নিজস্ব প্রতিবেদক : গনঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার জনপ্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছে। দলীয়করণের বৃত্ত ভেঙে পেশাদার ও জনবান্ধব প্রশাসন গড়তে চাচ্ছে তারা। এ প্রক্রিয়ায় সচিব থেকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, সংস্থা ও প্রকল্পের পরিচালক পদে আনা হচ্ছে পরিবর্তন।
এ নিয়ে সচিবালয়ে চলছে তোলপাড়। শুধু বুধবারই জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিব পদমর্যাদার ১১ জনের চুক্তি বাতিল হয়েছে। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে এক সচিবকে। আর দপ্তর বদলেছে অন্তত তিন সচিবের। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ সব পদে রদবদলের তৎপরতা শুরু হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, দুর্নীতিমুক্ত ও ক্লিন ইমেজের কর্মকর্তাদের ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন দক্ষ, যোগ্য ও জ্যেষ্ঠতার পাশাপাশি বিগত দিনে পদোন্নতি বঞ্চিতরা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুরুত্বহীন পদে পদায়ন পাওয়াদেরও আনা হবে দায়িত্বশীল পদে। অতীতে দলের পক্ষ নিয়ে গণবিরোধী অবস্থান, প্রশ্নবিদ্ধ ও কারচুপির নির্বাচন আয়োজনে সরাসরি সম্পৃক্ত, বিরোধী মত দমন ও মিথ্যা মামলা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারকে জনপ্রশাসনের এসব বিষয় দেখভালের জন্য বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
১১ জনের চুক্তি বাতিল, অবসরে এক সচিব গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাংগীর আলমকে ‘জনস্বার্থে’ বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর তথ্য জানানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অধীনে থাকা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। এ ছাড়া গত ৭ জানুয়ারির একতরফা ডামি নির্বাচনের সময় জাহাংগীর আলম ছিলেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিবের দায়িত্বে। তিনি বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তা।
গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পৃথক আদেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার ১১ সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। গত ৭ জানুয়ারি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের চুক্তির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়। মেয়াদের দেড় বছর বাকি থাকতেই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হলো। চুক্তি বাতিল হওয়া অন্য কর্মকর্তারা হলেন– প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক (জ্যেষ্ঠ সচিব) আখতার হোসেন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব কে এম আব্দুস সালাম, পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিৎ কর্মকার, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী, রেলপথ মন্ত্রণালয় সচিব হুমায়ুন কবীর, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব আলী হোসেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার ও বিডার নির্বাহী সদস্য (সচিব) মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। রাতে আরেক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক নিয়োগ পেয়েছেন ইউনূস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক লামিয়া মোরশেদ।
নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার চুক্তি বাতিল করে। গতকাল ১১ জনকে বাতিল করার পরও এ মুহূর্তে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সচিব ও একই পদমর্যাদার অন্তত ৯ কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক আছেন। তাদের বেশির ভাগের চুক্তি বাতিল করা হতে পারে বলে জানা গেছে। প্রশাসনে শেখ হাসিনা সরকারের আস্থাভাজন বলে পরিচিতদের ওএসডি করা হতে পারে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে বদলি করে কম গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে পাঠানো হতে পারে অনেককে।
জননিরাপত্তা ও কৃষিতে নতুন সচিব : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব পদে নিয়োগ পেয়েছেন বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) মোকাব্বির হোসেন। আর কৃষি সচিব হয়েছেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্বে থাকা ওয়াহিদা আক্তারের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ওয়াহিদা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সচিব ছিলেন। আজকালের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব ও উপদেষ্টাদের একান্ত সচিব (পিএস) নিয়োগ হতে পারে বলে জানা গেছে।
তালিকা হচ্ছে দলবাজ ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার : সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৬ বছর প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজেদের লোক নিয়োগ ও পদায়ন করেছে। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও একই নীতি অনুসরণ করেছে তারা। এজন্য নতুন সরকার সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং যুগ্ম সচিবদের বদলি, ইনহাউস বদলি ও প্রয়োজনে ওএসডি করবে বলে জানা গেছে। নিয়োগ বাতিল হবে প্রকল্প পরিচালকদেরও।
সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রশাসনের চিহ্নিত দলবাজ ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার তালিকা ব্যাচভিত্তিক তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। প্রতিটি ব্যাচের পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে প্রাথমিক তালিকা তৈরির কাজ বেশ এগিয়ে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। তালিকার পর কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করা হবে। যারা সরকারি বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির সহযোগী, টিআর, কাবিখাসহ সরকারি নানা রকম বরাদ্দ ও কেনাকাটা প্রক্রিয়ায় লুটপাটে জড়িত ছিলেন, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।
মাঠ প্রশাসনেও আসবে পরিবর্তন : পরিবর্তন আসছে মাঠ প্রশাসনেও। বিশেষ করে ‘দলকানা’ বিভাগীয় কমিশনার, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। বর্তমানে বিভাগীয় কমিশনার পদে ঢাকা ও খুলনার বিভাগীয় কমিশনার ১৫তম ব্যাচের এবং বাকিগুলোতে ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া জেলা প্রশাসক পদে বর্তমানে বিসিএস ২৪, ২৫ ও ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার গণমাধ্যমে বলেন, ‘দক্ষ ও জনবান্ধব প্রশাসন গড়তে নতুন সরকারের প্রচেষ্টা চোখে পড়ার মতো। সরকারকে প্রশাসনের মেধাবী, সৎ ও পেশাদার কর্মকর্তাকে বাছাই করে কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি দলবাজ কর্মকর্তাদের বাদ দিতে হবে। প্রয়োজনে আউটসোর্সিং থেকে অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মকর্তা নিতে হবে। কর্মঠ অনেকে অবসরে আছেন, তাদেরও কাজে লাগানো যেতে পারে।’