ্গা জেলা রিটার্নিং অফিসার তার শ্বশুরালয়ের ঘনিষ্ঠ স্বজন। এছাড়া উপজেলা রিটার্নিং অফিসার, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবাইকে ম্যানেজ করে দিবেন। কিন্তু ধনাঢ্য ওই মাফিয়া প্রার্থীর ভরাডুবি হলে চরম ক্ষিপ্ত হন তিনি। পরবর্তীতে টাকাও ফেরত দিতে চেয়েছিলেন এমপি আজিম- কিন্তু রাজি হননি মাফিয়া। বরং চরম বদলা নিতেই বেশি উৎসাহী ছিলেন।
মওকা হিসেবে পেয়ে যান আনোয়ারুল আজিমের বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীনকে। তিনি জানান, আনারের সঙ্গে তার দুইশ‘ কোটি টাকার ঘাপলা রয়েছে। ফলে পরিকল্পনা হয়ে উঠে সোনায় সোহাগা। প্রথম বৈঠক বসে গুলশানে অভিজাত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের গুপ্ত কক্ষে। তবে গুপ্ত কক্ষটি ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ভেতরেই কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রথম বৈঠকটির পর চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এক বাসায়। বাস্তবায়ন ঘটে কোলকাতার নিউ টাউন থানার অভিজাত ‘সঞ্জীবনী গার্ডেনে’র আলোচিত ট্রিপ্লেক্স ফ্ল্যাটে।
জানা গেছে, ১৯৯১ সালে এমপি আনার ঝিনাইদহের চোরাকারবারি পরিতোষ ঠাকুরের সঙ্গে মিলে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়ান। স্বর্ণের বড় বড় চালান রাজধানী থেকে বাঘাডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী দেশে পাচার করতেন তারা।
এরপর ২০০৭ সালে চুয়াডাঙ্গার লোকনাথপুর এলাকা থেকে ১২ কেজি ৯৫০ গ্রাম স্বর্ণ আটক করে সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এই ঘটনায় চোরাকারবারিদের টার্গেট হন দর্শনা শ্যামপুরের সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম। এরপর টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন সাইফুল। সাইফুল হত্যা মামলায় এমপি আনারসহ আসামি করা হয় ২৫ জনকে।
এ মামলায় আনারকে গ্রেপ্তারে ২০০৯ সালে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন চুয়াডাঙ্গার বিশেষ আদালত। পরে ২০১২ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিতোষ, আনারসহ বেশ কয়েকজন মামলা থেকে অব্যাহতি পান।
স্থানীয় পর্যায়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ধীরে ধীরে আনারের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো কমতে থাকে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হলে ক্ষমতার দাপটে বেশিরভাগ মামলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেন আনার।
কে সেই আনার : এমপি আনারের মরদেহ উদ্ধারের পর থেকেই দেশজুড়ে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। রহস্য দেখা দিয়েছে তার মৃত্যু ঘিরেও। উঠছে নানা প্রশ্নও । তবে সব প্রশ্নের ভিড়ে একটি বিষয় সবাই জানতে চায়। কে এই এমপি আনার।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এক সময়ের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থিদের নিয়ন্ত্রণ করতেন আনার। অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য পাচারের হোতা হিসেবেও পুলিশের খাতায় নাম ছিল তার। ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড আসামিও ছিলেন এমপি আনার। ইন্টারপোলের ওয়ান্টেড আসামি হিসেবে পুলিশ একবার তাকে আটক করলেও তার ক্যাডাররা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে তাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল বলেও জানা গেছে। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যৌথ বাহিনীর অপারেশনের সময় আত্মগোপনে ছিলেন আনার।
আনারের বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি এবং চরমপন্থিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে ৯টির বেশি মামলা ছিল। আনার ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা তিনবার আওয়ামী লীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হন।