নিজস্ব প্রতিবেদক : ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলজুড়ে ডিজিটাল উন্নয়নের ছোঁয়া। লক্ষ্য রূপকল্প-২০৪১। এরমধ্যেই উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাবে বাংলাদেশ। আর এখানে বাতিঘর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিববর্ষে দেশে-বিদেশে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর বছরব্যাপী বর্ণাঢ্য কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে একদিকে সারা বিশ্বে যেমন বীর বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরা হবে, অন্যদিকে সরকারের ভুল-ত্রুটি শুধরে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাবার শপথ নেবে জাতি।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন উদযাপনের মধ্য দিয়ে মুজিববর্ষের যে ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে তা পূর্ণতা পাবে আগামী ১৭ মার্চ জাতির জনকের জন্মদিনে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মুজিববর্ষের অঙ্গীকার ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ে তুলে জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা। আর এ লক্ষ্যেই কাজ করছে সরকার।
জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর কর্মসূচি উদযাপন হবে প্রতিটি বিভাগ, জেলা ও ওয়ার্ড পর্যায় থেকে। আগামী ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত গৃহীত এই কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের বাইরেও পালিত হবে নানা কর্মসূচি। সরকার এ লক্ষ্যে দুটি কমিটিও গঠন করেছে।
‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি’ এবং ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি’।
এই দুই কমিটিতে রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্টজন- স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষাবিদ, শিল্প-সংস্কৃতি-ক্রীড়া ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এবং ধর্মীয় নেতারা রয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সমন্বয়ে নানা পরিকল্পনা করেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে ২৯৬টি পরিকল্পনার তালিকা করেছে ওই কমিটি। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিবস ঘিরে বড় পরিসরের কর্মসূচির পাশাপাশি পুরো বছরে রয়েছে আনন্দ আয়োজন, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যচিত্রের পরিকল্পনা, আন্তর্জাতিক প্রকাশনা, বাংলা ও ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জন্মশতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ।
মূলত মুজিববর্ষের বছরব্যাপী আয়োজনের সূচনা হবে ১৭ মার্চ থেকে। ওইদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহর ও বিভিন্ন স্থানে ৩১ বার তোপধ্বনি, সব সরকারি, বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। রাজধানীর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, টুঙ্গিপাড়ায় জাতীয় শিশু দিবসের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি দেশব্যাপী বিশেষ দোয়া ও প্রার্থনা আয়োজন করা হবে। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে হবে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর আনুষ্ঠানিক আয়োজন।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি সেদিনের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা। জাতির পিতাকে নিয়ে স্মারক বক্তৃতা দেয়ার কথা রয়েছে ভারতের রাষ্ট্রপতি নরেন্দ্র মোদির। এছাড়া মসজিদ, মন্দির, গির্জাসহ সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মোনাজাত ও প্রার্থনার আয়োজন, জেলা ও উপজেলায় বিভিন্ন দপ্তর, সংস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, বিভিন্ন বাহিনী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্কাউটস, গার্লস গাইড, বিএনসিসির প্যারেড, প্রদর্শনী ও শিশু-কিশোর সমাবেশের আয়োজন, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উৎসবমুখর পরিবেশে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পালন করা হবে।
এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অর্জন ও আত্মত্যাগের গৌরবগাথা আমরা নতুন প্রজন্ম এবং সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরব। আমাদের উদযাপন হবে প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যময়।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া শেখ মুজিবের হাত ধরেই কালক্রমে বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে স্থান করে নেয় বাংলাদেশ। মহান একাত্তরের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে আটক হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। এরপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
মুজিববর্ষে গণহত্যা দিবস পালন: মহান স্বাধীনতা দিবস, ১৮ মার্চ সংসদের বিশেষ অধিবেশন, ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে মুজিবনগর দিবস উদযাপন, ২৩ মে বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদক প্রাপ্তি দিবসে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আলোচনা সভা, ছয়দফা দিবস উদযাপন, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন, ৮ আগস্ট বঙ্গমাতার জন্মদিন উদযাপন, জেলহত্যা দিবস পালন, বিজয় দিবস উদযাপন, সুপ্রিম কোর্টে জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধু: বঙ্গবন্ধুকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন দেশের ৭৭টি দূতাবাসে ২৬০টিরও বেশি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে রয়েছে- ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘের সদর দপ্তর, জেনেভায় জাতিসংঘ দপ্তরের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায়, ব্রাসেলসে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদর দপ্তর ও প্যারিসে অবস্থিত ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের ব্যবস্থা নেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিদেশে আরো পাঁচটি বঙ্গবন্ধু চেয়ার এবং ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজে বঙ্গবন্ধু সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব লর্ডসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান আয়োজন এবং ওই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল এ রকম গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বক্তব্য দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে।
আরো রয়েছে লন্ডনে মাদাম তুসো জাদুঘর, জাতিসংঘ সদরদপ্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাস্কর্য স্থাপন এবং ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবন ও আদর্শভিত্তিক চিত্রকর্ম-আলোকচিত্র প্রদর্শনী আয়োজন। নিউইয়র্কে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে মুজিব ফেলোশিপ এন্ড ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম চালু এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের পিস-কিপিং সাফল্যকে উদযাপন করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্টজনদের নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনার এবং আগামী মে মাসে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউটে ‘শেখ মুজিব ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ শীর্ষক সেমিনার আয়োজন করা হবে। ভারতের ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম ও শিলংয়ে নাগরিক মিলনমেলার আয়োজন থাকবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিশ্বের সব দেশে রোপণ করা হবে ১০০টি করে গাছের চারা।
মুজিববর্ষে আসছেন যারা: মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে বিশ্বনেতাদের ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। প্রায় ৫০ জন বিশ্বনেতা ঢাকায় আসতে পারেন। আমন্ত্রিত বিশ্বনেতাদের মধ্যে রয়েছেন- ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ, ভুটানের রাজা জিগমে নামগিয়েল ওয়াংচুক প্রমুখ।
অদম্য বাংলাদেশ, সময় এবার এগিয়ে যাবার: মুজিববর্ষকে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের অভাবনীয় অর্জনকে বর্হিবিশ্বে তুলে ধরতে চাইছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত দশ বছরে উন্নয়নের রোল মডেল চিহ্নিত হয়ে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ বিশ্বের নজর কেড়েছে। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, বর্তমানে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। শিগগিরই গড় প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের কোটা স্পর্শ করবে। গত এক দশকে বাংলাদেশের জিডিপি ১৮৮ শতাংশ বেড়েছে; মাথাপিছু আয় বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ। বর্তমানে আমাদের জিডিপি ৩০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রপ্তানি আয় প্রায় তিন গুণ বেড়ে আজ ৪০ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। গত দেড় দশকে বিনিয়োগ-জিডিপির শতকরা হার ২৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন আমাদের অনুকরণ করছে। আমাদের এখন পেছনে ফেরার কোনো সুযোগ নেই, মুজিববর্ষে আমাদের শপথ- উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবার।