# পিপিআর-২০০৮এরবিধি ১৭(১) এবং সাব ডেলিগেশন লঙ্ঘন করে ১২৮১,৯৬,৪৫,৫৬৭ টাকার অনিয়ম # কাজ না করে বিল তোলা, হাতে লেখা রশিদের মাধ্যমে ১২১,৩৯,৮০,৩২৯ টাকার অনিয়ম # প্রয়োজন ছাড়াই এলটিএম করে ২৮,৯৩,৪০,৮১১ টাকার অনিয়ম # লিকুয়েডেট ড্যামেজ আদায় না করে ৯,০২,৩৮,৪৯৯ টাকার আর্থিক ক্ষতি।ইজারাজনিত বকেয় আদায় না করে ৬৬,৮২,০০,০০০ টাকার রাজস্ব ক্ষতি # আপত্তিকৃত অর্থ আদায় করে কোষাগারে জমা ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার সুপারিশ #
বিশেষ প্রতিবেদক : গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কাজে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি অডিট আপত্তি উঠেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই কাজগুলো বাস্তবায়নকারী সংস্থা গণপূর্ত অধিদপ্তর। পূর্ত অডিট অধিদপ্তরের অডিটে এই বিপুল অনিয়ম ধরা পড়ে। এতে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ১ হাজার ৫৪৯ কোটি ৯৯ লাখ ৫৫৪ টাকার অডিট আপত্তি এসেছে।
অডিট রিপোর্টে যেসব অনিয়ম উঠে এসেছে : বিল অব কোয়ান্টিটিতে (বিওকিউ) উল্লিখিত পরিমাণ অপেক্ষা বিলে অতিরিক্ত পরিমাণ রেকর্ড করে বিল পরিশোধ করায় ৬ কোট ৬৩ লাখ ৬৫ হাজার ৮৫১ টাকা আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। এটা পিপিআর-২০০৮ এর ধারা ১২৭ (২) লঙ্ঘন বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। ভেরিয়েশনের ক্ষেত্রে থার্ড পার্টি এক্সপার্ট অপনিয়ন না নেওয়ায় ৩৬ লাখ ৯৩ হাজার ১০৫ টাকা সরকারের অনিয়মিত ব্যয় করা হয়েছে। এটি মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের স্মারক নং-৩০, ২৫ জানুয়ারি ২০২১ এর লঙ্ঘন।
চুক্তিমূল্যের উপর বীমা না করায় বীমা প্রিমিয়ামের উপর ভ্যাট বাবদ সরকারের ৪১ লাখ ৩১ হাজার ৫৫৭ টাকা রাজস্ব ক্ষতি করা হয়েছে। এটি চুক্তি শর্ত এবং পিপিআর-২০০৮ এর বিধি ৪(৩)(ট) এর লঙ্ঘন। বিশেষ প্রকৃতির কাজ না হওয়া সত্ত্বেও এলটিএম পদ্ধতিতে দরপত্র আহবানপূর্বক কাজ করে ২৮ কোটি ৯৩ লাখ ৪০ হাজার ৮১১ টাকা অনিয়মিতভাবে ব্যয় করা হয়েছে। এটি পিপিআর-২০০৮ এর বিধি ৬১(১)(ক) এর লঙ্ঘন।
নির্ধারিত হারে আয়কর কর্তন না করায় সরকারের ৭৯ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯১ টাকা রাজস্ব ক্ষতি করা হয়েছে। এটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এসআরও নম্বর-১৭৩ এবং আয়কর পরিপত্রের নির্দেশনা লঙ্ঘন।
নির্ধারত হার অপেক্ষা কম হারে ভ্যাট কর্তন করায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ৯৮ লাখ ৭৪ হাজার ৯১১ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এটি এনবিআরের জারীকৃত এসআরও এর লঙ্ঘন। কাজ করার আগে অলীক ব্যয় দেখিয়ে হাতে লেখা রশিদের মাধ্যমে অনিয়মিতভাবে ১২১ কোটি ৩৯ লাখ ৮০ হাজার ৩২৯ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে।
এটি ট্রেজারি রুলের সাবসিডিয়ারি রুল (এসআর) ২৪৯ ও ৪২৯ লঙ্ঘন। ভেরিয়েশন অনুমোদনের আগেই ঠিকাদারকে অনিয়মিতভাবে ৪ কোটি ৮৫ লাখ ৬২ হাজার ১১৯ কোটি টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এটি পিপিআর-২০০৮ এর বিধি-৭৯(১ (২) এবং জি.এফ. আর-১০ এর লঙ্ঘন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের অনুমোদন ছাড়া এক অর্থ বছরের বিল অন্য অর্থ বছরে অনিয়মিতভাবে পরিশোধ করা হয়েছে ২৮ লাখ ৬৭ হাজার ৯৩০ টাকা।
এটি অর্থবিভাগ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অনুবিভাগের স্মারকের লঙ্ঘন। বাস্তবে কাজ না করা সত্ত্বেও কার্য করা হয়েছে দেখিয়ে বিল পরিশোধে আর্থিক ক্ষতি ৯৮ লাখ ১৬ হাজার ৩৬৪ টাকা। এটি জি.এফ.আর-১০ এর লঙ্ঘন। দাবিবিহীন জামানত তামাদি ঘোষণা করে সরকারের কোষাগারে জমা না করায় ২ কোটি ৭১ লাখ ৭১ হাজার ৫১৭ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
এটি সিপিডব্লিউ এ কোড-৩৯৯, ৪০০ ও ৪০৩ এর লঙ্ঘন। নির্ধারিত সময়ে কার্য সম্পাদনে বার্থ ঠিকাদারের কাছ থেকে লিুকুইডেটেড ড্যামেজ (এলডি) আদায় না করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২ কোটি ৯৮ লাখ ৩৮ হাজার ৪৯৯ টাকা। এটি চুক্তির শর্তের জিসিসি-৭৩ ও ৭৩.১ এবং পিপিআর-২০০৮ এর বিধি ৩৯ (২৭ ও ২৮) এর লঙ্ঘন। অর্থ বছর শেষে তামাদি এড়ানোর লক্ষ্যে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধের নামে ১৬ কোটি ২৫ লাখ ২২ হাজার ৯৩৮ টাকা অতিরিক্ত জামান কাটা হয়েছে। এটি পিপিআর/২৮ এর বিধি-২৮ (১) এর লঙ্ঘন।
পিপিআর-২০০৮ এর বিধি এবং গণপূর্ত অধিদপ্তরে সাব-ডেলিগেশন অনুযায়ী উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা পরিহারের উদ্দেশ্যে একই কাজকে খন্ড খন্ড করে ১ হাজার ২৮১ কোটি ৯৬ লাখ ৪৫ হাজার ৫৬৭ টাকা মূল্যের প্রাক্কলন অনিয়মিতভাবে অনুমোদন করা হয়েছে। এটি পিপিআর-২০০৮ এর বিধি-১৭ (১) এবং গণপূর্ত অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রকৌশলীদের আর্থিক ক্ষমতার সাব ডেলিগেশনের লঙ্ঘন বলে অডিট রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। পিপিআর-২০০৮ বিধিমালা উপেক্ষা করে আরএফকিউ পদ্ধতিতে বাৎসরিক সিলিং সীমার অতিরিক্ত ৬০ লাখ ৬৬ হাজার ৫১৪ টাকা অনিয়মিতভাবে ব্যয় করা হয়েছে।
এটি পিপিআর-২০০৮ এর বিধি-৬৯ এর উপ বিধি-১ এর লঙ্ঘন। ডিপিপি/আরডিপিপি’র অঙ্গভিত্তিক মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কার্যাদেশ প্রদানপূর্বক অনিয়মিতভাবে ৩ কোটি ৯০ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
এ সম্পর্কে নিরীক্ষা মন্তব্য হলো-একনেক অনুমোদিত ডিপিপিতে/আডিপিতে সংস্থানকৃত মূল্যের অতিরিক্ত মূল্যে চুক্তি সম্পাদন করে অনিয়মিতভাবে ব্যয় করা হয়েছে। যানবাহন মেরামতে বাৎসরিক সিলিং অতিক্রম করায় সরকারের ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৯৫৮ টাকার আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে।
এটি ডেলিগেশন অব ফিন্যান্সিয়াল পাওয়ারের ক্রমিক নং-১০ (ক) এর লঙ্ঘন। বরাদ্দপত্র ছাড়া চুক্তি সম্পাদনের ফলে অনিয়মিতভাবে ৭৯ লাখ ৪ হাজার ৪১৪ টাকার দায়-দেনা সৃষ্টি করা হয়েছে। এটি সিপিডব্লিউ-এ কোড এর প্যারা-৩২ এবং পিপিএ-২০০৬ এর ধারা-১১(২) এর লঙ্ঘন।ক্রয়কৃত মালামালের স্টক এন্ট্রি রেজিস্টার, বিতরণ রেজিস্টার এবং ডেড স্টক রেজিস্টার সংরক্ষণ ছাড়া অনিয়মিতভাবে ১ কোটি ১২ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
এ সম্পর্কে অডিট রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘ক্রয়কৃত মালামালসমূহ স্টক এন্ট্রি রেজিস্টারভূক্ত করা হয়নি এবং রিপ্লেসমেন্ট কাজ হতে প্রাপ্ত পুরাতন মালামালের কোনো হিসাব সংরক্ষণ করা হয়নি।
’বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের ইজারাজনিত বকেয়া আদায় না করায় ৬৬ কোটি ৮২ লাখ টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। এটি ইজারার শর্তাবলীর ৪৬ নং অনুচ্ছেদ ও চুুক্তির টার্মস অব রেফারেন্স ২৭ (এ) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন।সেফটি ক্যানোপি ব্যবহার না করা সত্ত্বেও ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করায় সরকারের ২৫ লাখ ৮২ হাজার ৬১১ টাকার আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। এটি জিএফআর ১ম খন্ডের প্যারা-১০ এর লঙ্ঘন। পরিত্যক্ত বাড়ি হতে ভাড়া কম আদায়ে সরকারের ১১ লাখ ৩৫ হাজার ১৫৯ টাকার আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে।এটি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও সরকারি আবাসন পরিদপ্তরের দুটি স্মারকের লঙ্ঘন।
আর্থিক ক্ষমতা বহির্ভূত ২ কোটি ৪ লাখ ১ হাজার ৮৯৬ টাকার প্রাক্কলন অনিয়মিতভাবে অনুমোদন করা হয়েছে। এটি প্রধান প্রকৌশলী কার্যালয়ের ২০১৯ সালের ২০ মে তারিখের একটি স্মারকের লঙ্ঘন। সুনির্দিষ্ট স্থাপনা/বাসা উল্লেখ না করে ফ্যান সরবরাহের নামে ঠিকাদারকে ১১ লাখ ৯৯ হাজার ৭৩০ টাকার বিল পরিশোধে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।এটি জিএফআর ১ম খন্ডের প্যারা-১০ এর লঙ্ঘন। মেরামত কাজের অর্থ দ্বারা অরিজিনাল ওয়ার্ক সম্পাদন দেখিয়ে সরকারের ৪৫ লাখ ৪৭ হাজার টাকা অনিয়মিতভাবে ব্যয় করা হয়েছে।
এটি জিএফআর এর ২৩ এর বিধি লঙ্ঘন। বৈদ্যুতিক কাজের নকশা ছাড়াই অনাবশ্যকভাবে অতিরিক্ত এসটি ক্যাবলের ব্যবহার সম্বলিত ভেরিয়েশন অনুমোদনের সুপারিশ করায় সরকারের ৪ লাখ ৩১ হাজার টাকা আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। এটি সিডিডব্লিউ ডি কোডের ৮১ এবং ৮৩ নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক অনুমোদিত ড্রয়িং, ডিজাইনের ভিত্তিতে প্রাক্কলন তৈরি করতে হবে বলে অডিট রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। অডিট রিপোর্টে উল্লিখিত অনিয়মের বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে।আপত্তিকৃত অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা প্রদানের প্রমাণসহ লিখিত ব্যাখ্যা অডিট অফিসে প্রেরণ করতে বলা হয়েছে। এছাড়াও জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও অডিট রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে গণপূর্ত অধিপ্তরের মনিটরিং ও অডিট সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সাইদ মাহবুব মোরশেদ বলেন, ‘এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। অডিট আপত্তি উঠে সেগুলোর জবাব দেওয়া হয়। জবাবে সন্তুষ্ট না হলে আবার আপত্তি আসে। আবার আমরা জবাব দেই। আমাদের কাজ হলো মাঠ পর্যায়ের জবাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এবং মন্ত্রণালয়ের চিঠি মাঠপর্যায়ে পৌছেনো।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অডিট আপত্তি উঠলে সেটার জবাব দেওয়া এবং নিস্পত্তি হতে অনেক সময় লাগে। এমনও নজির আছে ৩০ বছর আগের অডিট আপত্তির এখনো নিস্পত্তি হয়নি। এখনও পর্যস্ত প্রায় সাড়ে ৭ হাজার অডিট আপত্তি রয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তরের বিভিন্ন কাজের। এসব আপত্তির ক্ষেত্রে শাস্তি হয়েছে এমন নজিরও দৃশ্যমান নয়। অথচ পূর্ত অডিট অধিদপ্তর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, অডিট আপত্তি দেওয়ার পর ২০ কার্যদিবসের মধ্যে আপত্তি নিষ্পত্তি জন্য জবাব দিতে বলা হয়। ২০ কার্যদিবসে আপত্তি নিষ্পত্তি না করলে আরো ৭ কার্যদিবস সময় দেওয়া হয়। সেই সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য জবাব না দিলে সেটা সংসদীয় কমিটিতে প্রেরণ করা হয়। গণপূর্ত অধিদপ্তরের এই অডিট আপত্তিগুলো সময়মতো নিষ্পত্তি না করায় এখন সংসদীয় কমিটিতে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।