!! অবৈধপথে আয় করেছেন শতকোটি টাকা !!  দুদকে হাইভোল্টেজ তদবীর !! গোপালগঞ্জের গিয়াস উদ্দিন নৌ-অধিদপ্তরের সিএনএস পদে এখনো বহাল তবিয়তে!

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী

বিশেষ প্রতিবেদক :  পৈতৃকনিবাস গোপালগঞ্জের মকসুদপুর উপজেলায়। চাকরিও পেয়েছেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সদ্যবিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। এ দুই কারণে কর্মস্থলে প্রচন্ড প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে লাগামহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে মালিক হন বিপুল বিত্ত-বৈভবের। প্রভাবশালী এই কর্মকর্তা হলেন নৌ যোগাযোগ সেক্টরের (অভ্যন্তরীণ ও সমুদ্রগামী) নিয়ন্ত্রক সংস্থা নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (চলতি দায়িত্বে) গিয়াসউদ্দিন আহমেদ।


বিজ্ঞাপন

তিনি নিয়োগ পেয়েছিলেন নটিক্যাল সার্ভেয়ার পদে। পরবর্তী সময়ে চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ারের (সিএনএস) চলতি দায়িত্বে আসীন হন। তবে গোপালগঞ্জে বাড়ি ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চাকরি পাওয়ার সুবাদে তার মাথার ওপর নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের বড়কর্তাদের আশির্বাদের হাত থাকলেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একেবারে নীরব থাকেনি। যদিও গিয়াসউদ্দিনের অদৃশ্য ক্ষমতা এবং কালো টাকার প্রভাবে এখনো তাকে আইনের বেড়াজালে শক্তভাবে আটকাতে পারেনি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম মেরিন ফিশারিজ একাডেমিতে শিক্ষাজীবন শেষ করার পর সমুদ্রগামী জাহাজে চাকরি নেন। তার ধারাবাহিক অব্যাহতিপত্র (সিডিসি) নং সিও-৩৯৬৯। দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকটি জাহাজে চাকরির পর বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০১২ সালে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরে নটিক্যাল সার্ভেয়ার পদে যোগ দেন। গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, পিএসসি পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর গিয়াসউদ্দিন সেখানে যে আবেদন করেন, সে আবেদনপত্র এবং আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারি চালানে তার যে স্বাক্ষর ছিল সেটি জাল। কারণ ওই সময় তিনি জাহাজে কর্মরত ছিলেন এবং জাহাজটি বিদেশি একটি সমুদ্রবন্দরে অবস্থান করছিল।


বিজ্ঞাপন

গিয়াসউদ্দিনের একাধিক সহকর্মীসহ অধিদপ্তরের বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সরকারি চাকরিতে যোগদানের পরই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। জড়িয়ে পড়েন নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে। গোপালঞ্জে বাড়ি এই সুবাদে নৌ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও তাকে সমীহ করতেন। তবে জনশ্রুতি আছে, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের টাকা দিয়েই তাদের সবসময়ে বশে রেখেছেন তিনি। গিয়াসউদ্দিনের অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ এবং বিভিন্নজনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। উপ-পরিচালক শাহিন আরা মমতাজকে (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করে সংস্থাটি। অনুসন্ধানের একপর্যায়ে গিয়াস ও তার স্ত্রী-সন্তানদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব তলব করেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। এরপরই ‘থলের বিড়াল’ বেরিয়ে আসতে থাকে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গিয়াসউদ্দিন দুদকে যে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেছেন, তাতে নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। অবৈধ সম্পদ বৈধ দেখানোর জন্য মিথ্যা তথ্যসহ অনেক জাল কাগজপত্র জমা দিয়েছেন তিনি। গিয়াসউদ্দিন নৌ অধিদপ্তরে যোগদানের আগে যেসব বিদেশি জাহাজে চাকরি করেছেন, সেসব শিপিং লাইন্সের (নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান) প্রত্যায়নপত্র, কর্মকাল ও প্রাপ্ত বেতন-ভাতাদির ফিরিস্তি জমা দিয়েছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা শাহীন আরা মমতাজের কাছে। তবে সেসব তথ্যের অনেকগুলোই বাস্তবতা বিবর্জিত। গিয়াসউদ্দিন এ ক্ষেত্রে ব্যাপক মিথ্যা ও জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। এমনকি যে প্রতিষ্ঠানে তিনি কখনো চাকরি করেননি কিংবা ওই নামে আদৌ কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, এমন জাহাজ ও শিপিং লাইন্সের কাগজপত্রও রয়েছে তার সম্পদবিবরণীতে। ব্যাপক অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।

অবৈধ সম্পদ বৈধ দেখিয়ে দুদক থেকে দায়মুক্তি পেতে গিয়াসউদ্দিন এমন কয়েকটি ‘ক্রু ম্যানেজমেন্ট শিপিং এজেন্সি’ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিয়েছেন, নিজের পদ-পদবির কারণে যেগুলোর ওপর তার পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হক অ্যান্ড সন্স লিমিটেড, রিলায়েন্স শিপিং সার্ভিস ও রাইজিং সান করপোরেশন রয়েছে। এছাড়া বিদেশি জাহাজ কোম্পানিগুলো থেকে তার কোনো ব্যাংক হিসাবে কখন কতো টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে সম্পদ বিবরণীতে তারও কোনো রেকর্ড নেই।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, গিয়াসউদ্দিন তার সম্পদবিবরণীতে ‘এমটি পেট্টো কনকর্ড’ জাহাজে জুনিয়র অফিসার পদে চাকরি ও সেখান থেকে ৬৪ হাজার ৪০০ ডলার মার্কিন আয় দেখিয়েছেন। সমুদ্র রাজ জাহাজে চাকরি দেখিয়েছেন ডেক অফিসার হিসেবে। আয় দেখিয়েছেন ১৯ হাজার ৯৫০ মার্কিন ডলার। এভাবে এমটি পেট্টো স্ক্যাম জাহাজেও চাকরি দেখিয়েছেন। তবে, অনুসন্ধানে জানা যায়, উল্লেখিত জাহাজগুলোতে কখনোই চাকরি করেননি তিনি।
দুদকে দাখিলকৃত সম্পদবিবরণীতে তিনি নিজ নামে ৪ কোটি ৮৮ লাখ ১১ হাজার ৬৮০ টাকার স্থাবর সম্পত্তি দেখিয়েছেন। অস্থাবর সম্পত্তি দেখিয়েছেন ২ কোটি ১৪ লাখ ৭৩ হাজার ৭৫ টাকা। মোট ৭ কোটি ২ লাখ ৮৪ হাজার ৭৫৫ টাকার সম্পত্তি দেখান তিনি। ১৯৯২ সালের ১১ জুন থেকে ২০১২ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত মোট ২০ অর্থবছরে আয়ের উৎস দেখিয়েছেন ২১টি সমুদ্রগামী জাহাজে বিভিন্ন পদে চাকরি। এই খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় মোট আয় দেখিয়েছেন ৯ কোটি ৪৪ লাখ ৯৩ হাজার ২৪৬ টাকা।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, গিয়াসউদ্দিন ‘এমটি পেট্টো শামস’ জাহাজে চাকরি থেকে অতিরিক্ত ৩৮ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার আয়ের কাগজপত্র দাখিল করেছেন। ‘এমটি ওশান হাক’ জাহাজে দ্বিতীয়বারের চাকরিতে প্রতি মাসে অতিরিক্ত ৩ হাজার মার্কিন ডলার আয় দেখিয়েছেন। ‘এমভি সমুদ্র সম্রাট’ জাহাজে চাকরি করেছেন জুনিয়র অফিসার পদে। সম্পদবিবরণীতে এখান থেকে অতিরিক্ত আয় দেখিয়েছেন ২৭ হাজার ৩০০ ডলার। ‘এমটি অ্যামাজি গ্যালাক্সি’ জাহাজ থেকে ১৬ হাজার ৪৭১ দশমিক ৫ ডলার আয় দেখিয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গিয়াসউদ্দিন এমটি পেট্টো রেঞ্জার জাহাজে জুনিয়র অফিসার হিসেবে ১১ মাসে আয় করেন ৩০০ ডলার। কিন্তু এখানে কাগজপত্রে দেখানো হয় আটগুণ বেশি আয়। ‘এমটি ওশান স্কিল’ জাহাজে ৮ মাস চাকরিতে প্রাপ্তঅর্থের অতিরিক্ত ৬৮ হাজার ৮০০ মার্কিন ডলার আয় বেশি দেখিয়েছেন। সম্পদবিবরণীতে ‘এমটি ওশান সানরাইজ’ জাহাজে চিফ অফিসার পদে চাকরি করেছেন উল্লেখ করে সেখান থেকে ৫৩ হাজার ৫৫০ মার্কিন ডলার আয় দেখিয়েছেন। ‘এমটি অঞ্জনি’ জাহাজ থেকে আয় দেখান ১৬ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। ১০ হাজার মার্কিন ডলার আয় দেখান ‘এমটি বাদরাইনি’ জাহাজ থেকে।

গিয়াসউদ্দিনের এই অস্বাভাবিক আয় সম্পর্কে জানতে সমুদ্রগামী বিদেশি জাহাজে বহুবছর চাকরি করছেন এবং অতীতে করেছেনÑ এমন অন্তত: চারজন নৌ প্রকৌশলী ও মাস্টার মেরিনারের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের আলাপ হয়। তারা প্রত্যেকেই বলেছেন, চাকরির শুরু থেকে একজন জুনিয়র মাস্টার মেরিনারের কিংবা নৌ প্রকৌশলীর পক্ষে এতো টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব নয়। মূলত: কালোটাকা সাদা অর্থাৎ অবৈধ সম্পদ বৈধ করতেই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় দেখানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তারা। তবুও তাঁর বিরুদ্ধে মামলা না করে তাকে দায়মুক্তির সুপারিশ করেছিলেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা শাহিন আরা মমতাজ। তবে কমিশন বৈঠকে অনুসন্ধান কর্মকর্তার সুপারিশ নাকচ এবং তার স্থলে নতুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ হয়। জনশ্রুতি আছে, নিজের কালো টাকার দৌরাত্ম্য এবং গোপালগঞ্জের একজন মন্ত্রীর (সদ্যসাবেক) ক্ষমতার প্রভাবে দ্বিতীয় অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে বশে এনেছেন গিয়াসউদ্দিন।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে কথা বলতে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের সিএনএস (চলতি দায়িত্বে) গিয়াসউদ্দিন আহমেদের মুঠোফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। এরপর এ প্রতিবেদক নিজের পরিচয় দিয়ে এবং কথা বলার বিষয়বস্তু জানিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদেবার্তা পাঠান। কিন্তু ক্ষুদেবার্তার কোনো জবাবও দেননি তিনি। এরপর এ প্রতিবেদক মুঠোফোনে পুনরায় কল দেন তাকে। কিন্তু কল রিসিভ করেননি তিনি।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *