বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর মদদপুষ্ট এমডি ও শীর্ষ কর্মকর্তার কারণে তিতাস গ্যাস এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে অব্যাহত  ঘুষ-দুর্নীতি

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় ঢাকা বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী

নিজস্ব প্রতিবেদক  : বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর মদদপুষ্ট এমডি ও শীর্ষ কর্মকর্তার কারণে তিতাস গ্যাস এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে অব্যাহত  ঘুষ-দুর্নীতি’র আখড়ায় পরিনত হয়েছে, এ খবর সংশ্লিষ্ট সুত্রের। জানা গেছে,  তিতাস গ্যাস এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড এক চলমান  ঘুষ-দুর্নীতির আখড়া। আর এসব অনিয়মের কেন্দ্রে থাকেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এমডি) শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা।


বিজ্ঞাপন

এই প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নেওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বড় অংশকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মুখোমুখি হতে হয়েছে। তিন বছর ধরে তিতাসের এমডি পদে আছেন হারুনুর রশীদ মোল্লাহ। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগঅনিয়ম-দুর্নীতিতে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছেন তিনি।


বিজ্ঞাপন

হারুনুর রশীদ মোল্লাহ ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের এমডি পদে পদোন্নতি পান ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক ঘুষ ও অনিয়মের অভিযোগ উঠতে থাকে। তারপরও ২০২৩ সালের আগস্টে তিতাসের এমডি পদে এক বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান তিনি। তাঁর এই নিয়োগে বড় ভূমিকা রাখেন শেখ হাসিনা সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, তাঁদের মধ্যে এমন সম্পর্কের যোগসূত্র হলো, দুজনের বাড়িই ঢাকার কেরানীগঞ্জে। শুধু তা-ই নয়, হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বিভিন্ন জায়গায় দাবি করতেন, তাঁর স্ত্রী নসরুল হামিদের স্ত্রীর বোন হন। তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাতারাতি বিএনপিপন্থী সেজে গেছেন হারুনুর রশীদ। জানা গেছে, কেরানীগঞ্জে বাড়ি– বিএনপির এমন দুই নেতাকে দিয়ে তদবির করে ফের তিতাসের এমডি পদে চুক্তি নবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি।

হারুনুর রশীদ মোল্লাহর চুক্তি নবায়নের চেষ্টা নিয়ে উদ্বেগে আছেন তিতাসের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন,আওয়ামী লীগ সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় অনিয়ম-দুর্নীতি করে বারবার ছাড় পেয়ে গেছেন হারুনুর রশীদ। সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ছত্রচ্ছায়ায় মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়ে ক্যাপটিভ পাওয়ারে গ্যাস-সংযোগ, গ্যাসের নতুন সংযোগ ও অবৈধ সংযোগের দেদার বাণিজ্য করেছেন তিনি। অনিয়ম-দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিয়ে নসরুল হামিদসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে বহুবার।

তবে কোনো তদন্ত হয়নি। তিতাস গ্যাসের এই ঘুষ-দুর্নীতি সিন্ডিকেটে প্রতিষ্ঠানটির এমডি হারুনুর রশীদের সঙ্গে রয়েছেন তিতাসের মহাব্যবস্থাপক অপর্ণা ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক মো. লুৎফুল হায়দার মাসুম, মহাব্যবস্থাপক হাছান আহম্মদ ও মহাব্যবস্থাপক মো. সেলিম মিঞা। এই প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম্যে তিতাসের অন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তোপের মুখে থাকেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে গত শনিবার টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিতাসের হারুনুর রশীদ মোল্লাহ গণমাধ্যম  কে বলেন,‘যা করেছি যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে করেছি। আইনের ব্যত্যয় করে কিছু করা হয়নি।’

তিতাসের এমডির যত অনিয়ম :  তিতাসের এমডি হারুনুর রশীদ মোল্লাহর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তিনি অন্তত ১৫০টি প্রতিষ্ঠানকে গ্যাসের নতুন সংযোগ দিয়ে ও লোড বৃদ্ধি করে অন্তত ৪৫০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন। প্রতিটি সংযোগ ও লোড বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ঘুষের রেট ছিল ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা। তাঁর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে, তাঁর সময়ে অন্তত ১ হাজার ২৫০টি অবৈধ গ্যাস-সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এসব অবৈধ সংযোগ থেকে মাসে মাসে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে থাকে তাঁর নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট তিতাসের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের কোনো গ্যাস বিতরণ সংস্থা ১০ মেগাওয়াটের বেশি কোনো ক্যাপটিভ পাওয়ার কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করতে চাইলে এ জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অনুমতি নিতে হয়। ১০ মেগাওয়াটের বেশি, এমন অন্তত ২০টি ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে গ্যাস-সংযোগ দিয়েছেন তিতাসের বর্তমান এমডি হারুন, যেগুলোর একটিরও অনুমতি নেওয়া হয়নি।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অনুমতি ছাড়াই গ্যাস সরবরাহ করা প্রতিটি ক্যাপটিভ কেন্দ্র থেকে ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে তিতাসের এমডি ১০ মেগাওয়াটকে ভেঙে একাধিক ভাগে লোড দিয়েছেন। এতে কৌশলে এড়ানো গেছে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি। এ ছাড়া অন্তত ১০০ ক্যাপটিভ কেন্দ্রকে গ্যাস-সংযোগ দেওয়া হয়েছে ঘুষের বিনিময়ে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ময়মনসিংহের ভালুকার জামিরদিয়ায় এনআর গ্রুপের কারখানায় পৃথক তিনটি গ্রাহক সংকেত নম্বর দিয়ে ২৪.৯২ মেগাওয়াট ক্যাপটিভে গ্যাস-সংযোগ দিয়েছে তিতাস। এর মধ্যে এনআরজি স্পিনিং মিলসের নামে ১৬.২৫ মেগাওয়াট, এনআরজি কম্পোজিট ইয়ার্ন ডাইনকে ৩.৮৭ মেগাওয়াট ও এনআরজি নিট কম্পোজিটকে ৪.৮০ মেগাওয়াট গ্যাস দেওয়া হয়। এই তিন প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা একই। এ ছাড়া একই কারখানায় এনআরজি হোমটেক্সের নামে ৭.৭৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার ক্যাপটিভ কেন্দ্রে সংযোগ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২২ সালের এপ্রিলে তিতাস গ্যাসের ৮৮১তম বোর্ড সভায় ১৬টি ক্যাপটিভ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এগুলো ছিল ঘুষ ও তদবিরের সংযোগ।

গত বছরের সেপ্টেম্বর গাজীপুরের সিলভার টেক্সটাইল মিল  জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর কাছে গ্যাস-সংযোগের আবেদন করে। ওই আবেদনে জ্বালানিমন্ত্রীর সাবেক
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোনো সুপারিশ ছিল না। তবে সেই আবেদনের ফাইল ঢাকায় আনার জন্য তিতাসের গাজীপুর অফিসকে নির্দেশ দেন এমডি হারুন। সেখানে বলা হয়, এটি জ্বালানিমন্ত্রীর তদবির। এরপরই সিলভার টেক্সটাইল মিল সংযোগ পেয়ে যায়।

পরে প্রধানমন্ত্রীর নামে এমন নির্দেশনা দেখে গত বছরের ২৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জ্বালানি বিভাগের সচিবকে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে ঘুষের মাধ্যমে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস-সংযোগ প্রদানের বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এই চিঠি পর্যন্তই ঘটনা শেষ। এই ঘটনারও বিচার হয়নি।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, মেঘনা গ্রুপের এভারেস্ট পাওয়ার জেনারেশন ৮ মেগাওয়াট অতিরিক্ত লোড চালাচ্ছিল। এ জন্য লাইনটি কেটে দেওয়া হয়। পরে তিতাস বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই ৩ কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে ফের সংযোগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া রুপালি ডাইংয়ে মিটার টেম্পারিং করে অবৈধভাবে বা চুরি করে গ্যাস নেওয়ার কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। আবার ঘুষ নিয়ে ওই রাতে সংযোগ দেওয়া হয়।

নিয়ম না মেনে সিএনজি স্টেশনে গ্যাস-সংযোগ :  দেশীয় গ্যাসের মজুত কমতে থাকার কারণে নতুন করে সিএনজি স্টেশনের অনুমতি কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। সে কারণে ঘোষণা দিয়ে সিএনজি স্টেশনে নতুন গ্যাস-সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ওপরে-ওপরে বন্ধ থাকলেও ভেতরে-ভেতরে চলত গ্যাস-সংযোগের কাজ। সিএনজি স্টেশনে গ্যাস-সংযোগ নিতে হলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক। এই লাইসেন্স না থাকলেও একের পর এক নতুন গ্যাস-সংযোগ দিয়েছেন তিতাস গ্যাসের এমডি হারুন।

তিতাস সূত্র বলছে,  ঢাকায় লাইসেন্সবিহীন সিএনজি স্টেশন রয়েছে ৪০টি। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জে ১৫টি, নরসিংদীতে ১০টি, গাজীপুরে ১০টি, ‍মুন্সিগঞ্জে ২টিসহ মোট ৭৯টি লাইসেন্সবিহীন গ্যাস-সংযোগ রয়েছে তিতাসের। অভিযোগ আছে, এগুলোর প্রতিটির কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন তিতাসের এমডি।

ঘুষ না দিলে বৈধ লাইন বন্ধ :  তিতাসের এমডি হারুনের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ হলো, প্রতিটি শিল্পের সংযোগ ও সিএনজি স্টেশন থেকে মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ মাসোয়ারা নিয়ে থাকেন তিনি। এই মাসোয়ারা বৈধ ও অবৈধ লাইন—উভয়কেই দিতে হয়। যারা মাসোয়ারা দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তাদের বৈধ লাইনও নানান মারপ্যাঁচে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে উৎপাদনমুখী শিল্পকারখানাও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উদাহরণ রয়েছে। অনেক উদ্যোক্তা সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন।

তিতাসের কর্মকর্তারা জানান, ঘুষের টাকা না দেওয়ায় আয়মান টেক্সটাইল অ্যান্ড হোসিয়ারি লিমিটেড নামের একটি বৈধ গ্যাস-সংযোগ বন্ধ করে দেয় তিতাস। আদালতের রায় নিয়ে তিন বছর পর গ্যাস পায় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু তত দিনে তাদের ব্যবসার লালবাতি জ্বলে গেছে। গাজীপুরের মাওনা এলাকার বদর স্পিনিং মিলসের ইভিসি মিটারটিতে ত্রুটি দেখা দিলে ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিতাস গ্যাসকে জানানো হয়। এর চার মাস পরে তিতাস গ্যাসের লোকজন কারখানায় আসেন। এরও ছয় মাস পরে ইভিসি মিটার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। এরপর বড় অঙ্কের বিল পাঠায় তিতাস গ্যাস। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা ঘুষ দিতে চাননি।

নিয়োগে কেলেঙ্কারি  :  তিতাসে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে যাঁদের নিয়োগ হয়, তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সর্বনিম্ন এসএসসি পাস থাকতে হবে। অথচ তিতাসে ৭১ জনের নিয়োগ হয়েছে, যাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি, সেই সনদও ঘষামাজা। আবার বয়সের সীমা ৬০ বছর অতিক্রম করেছে—এমন রয়েছেন ৮ জন।

তিতাসে এসব ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, জ্বালানি খাতের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান হলো ঘুষ-দুর্নীতির আখড়া। তার মধ্যে তিতাস হলো মহা দুর্নীতিবাজ। এই অন্তর্বর্তী সরকার’কে এমন একটি বার্তা দিতে হবে যে, ঘুষ-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলে পরিণাম হবে ভয়াবহ। এখন পর্যন্ত এমনটি দেখা যায়নি।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *