নিজস্ব প্রতিবেদক : বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার ওপর মারণাস্ত্র প্রয়োগের নির্দেশ ও হত্যা করার অভিযোগে দায়ের হওয়া বিভিন্ন মামলায় সাবেক মন্ত্রী-এমপি, পুলিশ কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতাসহ অনেকেই একের পর এক গ্রেপ্তার হচ্ছেন। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদকালে পুলিশের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তারা এসব করেছেন। আর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, তারা মাঠপর্যায়ে এমন নির্দেশনা দিয়েছেন সরকারের শীর্ষপর্যায়ের নির্দেশে। গ্রেপ্তার সাবেক মন্ত্রী-এমপি, রাজনৈতিক নেতারাও বলছেন, সরকারের শীর্ষপর্যায়ের নির্দেশেই ছাত্র-জনতার আন্দোলনকালে মারণাস্ত্র প্রয়োগ ও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। এক্ষেত্রে বিশেষ করে দায় চাপানো হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের ওপর। অধিকাংশ মামলাতেও তাদের আসামি করা হয়েছে। কিন্তু এ তিনজনের কাউকেই এ পর্যন্ত আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।
গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ ও রিমান্ড শেষে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ১৩ মন্ত্রী, এমপি ও উপদেষ্টাকে ইতোমধ্যে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রাজনৈতিক নেতার পাশাপাশি সাবেক দুই পুলিশ মহাপরিদর্শকসহ (আইজিপি) সাত পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন একটি পত্রিকার সম্পাদক ও একটি টেলিভিশনের সিইওসহ ৫ সাংবাদিক।
পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মামলার আসামিদের ধাপে ধাপে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। শুরুতে রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার করা হলেও ধাপে ধাপে পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিকরাও গ্রেপ্তার হচ্ছেন। গ্রেপ্তারের পর রিমান্ড ও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও উপদেষ্টারা জুলাই-আগস্ট হত্যাকা-সহ অপরাধের দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা দায় চাপাচ্ছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের ওপর। গ্রেপ্তার মধ্যম সারির পুলিশ কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, আইজিপি এবং ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ পালন করেছেন তারা। জিজ্ঞাসাবাদে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের ভাষ্য ছিল, তিনি সরকারের আদেশ পালন করেছেন। তবে আরেক সাবেক
আইজিপি একেএম শহীদুল হক রিমান্ডে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। রিমান্ডে একই দাবি করেছেন সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াও।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক মন্ত্রী-এমপি, উপদেষ্টার মধ্যে গত ১৪ আগস্ট ঢাকার নিকুঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার হন সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু এবং সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা দীপু মনি, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক পর্যটন ও বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, শেখ হাসিনার সাবেক জ্বালানি, খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং সাবেক এমপি এনামুল হককে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পর থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক মাস ১০ দিনে সারাদেশে এক হাজার ১৩টি মামলা হয়েছে। যার অধিকাংশই হত্যা মামলা।
জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ১৭৭টি মামলার মধ্যে হত্যা মামলা ১৫৭টি। মামলায় পুলিশের ৩৮৮ জন সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। আসামির তালিকায় রয়েছেন সাবেক তিন আইজিপি, সাবেক দুই ডিএমপি কমিশনার ও র?্যাবের সাবেক দুই মহাপরিচালক। এ ছাড়া এসবি ও সিআইডির সাবেক প্রধানকে খুনের মামলার আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার ৬ জন, ডিআইজি পদমর্যাদার ১১ জন ও এসপি পদমর্যাদার ১৪ জন পুলিশের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা মামলার আসামি হয়েছেন।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় গুলিতে পুলিশের এসআই মো. ময়নাল হোসেন ভূঁইয়ার কলেজপড়ুয়া ছেলে ইমাম হাসান তাইম হত্যাকা-ে গত সোমবার শাহবাগ থানার এসআই শাহাদাৎ আলীকে ৬ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। একই মামলায় গত সোমবার গ্রেপ্তার হয়েছেন যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান।
সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ও একেএম শহীদুল হককে গত ৩ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তারের পর হত্যা মামলায় ৮ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ড শেষে ১২ সেপ্টেম্বর চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে কারাগারে পাঠান আদালত। রিমান্ড শেষে ১১ সেপ্টেম্বর শহীদুল হককে কারাগারে পাঠানো হয়। গতকাল মঙ্গলবার চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে আরও ছয়টি হত্যা মামলায় ও শহীদুল হককে একটি অপহরণ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। অপহরণ মামলায় গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের পর গতকাল আশুলিয়া থানার হত্যাচেষ্টার মামলায় বরখাস্ত হওয়া ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফীকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এর আগে ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের সাবেক ডিসি মোহাম্মদ ইকবালকে আটক করা হয়। হত্যা মামলায় বর্তমানে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রিমান্ডে রয়েছেন সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
পুলিশ জানিয়েছে, ময়মনসিংহের ধোবাউড়া সীমান্ত হয়ে অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার সময় গত সোমবার একাত্তর টিভির সিইও মোজাম্মেল বাবু ও ভোরের কাগজ পত্রিকার সম্পাদক শ্যামল দত্তসহ চারজনকে আটক করা হয়। আটক অন্য দুজন হলেনÑ একাত্তর টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মাহবুবুর রহমান ও প্রাইভেট কারের চালক সেলিম। এর আগে গত ২১ আগস্ট একাত্তর টেলিভিশনের চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া বার্তাপ্রধান শাকিল আহমেদ ও প্রধান প্রতিবেদক-উপস্থাপক ফারজানা রুপাকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নেয় পুলিশ।
এদিকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে হত্যা মামলা দেওয়ার নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় দৈনিকগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ। অভিযুক্ত সাংবাদিকদের কোনো সংশ্লিষ্টতা না পাওয়া গেলে এসব মামলা থেকে দ্রুত তাদের অব্যাহতি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যা ও হত্যাকা-ের হুকুম দেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। কয়েকটি মামলার আসামি হয়েছেন সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। এ ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ৩৫০ আসনের অধিকাংশ এমপিই মামলার আসামি হয়েছেন। সাবেক মন্ত্রী, এমপি, সরকারি কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের নেতাসহ কয়েকশ আসামি এখনও অধরা। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে বলে জানা গেছে।