নিজস্ব প্রতিবেদক : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ২০ আগস্ট সব জেলা প্রশাসককে (ডিসি) প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি বিদ্যমান জেলা প্রশাসক পদায়ন নীতিমালা ও গত সরকারের তৈরি ডিসি ফিটলিস্ট বাতিল করা হয়। এরপর নতুন ফিটলিস্ট তৈরির জন্য টানা দুই সপ্তাহ বিসিএস ২৪, ২৫ ও ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রায় ৬০০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে তৈরি করা হয় ফিটলিস্ট।
কিন্তু গত সোম ও মঙ্গলবার যে ৫৯ জনকে ডিসি হিসেবে পদায়ন করা হয়, সেখানে গত সরকারের আমলে বারবার পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়া ও নানাভাবে কোণঠাসা থাকা মাত্র তিনজন কর্মকর্তা ঠাঁই পেয়েছেন। বাকি ৫৬ কর্মকর্তা গত ১৬ বছরে নিয়মিত পদোন্নতি পেয়েছেন। বেশির ভাগই ভালো পদায়ন নিয়ে দাপটের সঙ্গে চাকরি করেছেন। ছিলেন আওয়ামী লীগের করা ফিটলিস্টে, স্থান পেয়েছেন নতুন ফিটলিস্টেও।
বঞ্চিত যারা নতুন ডিসির তালিকায় স্থান পেয়েছেন তারা হলেন– যশোরের ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মো. আজহারুল ইসলাম, চট্টগ্রামের ডিসি নিয়োগ পাওয়া ফরিদা খানম এবং বগুড়ার ডিসি পদ পাওয়া হোসনা আফরোজা।
নতুন করে ফিটলিস্ট তৈরির সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, এবার নতুন ডিসি নিয়োগের মানদণ্ড হবে মেধা, দক্ষতা ও সততা। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত সোমবার
প্রথম দফায় যে ২৫ জনকে ডিসি হিসেবে পদায়ন করা হয়, তাদের মধ্যে মাত্র ১১ জন মেধায় চাকরি পেয়েছেন। বাকি ১৪ জন বিভিন্ন কোটায় চাকরিতে এসেছেন।
২৫ জনের বিস্তারিত তথ্য নিয়ে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে দু’জন বিগত সরকারের আমলে নানাভাবে বঞ্চিত ছিলেন। ২৩ জন নিয়মিত পদোন্নতিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যথাসময়ে পেয়েছেন। তারা আগের সরকারের ফিটলিস্টেও ছিলেন। এ ছাড়া এবার নারীরাও তুলনামূলক কম স্থান পেয়েছেন। ২৫ জনের মধ্যে নারী মাত্র তিনজন। এই তিন নারীর দু’জন বিগত দিনে বঞ্চিত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারকে সহযোগিতা দিতে ২৪, ২৫ ও ২৭তম বিসিএসের পাঁচ কর্মকর্তাকে সমন্বয়ক করা হয়েছিল। তারা হলেন– বিসিএস ২৪ ব্যাচের নুরজাহান খানম ও নজরুল ইসলাম, ২৫ ব্যাচের নুরুল করিম ভূঁইয়া ও ফরিদা খানম এবং ২৭ ব্যাচের সারোয়ার আলম। এই সমন্বয়কারীদের কাউকেও ডিসি করা হয়নি।
৫৯ জনের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ফিটলিস্টে থাকা দুই মন্ত্রণালয় ও বিভাগের একজন কর্মকর্তাও পদায়ন থেকে বাদ পড়েননি। এ দুটি হলো স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এর মধ্যে এককভাবে সর্বাধিক সাতজন ডিসি হয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে।
বঞ্চিত দাবি করা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত সরকারের আমলে কোণঠাসা থাকা কর্মকর্তার বড় একটি অংশই এবার ডিসি হতে পারেননি। বিগত দিনে প্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের বঞ্চিত থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে জসীম উদ্দিন, সাইফুল ইসলাম, নূরজাহান খানম শান্তা, মাহবুব হোসেন, মনিরুজ্জামান, শাহীন ইসলাম, বদরুল আলম লিটন, সাইফুল হাসান রিপন ও রেবেকা খানকে ডিসি না করায় অবাক হয়েছেন ব্যাচমেট অনেকে। একইভাবে ২৫তম ব্যাচের নুরুল করিম ভূঁইয়া, ইয়ারুল ইসলাম, সেলিম আহমেদ, হাসান হাবিব, জয়নুল আবেদীন, মুস্তাফিজুর রহমান, সগীর হোসেন, জাহিদুল ইসলাম, নুরুল হাফিজ, তাহসীনা ইসলাম, আলীমুন রাজীব, এটিএম শরীফুল ইসলাম, মোতাকাব্বির আহমেদ, নজরুল ইসলাম, মিনারা নাজনীন এ দফায়ও বঞ্চিত হলেন।
প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায়, সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ডিসিদের অনেকের বিরুদ্ধে বিগত আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠতার যে অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে, তা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। ঢাকার ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া তানভীর আহমেদ সাবেক আইন সচিব আবু সালেহ মো. জহিরুল ইসলামের একান্ত সচিব (পিএস) ছিলেন। এ ছাড়া তিনি সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) সাজ্জাদুল ইসলাম শাহিনের নিকটাত্মীয়। বিগত সরকারের সময় অতিরিক্ত সচিব সায়লা ফারজানা ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের দেওয়া ডিসি ফিটলিস্টে তানভীর আহমেদের নাম ছিল। ময়মনসিংহ জেলার ডিসি মফিদুল আলম চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের পিএস ছিলেন।
ঝিনাইদহের ডিসি মো. আবদুল আওয়াল কমলনগর ও কুমিল্লায় ইউএনও থাকা অবস্থায় তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। গত সরকারের সময় তৈরি করা ফিটলিস্টে তাঁর নাম ছিল। মাগুরার ডিসি মো. অহিদুল ইসলাম গত সরকারের সময় পাঁচ বছর মরিশাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কক্সবাজার জেলার ডিসি মোহাম্মদ সালাউদ্দিন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। গত সরকারের সময় তিনি মোটা বেতনে একটি প্রকল্পে লিয়েনে পোস্টিং নিয়েছিলেন।
নোয়াখালীর ডিসি খন্দকার ইসতিয়াক ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। তাঁর বাবা ও মামা গাইবান্ধা জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি চারটি উপজেলায় এসিল্যান্ড ছিলেন। খুলনার ডিসি মো. সাইফুল ইসলাম ছাত্রলীগ নেতা এবং ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বাহাদুর বেপারীর একান্ত সহচর ছিলেন। হবিগঞ্জে ইউএনও থাকাকালে তিনি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। গত সরকারের সময় তিনি কলকাতা হাইকমিশনে উপহাইকশিনার হিসেবে কাজ করেছেন। বিগত সরকারের সময় তৈরি করা ডিসির ফিটলিস্টে তাঁর নাম ছিল।
গোপালগঞ্জের ডিসি মো. কামরুজ্জামান বিগত সরকারের আস্থাভাজন হওয়ায় সৌদি আরবে কনসাল জেনারেল পদে নিয়োগ পেয়েছেন। রাজউকের পরিচালক ও হজ অফিসার হিসেবে পোস্টিং পেয়েছেন। গত সরকারের সময় তৈরি করা ডিসির ফিটলিস্টে তাঁর নাম ছিল। সিরাজগঞ্জের ডিসি মোহাম্মদ মনির হোসেন রাজউকের পরিচালক ছিলেন। তিনি সালমান এফ রহমানের সঙ্গে শেয়ারবাজার কারসাজির অপকর্মে জড়িত এবং তাঁর শতকোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জামালপুরের ডিসি হাসিনা বেগম ইউএনও হিসেবে নরসিংদীতে কর্মরত থাকা অবস্থায় তাঁকে তৎকালীন ডিসি অনুপযুক্ত কর্মকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন।
ফরিদপুরের ডিসি মোহাম্মদ কামরুল হাসান মোল্লাহ ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাবেক ডিসি মোমিনুর রহমানের ভাগনি জামাই। বর্তমান ঢাকার ডিসি তানভীর আহমেদের ভগ্নিপতি। পদোন্নতির পরপরই তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের মাজারে ফুল দিতে গিয়েছেন। গত সরকারের সময় তৈরি করা ডিসির ফিটলিস্টে তাঁর নাম ছিল। শরীয়তপুরের ডিসি আবদুল আজিজ সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রীর একান্ত সচিব ছিলেন। পদোন্নতি পেয়ে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের মাজারে ফুল দিতে গিয়েছেন। পঞ্চগড়ের ডিসি মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রাহমাতুল মুনিমের পিএস ছিলেন।
লালমনিরহাটের ডিসি রকিব হায়দার উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের মাজারে ফুল দিয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি একসময় মেট্রোরেল প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। গত সরকারের সময় তৈরি করা ডিসির ফিটলিস্টে বরগুনার ডিসি মোহাম্মদ শফিউল আলমের নাম ছিল। নীলফামারীর ডিসি শরীফা হকের মাঠ প্রশাসনে মাত্র এক বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিগত সরকারের সময় গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন তিনি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান গণমাধ্যম কে বলেন, তারা আমাদের ভুল তথ্য দিয়েছে কিংবা সঠিক তথ্য গোপন করেছে। আমরা সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছি। যথেষ্ট সচেতন। তারপরও মানুষ হিসেবে ভুল হতেই পারে। কোথাও কোনো অনিয়ম থাকলে ধরিয়ে দেবেন, ব্যবস্থা নেব।
সিনিয়র সচিব বলেন, গণমাধ্যম ও এজেন্সির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আমরা বুধবার আটজন ডিসির নিয়োগ বাতিল করেছি। এর আগে মঙ্গলবার একজন ডিসির নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। তারা কর্মস্থলে যোগদানের আগেই নিয়োগ বাতিল করা হলো। তাদের বিষয়ে নিয়োগ কমিটিতে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা হয়নি। আমাদের মধ্যে দুষ্ট লোকের তো অভাব নেই।