নিজস্ব প্রতিবেদক : কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) প্রায় এক ডজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। এসব অভিযোগের প্রমাণও পেয়েছে পেট্রোবাংলার উচ্চ পর্যায়ের কমিটি। শিল্প-কারখানায় গ্যাস চুরি, নিয়োগ-বদলি, পদোন্নতিতে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ ১২টি অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করেছে কমিটি। তদন্তে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তার নির্দেশে কেজিডিসিএলে রীতিমতো সিন্ডিকেট করে দুর্নীতি-অনিয়ম করা হয় বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশও করা হয়। কিন্তু সেই সুপারিশ আলোর মুখ দেখেনি। উলটো অভিযুক্তদেরই একজন এখন কেজিডিসিএলের এমডি বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক হতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।
বিভিন্ন অভিযোগ তদন্তে পেট্রোবাংলার গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন সংস্থার পরিচালক (পরিকল্পনা) আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ। এছাড়া মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) মো. নজরুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) ডিএম জোবায়েদ হোসেনকে সদস্য ও মহাব্যবস্থাপক (সংস্থাপন) মো. আমজাদ হোসেনকে সদস্য সচিব করা হয়।
তদন্ত কমিটি ২০২২ সালের মাঝামাঝি অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে। কমিটি যাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন-প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) (তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক-বিপণন (দক্ষিণ) প্রকৌশলী আমিনুর রহমান, মহাব্যবস্থাপক (কোম্পানি সচিব) মো. ফিরোজ খান, মহাব্যবস্থাপক (বিপণন-উত্তর) মো. শফিউল আজম খান, ব্যবস্থাপক বাসুদেব বিশ্বাস, মো. হাবিবুল গণি, উপমহাব্যবস্থাপক এজেএম ছালেহ উদ্দিন সারওয়ার প্রমুখ। কমিটির সুপারিশের দেড় বছর পরও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
৩১ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘জনবল স্বল্পতার কারণে মহাব্যবস্থাপক মো. আমিনুর রহমানকে ৩টি বিভাগ-বিপণন-দক্ষিণ, ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ও অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোম্পানিতে যোগ্যতাসম্পন্ন বেশ কয়েকজন উপ-মহাব্যবস্থাপক থাকলেও আমিনুর রহমানকে একাই ৩টি মহাব্যবস্থাপক পদে এবং শুধু শফিউল আজমকে প্রকল্প পরিচালক এবং ১টি মহাব্যবস্থাপক পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
তদন্ত কমিটি বলেছে, অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নিয়মবহির্ভূতভাবে একই ব্যক্তিকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন এবং বিনা কারণে কোম্পানির মিটার পরীক্ষণ কমিটিসহ বিভিন্ন গুররুত্বপূর্ণ কমিটি পরিবর্তন করে বারবার কমিটি পুনর্গঠন উদ্দেশ্যমূলক। অন্যদিকে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত ভিডিও ক্লিপে দেখা গেছে, ‘আমিনুর রহমান পেট্রোবাংলার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ টিভি সাংবাদকর্মীকে ঘুস দিতে গমন করেন। তারপরও তার বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত হয়নি বরং তাকে তিনটি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, মহাব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান কেজিডিসিএল’র দীর্ঘদিনের লুটপাটকারী সিন্ডিকেট চক্রের অন্যতন সদস্য। মেসার্স জিন্স এক্সপ্রেস লিমিটেডের শিল্প ও ক্যাপটিভ সংযোগের ক্ষেত্রে বিশাল জালিয়াতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। বকেয়ার দায়ে কোম্পানির গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকা অবস্থায় গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ করে দিতেও তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) প্রকৌশলী আমিনুর রহমান গণমাধ্যমে জানান, ‘রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া মনিরুজ্জামান নামে একজন ডাইরেক্টর টাকা খাওয়ার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। টাকা না দেওয়াতে আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে আরেকটা কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে কোনো কিছু না পাওয়াতে আমাদের রিলিজ দেওয়া হবে।’
তদন্ত কমিটি বলেছে, গ্যাস বিপণন নীতিমালা-২০১৪ ও বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় হতে জারি করা পরিপত্রের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, নিয়মানুযায়ী বকেয়া গ্যাস বিল আদায় না করে এবং কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদকে পাশ কাটিয়ে নতুন সংযোগ বা পুনঃসংযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে একদিকে নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছে। অপরদিকে কোম্পানি তথা রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এজন্য দায়ী কেজিডিসিএলের বিপণন-দক্ষিণ ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌ. মো. আমিনুর রহমান, বিপণন-উত্তর ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক (চ.দা) প্রকৌ. সফিউল আজম খান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মাজেদ।
এছাড়া ফিরোজ খান কেজিডিসিএলে মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) হিসাবে প্রায় দীর্ঘ ৭ বছর প্রেষণে কর্মরত থেকে নিয়মবহির্ভূত ও ইচ্ছামাফিক কর্মকাণ্ড চালাতে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। তিনি ওই সিন্ডিকেটের মূল পরিকল্পনাকারী হিসাবে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন।
কোম্পানিতে যোগ্যতাসম্পন্ন কারিগরি কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য একই ব্যক্তিকে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন, কোম্পানির বিভিন্ন বিভাগের দক্ষ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত মিটার পরীক্ষণ কমিটি বাতিল করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে শুধু মার্কেটিং বিভাগের চিহ্নিত অসাধু কর্মকর্তাদের নিয়ে কমিটি পুনর্গঠন করেন।
নতুন জনবল নিয়োগে গড়িমসি ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে কোম্পানিতে দক্ষ জনবলের ঘাটতির মাধ্যমে স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি; কোম্পানির নির্ধারিত পদোন্নতি কমিটির সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও সাধারণ ক্যাডারের সহকারী ব্যবস্থাপকদের পদোন্নতি না দেওয়া, শূন্যপদে জনবল নিয়োগের বিষয়ে সুস্পষ্ট সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও কমিটির সুপারিশ গ্রহণ ছাড়া কোম্পানি পর্যায়েই প্রার্থী নির্বাচন-বাছাই করে প্যানেল হতে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া, কোম্পানির বোর্ড মিটিংয়ের আলোচনা অনুযায়ী তদন্ত কমিটি গঠন না করে সুকৌশলে কার্যবিবরণী উপস্থাপন করে পর্ষদ চেয়ারম্যানের অনুমোদন গ্রহণ করেন।
এসব কার্যক্রমের জন্য মো. ফিরোজ খান, মহাব্যবস্থাপকের (প্রশাসন) বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিটি সুপারিশ করে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।