হোঁচট খাবে রপ্তানি

অর্থনীতি এইমাত্র জাতীয় বানিজ্য

বিদ্যুতের দাম বাড়ায় ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষ

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : দুই বছর পর আবারো বাড়লো বিদ্যুতের দাম। মার্চ থেকে গ্রাহককে ইউনিট প্রতি দাম বেশি দিতে হবে ৩৬ পয়সা। অর্থাৎ খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫.৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা করা হয়েছে। এ দিকে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করায় ক্ষুব্ধ কৃষকসহ সারা দেশের সাধারণ মানুষ। জনগণের পকেট কাটতেই বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয় বলেই বর্তমান লুটেরা সরকার জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করতে চায় না দাবি করেছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনীতিক দলের নেতরা। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খাওয়া দেশের রপ্তানি খাতের উপর বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, এমনিতেই আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ধারাবাহিকভাবে কমছে। সেখানে বিদ্যুতের দাম বাড়লে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। তখন বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর নানা অনিয়ম, সিস্টেম লস ও অদক্ষতার কারণে যে ক্ষতি তা পোষাতে গ্রাহকের উপর বাড়তি দামের বোঝা চাপানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
বিএনপি, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির (একাংশ), গণসংহতি আন্দোলনসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ১১ বছরে ৯ বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। জনগণকে শোষণ করে আওয়ামী সিন্ডিকেটের মুনাফার জন্য সরকার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করেছে বলে দাবি করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
২০ দলীয় জোটের শরিক লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি-এলডিপির (একাংশ) সভাপতি আবদুল করিম আব্বাসী ও মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেছেন, জনগণের পকেট কাটতেই বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণাকে যুক্তিহীন ও একপেশে অভিহিত করে বর্ধিত দাম প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি, সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন। দুর্নীতির টাকা যোগান দিতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় শিল্প খাতগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। একই ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পোশাক শিল্প মালিক সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি। বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির মতো ব্যয়ভার বহন করা এখন শিল্পের জন্য কষ্টকর বলে মন্তব্য করেছেন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক। রাজধানীর উত্তরা আব্দুল্লাহ পুরের বাসিন্দা মো: সাহেব আলী (৪৫) বলেন, সরকার ভোটের আগে ভালো কথা বলে। ভোট শেষ হলে জনগনের ওপর বিদ্যুতের বোঝা চাপিয়ে দেয়। এটা বন্ধ করা উচিত।
রাজধানীর মতিঝিল এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী জাহেদুল ইসলাম বলেন, সরকারের জনপ্রিয়তা নষ্ট করার জন্য এ গুলো করা হচ্ছে। আমার মতে প্রধানমন্ত্রীর উচিত দেশের স্বার্থে জনগণের স্বাথে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি বন্ধ করা।
গত বৃহস্পতিবার বিকালে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির আদেশ ঘোষণা করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। মাত্রাতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা কমাতে তেলভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ না বাড়ানোরও আদেশ দিয়েছে বিইআরসি। অন্যদিকে দাম কমাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছে ভোক্তারা। আর দাম বাড়ানোকে অন্যায় বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। গত ডিসেম্বরের গণশুনানিতে ভোক্তা প্রতিনিধিদের করা আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্য হলো। সংবাদ সম্মেলনে ইউনিট প্রতি ৩৬ পয়সা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আদেশ ঘোষণা করেছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন।
সবশেষ ২০১৭ সালের নভেম্বরে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করে আদেশ দিয়েছিল এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। মার্চ থেকে কার্যকর হবে নতুন এই বিদ্যুতের দাম। ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৩৬ পয়সা। অর্থাৎ খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫.৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা করা হয়েছে। খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে দাম ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানোয় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনতে হবে গড়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সায়। বিদ্যমান হারে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম পড়ছে গড়ে ৬ টাকা ৭৭ পয়সা। এদিকে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী মার্চ থেকে বর্ধিত এ মূল্য কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
কমিশনের আদেশে বলা হয়, আবাসিকের লাইফ লাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ টাকা ৭৫ পয়সা (শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট), সাধারণ গ্রাহকদের ক্ষেত্রে ৩ টাকা ৭৫ পয়সা (শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট), এরপর সাধারণ গ্রাহকদের প্রথম ধাপে ৪ টাকা ১৯ পয়সা, দ্বিতীয় ধাপে ৫ টাকা ৭২ পয়সা (৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট), তৃতীয় ধাপে ৬ টাকা (২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট), চতুর্থ ধাপে ৬ টাকা ৩৪ পয়সা (৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিট), পঞ্চম ধাপে ৯ টাকা ৯৪ পয়সা (৪০১ থেকে ৬০০) ও ষষ্ঠ ধাপে ১১ টাকা ৪৬ পয়সা (৬০০ ইউনিটের ঊর্ধ্বে)। সেচ বা কৃষিকাজে ব্যবহূত প্রতি ইউনিট ৪ টাকা ১৬ পয়সা। ক্ষুদ্র শিল্পের ক্ষেত্রে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম গড়ে ৮ টাকা ৫৩ পয়সা। নির্মাণ খাতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ১২ টাকা। শিক্ষা, ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের ক্ষেত্রে ৬ টাকা ২ পয়সা। রাস্তার বাতি ও পানির পাম্পের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৭ টাকা ৭০ পয়সা। ব্যাটারি চার্জিং স্টেশনের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট গড়ে ৭ টাকা ৬৪ পয়সা। বাণিজ্যিক ও অফিসের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট ঘণ্টায় গড়ে ১০ টাকা ৩০ পয়সা। এছাড়া অস্থায়ী ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে প্রতি ইউনিট ১৬ টাকা। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রভাব মূল্যায়নে কমিশন জানিয়েছে, লাইফ লাইন গ্রাহকের (আবাসিক) ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিল বাবদ ব্যয় বাড়বে মাসে ৫ থেকে ১৭ দশমিক ৫০ টাকা।
নতুন মূল্যহার অনুযায়ী, নি¤œ মধ্যবিত্ত গ্রাহকের (আবাসিক) গড়ে মাসে বিল বৃদ্ধি পাবে ৪৪ টাকা (প্রায় ৫ দশমিক ৯ শতাংশ), মধ্যবিত্ত গ্রাহক (আবাসিক) বিল বৃদ্ধি পাবে গড়ে ১১৪ টাকা (প্রায় ৫ দশমিক ৮ শতাংশ), সেচ গ্রাহকদের বাড়বে ১৮৮ টাকা (৫ দশমিক ৮ শতাংশ), ক্ষুদ্র শিল্প গ্রাহক ৮১০ টাকা (৪ দশমিক ৯ শতাংশ), মাঝারি শিল্প গ্রাহকের ১৭ হাজার ৩৪০ টাকা (প্রায় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ), বৃহৎ শিল্প গ্রাহকের জন্য ৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা (প্রায় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ)।
বৃহস্পতিবার বিইআরসির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির এ ঘোষণা দেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল। নতুন মূল্যহার অনুযায়ী, পাইকারি বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ টাকা ১৭ পয়সা করা হয়েছে, যা আগে ছিল ৪ টাকা ৭৭ পয়সা। এছাড়া বিদ্যুতের সঞ্চালন মূল্য বা হুইলিং চার্জ ভারিত গড় শূন্য দশমিক ২৭৮৭ টাকা থেকে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িয়ে শূন্য দশমিক ২৯৩৪ টাকা করা হয়েছে। বিদ্যুতের এমন দাম বৃদ্ধির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমদানিকৃত কয়লার ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট ধার্য, ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ বৃদ্ধি, অপচয় ব্যয় বৃদ্ধি, তুলনামূলক কম মূল্যে পল্লী বিদ্যুতের অধীনে সমিতিগুলোর অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ ক্রয় বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে দাম বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া ঋণের অর্থে যেসব বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হয়েছিল, সেগুলোর সুদ পরিশোধ ও প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের ওপর ১০ পয়সা হারে ডিমান্ড চার্জও বিদ্যুতের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ।
গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ার প্রভাব সম্পর্কে বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, তার ৫৮ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ ক্রয় করেন পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকরা। তাদের জন্য আমরা ৩ টাকা ৭৫ পয়সা প্রতি ইউনিটের মূল্য নির্ধারণ করেছি। বিদ্যুৎ না কিনেও কেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার প্রভাবে দাম বেড়েছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে কমিশন সদস্য বজলুর রহমান বলেন, চুক্তি অনুযায়ী যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ রয়েছে, সেগুলো মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত থাকবে। আর মেয়াদ শেষ হওয়া কেন্দ্রগুলোর যাতে আর মেয়াদ বৃদ্ধি করা না হয়, সেজন্য কমিশনের আদেশে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিদ্যুতের মূল্যহার পরিবর্তনে বিতরণ ও সঞ্চালন কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবের ওপর গত বছরের ২৮ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত গণশুনানির আয়োজন করে বিইআরসি। ৯০ দিনের মধ্যে কমিশনের সিদ্ধান্ত জানানোর বিধান রয়েছে।
২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়। সে সময় ইউনিট প্রতি ৩৫ পয়সা বা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হারে মূল্য বাড়ানো হয়, যা একই বছরের ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়। তবে ওই সময় পাইকারি বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়নি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে পাইকারি বিদ্যুতের মূল্য ১৮ দশমিক ১২ শতাংশ বাড়ানো হয়।
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, এ রকম অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বাড়ায় প্রতিযোগিতা সক্ষমতা নিয়ে মারাত্মক সঙ্কটের মধ্যে পড়বে রফতানিমুখি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। আর স্থানীয় বাজারনির্ভর শিল্পগুলো রুগ্ন হয়ে যাবে।
হোঁচট খাবে রপ্তানি : বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খাওয়া দেশের রপ্তানি খাতের উপর বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।
তারা বলছেন, এমনিতেই আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ধারাবাহিকভাবে কমছে। সেখানে বিদ্যুতের দাম বাড়লে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। তখন বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর নানা অনিয়ম, সিস্টেম লস ও অদক্ষতার কারণে যে ক্ষতি তা পোষাতে গ্রাহকের উপর বাড়তি দামের বোঝা চাপানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বলেন, গত চার বছরে ধাপে ধাপে পোশাক খাতে উৎপাদন ব্যয় ২৯ দশমিক ৪০ শতাংশ বেড়ে গেল। উল্টোদিকে বাজারে পণ্যের দাম ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি কিংবা অন্য যে কোনো পর্যায়ে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির ধাক্কা সহ্য করার মতো সক্ষমতা পোশাক শিল্পের নেই।
রপ্তানি আয়ে ফের ধাক্কা : রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি আয় ছিল ৪ হাজার ৫৩ কোটি ৫০ লাখ (৪০.৫৩ বিলিয়ন) ডলারের বেশি, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ১০ শতাংশ বেশি। এই আয়ের ৮৪ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তবে চলতি অর্থবছরে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি উল্টো পথে হাঁটছে। প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ২ হাজার ২৯২ কোটি ডলারের ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ২১ শতাংশ কম।
বৃহস্পতিবার খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের নতুন যে মূল্যহার ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে স্ল্যাব অনুযায়ী ক্ষুদ্র শিল্পে বিদ্যুৎ বিল ১৬ হাজার ৫৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১৭ ৩৬০ টাকা, মাঝারি শিল্পের ৩ লাখ ২৬ হাজার টাকা থেকে ৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা ও বৃহৎ শিল্পে এক কোটি ৬২ লাখ ৪০ হাজার টাকা থেকে এক কোটি ৭১ লাখ ৪০ হাজার টাকা হবে বলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসির চেয়ারম্যান একটি হিসাব দিয়েছেন।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পর পরই বিএনপি ও বামদলগুলোসহ বিভিন্ন অঙ্গন থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। মূল্য বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাহারের দাবি তুলেছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাব।
বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়ে চাহিদার তুলনায় প্রবৃদ্ধি হওয়ার পরেও দাম না কমে উল্টো বাড়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন বেঙ্গল প্লাস্টিকস ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম কর্ণধার জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, বিদ্যুতের এই মূল্যবৃদ্ধি প্লাস্টিক শিল্পে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই মুহূর্তে ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটটা খানিকটা ‘ভোলাটাইল’। এর সঙ্গে যোগ হল বিদ্যুতের বাড়তি দাম। এখন উৎপাদনের খরচ বাড়বে, ফলে প্লাস্টিক পণ্যের দাম বেড়ে যাবে।
আমরা পণ্যের মূল্য ও কোয়ালিটির ক্ষেত্রে বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতায় রয়েছি। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি সেই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেবে। কারণ উৎপাদন খরচ বাড়ার বিপরীতে বাজারে পণ্যের দাম বাড়ছে না, বরং কমছে। আস্তে আস্তে বাংলাদেশ বিশ্ববাজার থেকে আউট হয়ে যাবে। বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর স্তরে স্তরে দুর্নীতির অভিযোগ করে আসছেন ভোক্তা নেতারা। বিষয়টি সরাসরি না উল্লেখ না করলেও কোম্পানির অনিয়ম, সিস্টেম লস ও অদক্ষতার প্রভাবে এ ধরনের মূল্য বৃদ্ধির ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের এই সাবেক সহ-সভাপতি।
সরকার ‘কোয়ালিটি বিদ্যুৎ’ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূরণ না করেই কিছু দিন পর পর দাম বাড়িয়ে চলেছে মন্তব্য করেন এই উদ্যোক্তা।
এখনও কোয়ালিটি বিদ্যুৎ নেই। উৎপাদন বাড়লেও বিতরণ লাইনগুলোর সক্ষমতা নেই। তাই বড় কারখানাগুলোতে লোডশেডিং ম্যানেজমেন্টের জন্য জেনারেটর চালাতে হচ্ছে।
দেশের অন্যতম রপ্তানি খাত চামড়া শিল্পের উদ্যোক্তা সমতা লেদার কমপ্লেক্সের নির্বাহী পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, এই শিল্পের উৎপাদন ব্যাপকহারে বিদ্যুৎনির্ভর। তাই নতুন করে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে এই খাতের উৎপাদন খরচও অনেক বেড়ে যাবে।
নিজের কারখানার চিত্র তুলে ধরে তিনি তিনি বলেন, আমরা হিসাব করে দেখেছি, সব ধরনের চার্জ মিলিয়ে এতোদিন প্রতি ইউনিট ৮ টাকা ৫০ পয়সা হারে বিদ্যুতের বিল দিয়ে এসেছি। মাসে গড়ে চার লাখ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা বিল দিতে হয়েছে। এখন এর সঙ্গে প্রায় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বর্ধিত মূল্য যোগ হচ্ছে। আমরা এর প্রভাব ক্যালকুলেশনের জন্য হিসাব-নিকাশ করছি।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *