নিজস্ব প্রতিবেদক : পতিত স্বৈরাচার সরকারের দুর্নীতির সদর দপ্তর ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যোগসাজস ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ঘনিষ্ঠ দোসরদের ভয়াবহ এক সিন্ডিকেটের কবলে আবদ্ধ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এই সিন্ডিকেট নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য’ মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়ম করেছে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটিতে। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ সহ উচ্চ আদালতে রয়েছে একাধিক রিট ও মামলা। কিছুতেই যেনো কিছু হয়না তাদের।
স্বৈরাচার সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে তার সহচর হিসেবে পরিচিত ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ এই সিন্ডিকেটের কুটুকৌশলে জিম্মি হয়েছিল বিগত সময়ের মহাপরিচালকরাও। বিগত ফ্যাসিবাদ সরকারের আমলে দুর্নীতিবাজ ওই সিন্ডিকেট জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমলাদের ছত্রছায়ায় মহা পরিচালকদের তোয়াক্কা না করেই চালাতেন অনিয়ম ও দুর্নীতি।
এই সিন্ডিকেটে চার খলিফার নাম উল্লেখযোগ্য। পরিচালক পদে যুগ্ম সচিব মোজাম্মেল হক যিনি সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রীর ভাগ্নে ও সাবেক বিচারপতির ধর্ম পুত্র পরিচয়ে ফায়ার সার্ভিসের এই গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি পেয়েছিলেন। সিন্ডিকেটর আরেক দোসর এডি আনোয়ার হোসেন (ওয়্যারহাউস) কয়েক বছর ধরে ঢাকায় একই চেয়ারে কর্মরত। হাজারো দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও রয়েছেন বহাল তবিয়তে। এছাড়াও ডিডি সালাউদ্দিন ঢাকা, এডি আনোয়ার ঢাকা, সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব ও মন্ত্রীর অন্যতম সহযোগী হিসেবে পরিচিত হওয়ায় তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পাইনি। ফায়ার সার্ভিসের এই চার কর্মকর্তাই সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব আব্দুল্লাহ আল মাসুদের দুর্নীতির অর্থের কালেক্টর হিসেবে কাজ করত ফায়ার সার্ভিসের দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড এই চার খলিফা।
(ওয়্যার হাউজ) এডি আনোয়ার হোসেনের দুর্নীতি : ওয়্যারহাউজ ও ফায়ার প্রিভেনশন সহকারী পরিচালক মোঃ আনোয়ার হোসেন ঘুষ দুর্নীতি ও লুটপাটের অপতিরোধ্য রাজত্ব গড়ে তুলে অধিদপ্তরে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে আঁকড়ে রয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ। ক্ষমতাসীন এই মন্ত্রীর ছাত্রছায়ায় তিনি এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন যে অধিদপ্তরের ডিজিকেও পরোয়া করতেন না। বিগত দিনে আনোয়ার হোসেনের ঘুষ দুর্নীতির চিত্র নিয়ে অসংখ্য সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পরেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন তিনি।
ছাত্র জনতার আন্দোলনে দেশের সকল প্রতিষ্ঠানের পটভূমি বদলেও বদলায়নি আনোয়ার হোসেনের ঘুষ বাণিজ্য ও অনিয়মের রথ। বরং দিনকে দিন যেন আরও লাগামহীন হয়ে উঠেছে। বহুতল বিল্ডিং এর সব মালিকরা তার হাতে জিম্মি। আনোয়ার হোসেনের টেবিলে চলে কোটি কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য।
রাজধানী ঢাকার বহুতল ভবন বিল্ডিং নির্মাণের জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ছাড়পত্রের প্রয়োজন বিধিতে থাকলেও আনোয়ার এর পক্ষ থেকে মানা হচ্ছে না তার কানাকড়িও। যেকোনো বিল্ডিং সাত তলার উপরে করতে হলে তাদের প্রত্যেকেরই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের অনুমোদন অর্থাৎ ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক নিতে হবে। আর এই ছাড়পত্র প্রদানের দায়িত্বে রয়েছে মোঃ আনোয়ার হোসেন, সহকারী পরিচালক (ওয়্যারহাউস)।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেন তাদের প্রত্যেকেই মোঃ আনোয়ার হোসেনকে ২/৩ লক্ষ টাকা ঘুষ প্রদান করতে হয়। ঘুষের টাকা দেয়া না হলে মাসের পর মাস ঘুরতে হয় ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য, তারপরও মেলেনা কাঙ্খিত ছাড়পত্র। অন্যদিকে সেফটি প্লান বিদ্যমান ভবনের সেফটি প্ল্যান বাবদ ৩ থেকে ৫ লক্ষ টাকা ঘুষ নেন এই মোঃ আনোয়ার হোসেন। কাঙ্খিত ঘুস প্রদান না করা হলে ফাইল আটকে রেখে ওইসব ভবন মালিকদের কে এক প্রকারে জিমি রাখা হয়।
স্বৈরাচারের দোসর প্রধান বিচারপতির ধর্ম ছেলে পরিচয় মোজাম্মেলের অধর্ম : সরাসরি ফেসিস্ট শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে প্রশাসন ও আমলাদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। পাতানো নির্বাচন আর ক্ষমতা ঠিকিয়ে রাখতে যেসব আমলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব আব্দুল্লাহ আল মাসুদ প্রধান বিচারপতি অন্যতম দোসর হিসেবে পরিচিত। শেখ হাসিনার এসব দোসরদের অতি ঘনিষ্ঠজন ও আত্মীয় হিসেবে পরিচালিত উপসচিব মোজাম্মেল হকের গল্প অনেকেরই অজানা।
নিজেকে কখনো পরিচয় দিতেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের ধর্ম ছেলে, আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মোঃ আবদুল্লাহ আল মাসুদ’ চৌধুরীর ভাগ্নে হিসেবে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের এই দোসর নিজেকে ক্ষমতাবান হিসেবে জাহির করতেন।
ফায়ার সার্ভিসে আসার আগে সমবায় অধিদপ্তর থেকে দীর্ঘ সময় খামখেয়ালী ভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, পরে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তর স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার দোসর সিন্ডিকেট তাকে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অর্থ প্রশাসন) পদে বদলি পায় উপসচিব মোজাম্মেল হক।
ফায়ার সার্ভিসে যোগদানের পর প্রায় দুই মাস কোন দায়িত্ব পালন না করেই সরকারি বেতন হজম করেছেন। তৎকালীন সচিব আব্দুল্লাহ আল মাসুদের ভাগ্নে হিসেবে লুটপাট আর দুর্নীতির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেন। ফায়ার সার্ভিসের গুরুত্বপূর্ণ এই পদে নিয়ম না মেনেই বদলি দেয়া হয়েছিল মোজাম্মেল হককে। বদলির পর থেকেই তিনি তার ঘনিষ্ঠ আমলাদের ক্ষমতা খাটিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার চরম উদাহরণ দেখিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়, খোদ মহাপরিচালককেও পাত্তা দিতেন না। বরং তার সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করতেন।
সাবেক মহাপরিচালক থেকে শুরু করে সকল কর্মকর্তাদের নিজের ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে তটস্থ রাখতেন মোজাম্মেল। প্রধান বিচারপতি ও স্বরাষ্ট্র সচিবের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে নিজেকে জাহির করায় তাকে কেউ কিছু বলার মত সাহস ছিল না। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে সাবে ক স্বৈরাচার সরকারের প্রধাঞ্জসর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। প্রতি সপ্তাহে পরিবার নিয়ে বেড়াতে যেতেন বিচারপতির বাসায়। একাধিক সুত্র জানায় সাবেক বিতর্কিত প্রধান বিচারপতি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার অন্যতম দোসর ওবায়দুল হাসানের পারিবারিক ঘনিষ্ঠজন হিসাবে বেশ পরিচিত উপসচিব মোজাম্মেল হক।
ডিডি ছালেহ উদ্দিন এর স্বাক্ষরের দাম দুই হাজার টাকা : ডিডি ঢাকা ছালেহ উদ্দিন আহমেদ এক ভদ্র বেশে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। সকল নিয়ম যেন তার কক্ষে অসহায় আত্মসমর্পণ করে। ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত ভুক্তভোগী একাধিক সূত্রে জানা গেছে তার একটি স্বাক্ষরের দাম দুই হাজার টাকা।
তার চাহিদামত টাকা না পেলে কোন ফায়ার লাইসেন্সে সই করেন না তিনি। প্রতিদিন ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা সাক্ষর করেই আয় করেন এই কর্মকর্তা। এই পদে বদলি হওয়ার আগ পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারের প্রিন্সিপাল হিসেবে কর্মরত ছিলেন সালাউদ্দিন। সেখানে কেনাকাটা সহ বিভিন্ন খাতে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সালাউদ্দিন ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরে সকলের কাছে মিসকা শয়তান হিসেবে পরিচিত। ভদ্র মুখোশের আড়ালে ততটাই দুর্নীতিগ্রস্ত তিনি।
দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরবর্তী সময়ে আনসার বাহিনী বিদ্রোহ করার কয়েকদিন পর ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরেও মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার একটি পরিকল্পনা হয়েছিল বলে সংবাদ মাধ্যমে তথ্য ফাঁস করেন নাম প্রকাশে অনিশ্চিত একটি বিশ্বস্ত সূত্র। এ নিয়ে বেশ কিছু সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়। সেই বিদ্রোহের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে সালাউদ্দিন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এডি ঢাকা আনোয়ারের দুর্নীতি কাহন : এডি ঢাকা আনোয়ার হোসেনের দুর্নীতির কাহন বেশ বিস্তৃত। তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সালেহ্ উদ্দীনের পথ ধরেই তিনি তার প্রতিটি স্বাক্ষরের মূল্য নির্ধারণ করেছেন ১ হাজার টাকা। প্রতিদিন ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা আয়ের টার্গেটে ফায়ার লাইসেন্স এর স্বাক্ষর করে থাকেন তিনি। ডিডি সালাউদ্দিন ও এডি আনোয়ার হোসেন ওয়্যারহাউস ইন্সপেক্টরদের নিকট মূর্তিমান আতঙ্ক। এটি আনোয়ারের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিজাত থাকার পরেও দীর্ঘদিন ধরে একই পদে রয়েছে তিনি। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের অন্যতম কর্মকর্তা হিসেবে তিনি পরিচিত। বিগত দিনে নিজেকে বড় আওয়ামী লীগের হিসেবে গর্বের সাথে সকলের কাছে পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন।
ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত থাকা দুর্নীতিবাজ এই মাস্টারমাইন্ড সিন্ডিকেট রয়েছে বহাল তবিয়তে। যারা প্রত্যেকেই ফ্যাসিস শেখ হাসিনা সরকারের দোসর হিসেবে পরিচিত।
সারাদেশে সব সেক্টরে স্বৈরাচারীর দোসরদের সংস্কারে পট:পরিবর্তন আসলেও ফায়ার সার্ভিসে গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে কিভাবে বহাল রয়েছেন দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট? এ প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল (এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি) গণমাধ্যম কে বলেন, এ ধরনের কোনো বিষয়ে কারো অন্যায়ভাবে যুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।