নিজস্ব প্রতিবেদক : ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৪৭ তম অধিবেশনে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মাদকের অপব্যবহার রোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং মাদকাসক্তির চিকিৎসার বিষয়ে সর্বসাধারণকে অবহিত ও উদ্ধুদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর জাতিসংঘ ঘোষিত ‘মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস’ বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।
মাদকের করাল গ্রাস থেকে বিশ্ববাসীকে রক্ষা করার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং মাদকের ভয়াবহতার মর্মস্পর্শী ও করুণচিত্র বিশ্বের সর্বস্তরের জনগণের সামনে তুলে ধরার মাধ্যমে মাদক বিরোধী ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাই এ দিবস পালনের মূল লক্ষ্য। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও প্রতি বছর দিবসটি সরকারী ঊদ্যোগে পালিত হয়ে আসছে ।
জাতিসংঘের অংগ সংস্থা The United Nations Office on Drugs and Crime (UNODC) প্রতিবছর দিবসটি উপলক্ষ্যে প্রতিপাদ্য (Theme) এবং লোগো নির্ধারণ করে থাকে। এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছেঃ“The Evidence is clear:Invest in Prevention”. যার বাংলা ভাবানুবাদ হচ্ছে : মাদকের আগ্রাসন দৃশ্যমান, প্রতিরোধেই সমাধান।
দিবসটি উপলক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগে আজ রবিবার ১৪ জুলাই, সকাল ৮ টায় রমনা পার্কের “দক্ষিণ” পূর্ব পার্শ্বে (স্টার গেট এর সামনে) মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। সকাল ১০ টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল থিয়েটার হলে আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান এমপি, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেনজীর আহমদ এমপি, এবং সুরক্ষা সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোঃ মশিউর রহমান এনডিসি এবং সভাপতিত্ব করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান, এনডিসি।
প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে কোন মাদক উৎপন্ন হয়না। কিন্তু ভৌগোলিকভাবে বিশ্বের দুটি বৃহৎ মাদক বলয় গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল ও গোল্ডেন ক্রিসেন্ট এর মধ্যবর্তী স্থানে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ায় তাদের প্রভাবে বাংলাদেশে অবৈধ মাদকদ্রব্যের প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এসব মাদকদ্রব্য মাদক চোরাকারবারীদের মাধ্যমে দেশে অনুপ্রবেশ করছে এবং এর ফলে সমাজের একটি অংশ বিশেষ করে যুব সমাজ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর নজরদারি ও মাদকবিরোধী প্রচারণা কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বর্তমানে মাদক পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সারাদেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একযোগে ‘ মাদককে না বলুন” কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে।
এতে করে শির্ক্ষাথীদের মাঝে মাদকবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠবে।তিনি বলেন, বর্তমান সরকার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে যুগোপগোগী করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। জনবল ও লজিস্টিক সুবিধাদি বৃদ্ধি করা হয়েছে। নোডাল এজেন্সি হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা ও কর্মসম্পাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মর্ডানাইজেশন অব ডিএনসি গ্রহণ করা হয়েছে ও লজিস্টিকস সুবিধাদি বৃদ্ধি করা হয়েছে। তিনি সকলকে মাদকের বিরুদ্ধে সমবেত হয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির মাননীয় সভাপতি বলেন, মাদকের ছোবল থেকে তরুণ ও যুব সমাজকে রক্ষা করতে বর্তমান সরকার নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
মাদকাসক্তদের সুচিকিৎসা ও তাদের পুনর্বাসনের বিষয়েও সমানভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। গত অর্থবছরে ১৩০ টি বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রকে অনুদান প্রদান করা হয়েছে। মাদক অপরাধ দমনে এ সংক্রান্ত আইন যুগোপযোগী করা হয়েছে এবং মাদক অপরাধীদের বিরুদ্ধে এ আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ নিশ্চিত করা হয়েছে। নোডাল এজেন্সি হিসেবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাজে আরও গতিশীলতা আনয়নের জন্য অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করা হয়েছে।এছাড়া তিনি দেশের যুব সমাজকে মাদকের নীল দংশন থেকে রক্ষা করে মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে সরকারি, বেসরকারি, সকল সংস্থা এবং এনজিও ,স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে একযোগে কাজ করার আহবান জানান।বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সুরক্ষা সেবা বিভাগের সম্মানিত সিনিয়র সচিব সচিব মহোদয় বলেন, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচাররোধে বর্তমান সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
তাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা ঘোষণা করেছেন। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে মাদকের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্তকরণ এবং ইতোমধ্যে গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে এ শূন্য সহিষ্ণুতার প্রতিফলন ঘটছে। মাদকাসক্তদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকারি খরচে মাদকাসক্তদের উন্নত ও যুগোপযোগী চিকিৎসা প্রদানের জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণ প্রকল্পর পাশাপাশি প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে প্রাথমিক পর্যায়ে ০৯ টি জেলায় সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বর্তমান সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান।
সভাপতির বক্তব্যে মহাপরিচালক বলেন, আমাদের দেশকে একটি আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে প্রয়োজন সুস্থ, শিক্ষিত, মেধাবী ও কর্মক্ষম জনশক্তি।কিন্তু মাদকের হিংস্র থাবায় এই জনশক্তির উল্লেখযোগ্য একটি অংশ আজ মাদকাসক্ত।
মাদকাসক্তদের সুচিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহিত করে থাকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। মাদকাসক্তদের চিকিৎসার সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকা জরুরি বিবেচনায় জাতীয় গাইডলাইন চূড়ান্ত করা হয়েছে।গাইডলাইনটির আলোকে দেশে মাদকাসক্তদের চিকিৎসার নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে ।
অপরদিকে মাদকদ্রব্যের ক্ষতি হ্রাসের লক্ষ্যে পরিচালিত মাদকবিরোধী অভিযানে প্রায়শই অপরাধীদের মধ্যে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়। এসকল অপরাধীদের মোকাবেলায় তিনি অধিদপ্তরের অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।পরিশেষে এ সামাজিক আন্দোলনে সমাজের সকল শ্রেণি পেশার মানুষ বিশেষ করে জনপ্রতিনিধি, এনজিও প্রতিনিধি এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদেরকে এগিয়ে আসার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানান।
দিবসটি উপলক্ষ্যে সারা দেশে শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণে মাদকবিরোধী রচনা ও চিত্রাংকন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। উক্ত অনুষ্ঠানে এসব প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ২১ জন ছাত্র-ছাত্রীকে পুরস্কৃত করা হয়।
দিবসটি উপলক্ষ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাণী সম্বলিত জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র এবং অধিদপ্তরের কাযর্ক্রম নিয়ে স্যুভেনির ও বার্ষিক ড্রাগ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্যুভেনির ও বার্ষিক ড্রাগ রিপোর্ট এর মোড়ক উম্মোচন করেন। এছাড়া বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে মাদক সচেতনতা বৃদ্ধি বিষয়ক অধিদপ্তরের প্রস্তুতকৃত থিম সং প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
অপরদিকে মাদকবিরোধী স্লোগান ও দিবসের প্রতিপাদ্য লেখা ফেস্টুন, বিলবোর্ড দিয়ে ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপগুলো সুসজ্জিত করা হয়েছে। দেশের সকল সরকারি ও লাইসেন্স প্রাপ্ত বেসরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসাধীন রোগীদের জন্য উন্নত মানের খাবার পরিবেশন করা হয়েছে।এছাড়া বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পালিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মাদকবিরোধী র্যালি, আলোচনা সভা, চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন জনবহুল স্থানে মাদকবিরোধী লিফলেট ও স্টিকার বিতরণ, মাদকবিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও গুরত্বপূর্ণ স্থানে মাদকবিরোধী শর্টফিল্ম প্রদর্শন ইত্যাদি।