ভোগ্যপণ্যেও ঝাঁজ
বিশেষ প্রতিবেদক : করোনাভাইরাস ছড়ানোর মতোই দ্রুতগতিতে বাড়ছে জীবাণুর ভয়। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নানা ধরনের জীবাণু-প্রতিরোধকের চাহিদা। কেমিক্যাল সংস্থাগুলির বিভিন্ন পণ্যের বিক্রিও বাড়ছে। কিন্তু পণ্যবাহী জাহাজ চীনের সীমান্তে আটকা থাকার ফলে নতুন মাল পৌঁছতে পারছে না।
কেএফসি, পিৎজা হাট বা ম্যাকডোনাল্ডসের মতো ফাস্ট ফুড চেনগুলির রমরমা করোনাভাইরাসের কারণে আগের মতো নেই। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে বন্ধ রয়েছে এই সব দোকান। অনলাইনে বিক্রিও বন্ধ। অন্যান্য অনলাইন খাবার অর্ডার করার অ্যাপও এখন আর চীনে খাবার সরবরাহ করছে না।
খেলার সামগ্রীতেও করোনার প্রভাব : বিশ্বখ্যাত খেলার সামগ্রীর ব্র্যান্ড অ্যাডিডাস ও নাইকি সাময়িকভাবে চীনে তাদের বেশির ভাগ দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, যেসব দোকানে নাইকি বা অ্যাডিডাসের পণ্য বিক্রি হয়, সেখানেও চলছে কড়া নজরদারি, যাতে করে বিক্রি না হওয়া পণ্যের মাধ্যমে জীবাণু আরো না ছড়ায়।
বিপদের ঝুঁকিতে গাড়িপ্রস্তুতকারীরা : জার্মান গাড়ি শিল্পের উপর করোনাভাইরাসের ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রভাব থাকতে পারে বলে মনে করছেন গাড়ি শিল্প বিশেষজ্ঞ ফার্ডিনান্ড ডুটেনহ্যোফার। বিখ্যাত গাড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থা ফক্সভাগেনের মোট ৩৩টি কারখানা রয়েছে চীনে, যার মধ্যে বেশ কটি আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে বলে জানা গেছে। গাড়ি প্রস্তুতের কাজে বাধা আসলেও ডেলিভারির কাজ ঠিকই চলছে এখনও।
এদিকে করোনাভাইরাসের প্রাণকেন্দ্র উহান অঞ্চলে জাপানি গাড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থা হন্ডার তিনটি কারখানা আগামী ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ রাখা হবে। এখনও যদিও স্পষ্ট নয় যে কবে থেকে কাজ আবার শুরু হবে, কিন্তু তবুও সাবধানে ফাঁকি রাখতে চান না হন্ডা কর্মকর্তারা।
চাহিদামত পণ্য নেই বাজারে : বর্তমান বিশ্বে এক দেশের বাজারের সাথে আরেক দেশের শিল্প খুব গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট থাকায় হ্যুনডাই বা হন্ডার মতো সংস্থার প্রস্তুত বন্ধ থাকার প্রভাব পড়ছে বিশ্বের বাজারেও। দক্ষিণ কোরিয়ায় এই সপ্তাহেও বন্ধ থাকবে হ্যুনডাই গাড়ির প্রস্তুতের কাজ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এই ধারা অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও দেখা যাবে।
ফ্রাংকফুর্টেও করোনার প্রভাব : চীনের সাথে একাধিক দেশ ইতিমধ্যে বন্ধ করেছে বিমান পরিষেবা। এই বন্ধের ফলে বহু ব্যবসায়ী প্রাংকফুর্টের বিখ্যাত ‘আম্বিয়েন্টে’ শিল্পমেলায় তাদের পসরা নিয়ে আসতে পরেননি। যদিও জার্মানির সাথে উহানের কোনো সরাসরি বিমান ব্যবস্থা নেই, তবুও সাবধান থাকতে এয়ারপোর্টে বিশেষ আইসোলেশন ইউনিট (চীন ফেরত যাত্রীদের জন্য বিচ্ছিন্ন বলয়) রাখা হয়েছে।
করোনায় ভোগ্যপণ্যেও ঝাঁজ : চীনে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে লন্ড-ভন্ড হয়ে পড়ছে ভোগ্যপণ্যের বাজার। বিশেষ করে আদা ও রসুনসহ চীন থেকে আমদানি করা বিভিন্ন পণ্যের দাম চড়ার দিকে। কারণ বাংলাদেশের আদা-রসুনের ৭৫ শতাংশ আসে চীন থেকে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত ২৫ দিনে রসুনের দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেড়েছে। তবে ভারতের কেরালার আদা আসায় কেজিতে দাম কমেছে ২০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে চীন থেকে নতুন কোনো শিপমেন্ট না দেওয়ায় পুরনো পণ্য আসছে। যার সরবরাহ আগামী ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তখন নতুন করে রসুনের দাম আরো বাড়তে পারে।
রাজধানীর শ্যামবাজারের পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। জানা যায়, চীন থেকে আমদানি করা রসুনের দাম কেজিতে ৫০-৬০ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে প্রতিকেজি রসুন বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০টাকা, যা গতমাসেও ছিল ১৪০ টাকা। প্রতিকেজি দেশীয় পুরনো রসুন বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকায়, গত সপ্তাহে যা ছিল ১৭০ টাকা।
বাজারে আগাম আসা দেশীয় নতুন রসুনের কেজি ১৪০ টাকা। গত বছর এই সময় যা ৫০ টাকার নিচে ছিল। এ বছর বাজারে চীনা রসুনের সংকট থাকায় নতুন দেশীয় রসুনের দামও অনেক বাড়তি বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
অন্যদিকে পাইকারি বাজারে চায়না আদার দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা কমে ১০০ থেকে ১০৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেরালার আমদানি করা আদা পাইকারিতে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি। তবে পাইকারিতে দাম কমলেও খুচরা বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। খুচরা বাজারে চায়না আদার দাম কেজিতে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা কেজি, যা গতমাসে ছিল ১২০ টাকা।
চায়না ব্রিফিং- এর তথ্য অনুযায়ী, চীনের স্টেট কাউন্সিল নববর্ষ উপলক্ষে ২৪ থেকে ৩০ জানুয়ারি ছুটি ঘোষণা করেছিল। তবে করোনা ভাইরাসের কারণে প্রথমে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়। ১ ফেব্রুয়ারি আরেক নোটিশে বেশিরভাগ প্রদেশে এই ছুটি ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
যেসব প্রদেশে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, সেখানে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়। যেমন হুবেই প্রদেশে ১৩ ফেব্রুয়ারি, ঝিঝিয়ান প্রদেশে ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয়। কয়েকটি প্রদেশে অবশ্য সীমিত আকারে কাজ হচ্ছে।
এ বিষয়ে রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার শ্যামবাজারের মেসার্স রাজবাড়ি ভা-ারের স্বত্ত্বাধিকারী ও আদা রসুন আমদানিকারক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক হাজী মো. মাজেদ বলেন, বাজারে আদা ও রসুনের যে চাহিদা তার বেশিরভাগ পূরণ হয় চীন থেকে আমদানি করে। আর করোনা ভাইরাসের কারণে বর্তমানে চীন থেকে এ পণ্য দুটির আমদানি অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে। এর প্রভাব কিছুটা বাজারে পড়েছে। তবে ভারতের কেরালার আদা বাজারে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আদার দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা কমে গেছে। রসুনের কোনো বিকল্প বাজারে না থাকায় দাম ঊর্ধ্বমুখী। গত ২৫ দিন ধরে একই দাম আছে। বর্তমানে প্রতিকেজি রসুন পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ থেকে ১৮৫ টাকা।
তিনি বলেন, চীন গত ২০ জানুয়ারির পর থেকে কোনো আদা-রসুন শিপমেন্ট দিচ্ছে না। ফলে পুরানো শিপমেন্টের পণ্য এখন বাজারে আসছে। যদি করোনার প্রকোপ কমে তাহলে ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন শিপমেন্ট দেওয়া শুরু হবে। যদি নতুন করে চীন থেকে রসুন আসে তা পৌঁছাবে মার্চের শেষ সপ্তাহে। এর মাঝে যে কদিন গ্যাপ থাকবে তখন বাজারে ঘাটতি দেখা দেবে। তখন আবার নতুন করে দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শ্যামবাজারের সোনার বাংলা বাণিজ্যালয়ের ম্যানেজার মাহতাব হোসেন বলেন, চীনে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় নতুন কোনো পণ্য তারা শিপমেন্ট করছে না। নতুন শিপমেন্ট শুরু না হলে দাম আরও বাড়তে পারে।
চীন থেকে গত অর্থবছর ১৩ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারের (১ লাখ ১৪ হাজার কোটি) পণ্য আমদানি হয়, যার প্রায় পুরোটাই এসেছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। সামান্য পরিমাণ খালাস হয়েছে মোংলা বন্দরে। খোলা জাহাজ ও কনটেইনার জাহাজে এসব পণ্য সরাসরি ও সিঙ্গাপুর বন্দর হয়ে চট্টগ্রামে আনা হয়।