অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানে দুদক : অর্থ, প্লট, বাড়ি ও জমির নেশায় গোটা পরিবার

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী

নিজস্ব প্রতিবেদক :  চাকরি জীবনে এখন পর্যন্ত সাকুল্যে বেতন পেয়েছেন দেড় কোটি টাকা। অথচ সরকারি হিসাবেই কৃষি জমি ও প্লট কিনেছেন ২০ কোটি টাকার। এর মধ্যে দুটি প্লটে তৈরি করেছেন বহুতল ভবন। এতে তার খরচ হয়েছে অন্তত ১০ কোটি টাকা। নিজেরা না থাকলেও মানিকগঞ্জ শহরের বাড়িটিও নজরকাড়া। গৃহিণী স্ত্রী, শিক্ষার্থী ছেলেমেয়ের নামেও কিনেছেন একাধিক প্লট। সব মিলিয়ে তার সম্পত্তির বাজার মূল্য শতকোটি টাকার বেশি। নির্ধারিত বেতনে সরকারি চাকরি করে অঢেল ধন-সম্পত্তির মালিক বনে যাওয়া ‘ভাগ্যবান’ এই ব্যক্তি হলেন পুলিশের অ্যাডিশনাল ডিআইজি এমএ মাসুদ। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, জায়গা-জমি ও প্লটের নেশায় বুঁদ মাসুদ ও তার পরিবার। অভিযোগ আছে-বিপুল অবৈধ সম্পদের তথ্য আড়ালে রাখতে প্রভাব খাটিয়ে অনুসন্ধান কাজের গতি থামিয়ে রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বর্তমানে তিনি শিল্প পুলিশে কর্মরত। দুদক থেকে প্রাপ্ত নথিপত্র বিশ্লেষণ করে এবং যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।


বিজ্ঞাপন

অবৈধ সম্পদ ও দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাডিশনাল ডিআইজি এমএ মাসুদ গণমাধ্যম কে বলেন, ‘দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। দুদক থেকে আমাকে বিছু জানানো হয়নি।’ দুদক থেকে প্রাপ্ত নথির সূত্র ধরে গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে আপনার স্ত্রী-সন্তানের নামে বহু প্লট ও বাড়ির তথ্য পাওয়া গেছে, এমন এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাডিশনাল ডিআইজি এমএ মাসুদ বলেন‘এ নিয়ে তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলবেন না।’


বিজ্ঞাপন

সরেজমিন জানা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় সম্পদ গড়ে তুলেছেন এমএ মাসুদ। যেসব এলাকায় তার সম্পত্তি আছে, সেসব এলাকার মানুষ তাকে এসপি মাসুদ হিসাবেই চেনেন। প্রায় প্রতিটি সম্পত্তিতে তার স্ত্রী-সন্তানের নামে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। বেশ কয়েকটি সাইনবোর্ডের নিচে লেখা আছে-‘প্রযত্নে এমএ মাসুদ, পুলিশ সুপার’।

তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে তার পদোন্নতির সঙ্গে কিছু স্থাপনার নামফলকও বদলে ফেলা হয়েছে। মানিকগঞ্জ শহরের ১২/১ বেউথা রোডে অবস্থিত তার নজরকাড়া বাড়ির নামফলকে এক সময় শ্বেতপাথরে খোদাই করা ছিল-‘শরীফ ম্যানশন, এমএ মাসুদ, সহকারী পুলিশ সুপার। অর্থাৎ নাম ফলকের তথ্যই স্পষ্ট করছে, সহকারী পুলিশ সুপার হিসাবে চাকরিতে যোগদানের পরই বাড়িটি করেছেন। তবে অ্যাডিশনাল ডিআইজি হিসাবে পদোন্নতি পাওয়ার পর শ্বেতপাথরের নামফলক থেকে সহকারী শব্দটি ঘঁষে তুলে ফেলা হয়েছে। আর উপরে অ্যাডিশনাল ডিআইজি পরিচয়ে লাগানো হয়েছে নতুন করে নামফলক। সরেজমিন আরও দেখা গেছে, বাড়িটির প্রধান ফটকটি বেশ দৃষ্টিনন্দন। ভেতরে গাছগাছালিতে ভরা কয়েক বিঘার ফাঁকা জায়গা।

তারই মধ্যে পাকা ভবন। কয়েকবার ফটকের কড়া নাড়লে একজন মহিলা ফটকের ওপারে আসেন। সাংবাদিক পরিচয় দিলে তিনি ভেতরে গিয়ে আর ফেরেননি। স্থানীয়রা জানান, বাড়িতে তার মা ও এক ভাই পরিবার নিয়ে থাকেন। আগে একটি টিনশেড ঘর ছিল। তার (মাসুদ) বাবা পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি করতেন। বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জ সদরের নবগ্রাম ইউনিয়নের দিঘলিয়া গ্রামে। বাবা অবসরে যাওয়ার আগে বেউথায় ওই জমি কিনে একটি টিনশেড ঘর বানিয়েছিলেন।

২১তম বিসিএসের মাধ্যমে ২০০৩ সালে সহকারী পুলিশ সুপার পদে চাকরি পাওয়ার পর ওই জমির সঙ্গে আরও কিছু জমি কিনে সীমানা প্রাচীর দেন। বাড়িটির চেহারাও ধীরে ধীরে পালটাতে থাকে। টিনশেড থেকে দালানে পরিণত হয়। বাড়িতে এখন তেমন যাতায়াত নেই এই পুলিশ কর্তার। তবে গ্রামের বাড়িতে কিছু কৃষি জমি কিনেছেন। একটি জমির পাশে গাছে লাগানো সাইনবোর্ডে লেখা, পৈতৃক সূত্রে এই জমির মালিক অতিরিক্ত ডিআইজি এমএ মাসুদ। তার ভাই এমএ শরীফ। মানিকগঞ্জ শহরের চাঁদনী শপিংমলে একটি পোশাকের দোকান আছে তার। শরীফ জানান, ভাইয়ের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই। কোথায় তার কর্মস্থল তাও জানেন না তিনি।

জানা গেছে, সম্প্রতি একের পর এক পুলিশ ও সরকারি পদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি সামনে এলে এমএ মাসুদ তার ও স্ত্রী-সন্তানের নামে টানানো জমির মালিকানার কয়েকটি সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলেছেন। তবে ঢাকা, সাভার ও ধামরাইয়ের চারটি প্লটে লাগানো শ্বেতপাথরের নামফলক এখনো বিদ্যমান। ধামরাইয়ের ইসলামপুর মাদ্রাসা রোডের বহুতল আবাসিক ভবনের নামফলকটি তুলে ফেলা হয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, ছয়তলা বাড়িটির নিচে পার্কিং। আকাশি রংয়ের বাড়ির প্রতি তলায় দুটি করে ফ্ল্যাট।
স্থানীয়রা জানান, মাসুদের স্ত্রী মাসে মাসে এসে ভাড়া নিয়ে যান। বাড়িটি তার স্ত্রী রুবি ইয়াসমিনের নামে। তিন নম্বর প্লটে করা বাড়ির দুই পাশের ১ ও ২ নম্বর প্লটটিও তার। জানা গেছে, এই বাড়ির জমিটি স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল খালেকের তিন ছেলে শফিকুল ইসলাম, শাহীন ও সেলিমের কাছ থেকে বছর চারেক আগে কেনেন। এরপরই বাড়ির কাজ শুরু করেন। পাশের ১ ও ২ নম্বর প্লটটি সীমানা প্রাচীরে ঘেরা। ভেতরে কিছু গাছগাছালি ও ছোটখাটো অবকাঠামো রয়েছে।

এছাড়া ইসলামপুরে বংশী নদীর পাশে ৯ শতাংশ জমি কিনে সেখানে সীমানা প্রাচীর দিয়ে রেখেছেন। ওই জমির পাশের বাসিন্দা হাজী বরকত আলীর ছেলে আব্দুল ওহাব ও দুই মেয়ে জুলি ও মরিয়ম আক্তারের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকায় জমিটি কেনেন মাসুদ। আবদুল ওহাব জানান, তার বোন জাবেদা বেগমের কাছ থেকেও জমি কিনতে চেয়েছিলেন মাসুদ। ওই জমির পাশেই আব্দুল ওহাবের বড় বোন জাবেদা বেগমের বাড়িটি পানির দামে কিনতে তার ছেলে আরিফকে নানা হয়রানি করেছে এমএ মাসুদ ও তার স্ত্রী রুবি ইয়াসমিন। তাদের কাছে জমি বিক্রি না করায় রেন্ট এ কারের চালক আরিফ হোসেনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দেওয়া হয়েছে। সাজানো মামলায় ৩ মাস হাজতবাসও করেছেন।

এরপর আরিফ হোসেনের বাড়ির রাস্তা বন্ধ করে দুই পাশে বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ করেছেন মাসুদের স্ত্রী রুবি ইয়াসমিন। আরও জানা গেছে, সাভারের নয়ারহাট আমগাছিয়া বংশী নদীর পাশে স্ত্রী রুবি ইয়াসমিনের নামে আরও ২০ শতাংশ জমি কিনেছেন মাসুদ। স্থানীয় বাসিন্দা অলিল, আলী ও হজরত আলীসহ কয়েকজনের কাছ থেকে ওই জমি কিনেছেন বলে জানিয়েছেন বালু ব্যবসায়ী অলিল। ওই জমিটি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বালুর গদি হিসাবে ভাড়া দেওয়া।

সাভারের জাহাঙ্গীরনগর কো-অপারেটিভ লিমিটেডে রয়েছে কলেজ পড়ুয়া ছেলে এমএ তাসিন ও স্কুল পড়ুয়া মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসের নামে একটি প্লট। সরেজমিন দেখা গেছে, সীমানা প্রাচীরে ঘেরা প্লটটিতে ফটকের পাশে মালিকানা নির্দেশ করে তার ছেলেমেয়ের নামের সঙ্গে লেখা-প্লট নং-১৯, রোড নং-১৩, ২নং গেইট, জমির পরিমাণ ১০ শতাংশ, জাহাঙ্গীরনগর কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি. সাভার, ঢাকা। এছাড়া সাভারের ছায়াবিথী হাউজিংয়ে রয়েছে আরেকটি প্লট। এই প্লটটিতেও সীমানা প্রাচীর দেওয়া। প্রবেশমুখের গেটে লেখা, ‘রুবি ইয়াসমীন, প্রযত্নে এমএ মাসুদ (পুলিশ সুপার), ব্লক-এ, প্লট নং-৩৬, জমির পরিমাণ ৩.৩৩ শতাংশ, ছায়াবিথী হাউজিং লি., সাভার, ঢাকা।’

এছাড়াও বসিলার র‌্যাব হেডকোর্য়ার্টারের সামনে স্ত্রীর নামে একটি কর্নার প্লটও কিনেছেন। একইভাবে এই প্লটও সীমানা প্রাচীরে ঘেরা। প্লটটিতে প্রবেশ গেটে লেখা রয়েছে, ‘ক্রয় সূত্রে এই জমির মালিক রুবি ইয়াসমিন, প্রযত্নে : এমএ মাসুদ (পুলিশ সুপার), সিটি জরিপ দাগ নং ১১৪, এসএ ও সিএস-০৯, আরএস-১৯, প্লট নং-১ ও ৩, রোড নং-৩, ব্লক-সি, জমির পরিমাণ ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ, বসিলা সিটি ডেভেলপার্স লি., বসিলা, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭।’ এটির বর্তমান বাজার দর প্রায় ১০ কোটি টাকা। অনুসন্ধানে এই প্রতিবেদক যেসব সম্পত্তির চিত্র পেয়েছেন তার চেয়ে আরও কয়েকগুণ সম্পত্তির অভিযোগ আছে দুদকের নথিতে। যা অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত তার জায়গা-জমি, প্লট-বাড়ি। ঢাকার বসিলা, ধামরাই, সাভার ও মানিকগঞ্জে তার আরও সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে সাভারের নয়ারহাটের আমগাইছাতে ২০ শতাংশের একটি প্লট, ধামরাইয়ের দক্ষিণ ছয়বাড়িয়ায় ২০ শতাংশের আরেকটি প্লট আছে। সব মিলিয়ে তার পরিবারের অন্তত ২০টি প্লট থাকার অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক।

জানা গেছে, এমএ মাসুদ দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন-এমন অভিযোগ পায় দুদক। সংস্থার যাচাই-বাছাই কমিটি অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের সুপারিশ করে কমিশনে পাঠায়। গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর কমিশন অনুসন্ধানের অনুমোদন দেয়। এরপর দুদকের একটি টিম তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *