বিশেষ প্রতিনিধি : গত এক সপ্তাহে মাজারের বেড়িবাঁধের ২ কোটি টাকার পাথর লুটপাট করা হয়েছে, মাজারের ভেতর থেকে এখন পাথর উত্তোলন চলছে। কবরস্থান মাঠ ও রাস্তা ধ্বংস করা হয়েছে : ঝুঁকিতে রয়েছে মসজিদ, সাত’শত বছরের পুরাতন ‘শাহ আরেফিনের মাজারে চলছে ধ্বংস কাণ্ড।
হযরত শাহ জালাল (রা.) এর সফর সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার একজন হযরত শাহ আরেফিন (রা.)। প্রায় সাত’শত বছর আগে তিনি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার জালিয়ারপাড় গ্রামের পাশে টিলায় বিশ্রামের জন্য আস্তানা গেড়েছিলেন। সেই থেকে এই টিলার নাম হয়ে যায় শাহ আরেফিন টিলা। তিনি যে জায়গায় বসে বিশ্রাম নিয়েছিলেন সেই অংশে কালো পাথরের বিশাল বেড়িবাঁধ দিয়ে আস্তানা তৈরি করা হয়েছিল। অনেকেই এটাকে শাহ আরেফিনের মাজার বলে ডাকেন।
সরকারি ওয়াকফ এস্টেটে ইসি নং ১৭২১০ শাহ আরেফিন (রা.) ও বিন্দিয়া মাজার নামে নিবন্ধন করা হয়েছে। সাত’শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মাজারে এখন ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। আস্তানার চারপাশে কয়েকশ’ বছরের পুরাতন বেড়িবাঁধের কালো পাথরগুলো লুটপাট করা হয়েছে। মাজারে শত শত ফলজ বনজ ও ওষুধিগাছ ইতোমধ্যে কর্তন করা হয়েছে।
২শ’ বছরের পুরাতন বটগাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। মূল মাজার খোঁড়ে এখন পাথর উত্তোলনের হিড়িক চলছে। নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছে শাহ আরেফিন (রা.) এর স্মৃতিবিজড়িত এই স্থানকে।
ঐতিহ্যবাহী এই স্থানে লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ চললেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন প্রদক্ষেপ নেয়া হয়নি। স্থানীয়রা প্রশাসনকে বিষয়টি জানালেও কোন এক অজানা কারণে নিরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছেন তারা।
জানা যায়, ১৩৭ দশমিক ৫ একরের টিলার মধ্যে ১০ একর জায়গা শাহ আরেফিন (রা.) ও বিন্দিয়া মাজারের নামে ওয়াকফ করা। এই দশ একর জায়গায় মাজার মসজিদ কবরস্থান ও একটি মাঠ ছিল। মাঠ ও কবরস্থান তিন মাসে পাথর উত্তোলন করে ইতোমধ্যে বিলিন করে দেয়া হয়েছে। ২ বছর থেকে মসজিদের কার্যক্রম ও নিয়মিত পরিচালিত হচ্ছে না। মসজিদের চারিদিকে পাথর উত্তোলন করায় ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সম্প্রতি গত তিন মাস থেকে মাজারের মূল অংশে পাথর লুটপাট করা হচ্ছে। আর এক সপ্তাহে শুধু মাজারের বেড়িবাঁধ থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকার পাথর লুটপাট করা হয়েছে। তাছাড়া মাজারের মূল অংশ থেকে প্রায় ৪০-৫০ ফুট গর্ত করে পাথর উত্তোলন চলছে। মাঠ মসজিদ ও কবরস্থান হয়ে মাজারে যাওয়ার রাস্তা বিলীন করে দেয়া হয়েছে। ফলে এখন মাজারের ভেতরে গর্ত করে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে।
৯০-এর দশক থেকে শাহ আরেফিন টিলার মাজারের দেখবাল করে আসছেন মহিত শাহ ওরফে লালু শাহ। তিনি জানান- ২০০৭ সালের আগ পর্যন্ত আমার শাশুড়ি বেসরকারিভাবে এই মাজারের খাদিম ছিলেন। এর আগে তার বাবা, তার বাবার বাবা এভাবে ৬ প্রজন্ম পর্যন্ত উনারা খাদিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তারা প্রতি বছর মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ওরস করতেন। সাত সালের পর যখন পাথর উত্তোলন করে মাজার ধ্বংসের পায়তারা শুরু হয় তখন আমি সরকারি ওয়াকফ এস্টেট থেকে নিবন্ধন করি। এরপর ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমি মাজার সংরক্ষণ করে রাখতে পেরেছি। সে সময় মাজার রক্ষায় ডিসি, পরিবেশ, খনিজ মন্ত্রণালয়, এসপি, বেলা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে কোট ফি যুক্ত অভিযোগ দায়ের করি। যার কারণে কেউ মাজার থেকে পাথর উত্তোলন করার সাহস করেনি। পরবর্তীতে মাজারের জায়গা থেকে পাথর উত্তোলন করার জন্য ঢাকাতে গিয়ে নতুন একটি কমিটি গঠন করে নিয়ে আসা হয়। বিষয়টি নিয়ে আমি সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করলে মাজার কমিটির সকল কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। বর্তমানে মাজারকে নিশ্চিহ্ন করতে মাজারের বেড়িবাঁধের সকল পাথর লুটপাট করা হয়েছে। এই পাথরগুলো কয়েকশ বছরের পুরাতন ছিল। একেকটি পাথ ২০ কেজি থেকে প্রায় ১শ’ মন ওজনের ছিল। বড় বড় পাথরগুলো হেমার দিয়ে ভেঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মাজার ধ্বংসকারীরা জানিয়েছে এই মাজারের জন্য নাকি তারা টিলা লিজ আনতে পারছে না। তাই তারা মাজার ধ্বংস করতে শুরু করেছে। মাজার রক্ষায় আমি শীগ্রই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করবো।
স্থানীয় জালিয়ারপাড় গ্রামের হাজী আব্দুল আউয়াল, সাবেক মেম্বার শানুর আলী, আব্দুল করিম জানান, আমরা মাজার রক্ষার জন্য চেষ্টা করছি কিন্তু পারতেছিনা। ইতোপূর্বে মাঠ ও কবরস্থান রক্ষার কথা বলায় আমরা তাদের দুষমনে পরিনত হয়েছি। বর্তমান পরিস্থিতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছি তারা কোন প্রদক্ষেপ নিচ্ছে না। আমরা গ্রামের পক্ষ থেকে মাজার রক্ষায় আইনী প্রদক্ষেপ নিব।
সর্বশেষ ওয়াকফ এস্টেট কর্তৃক কমিটির সভাপতি মো. আনোয়ার আলী (আনাই) জানান, গত ২ বছর আগে আমার কমিটি বিলুপ্ত হয়েছে।
নতুন করে আর কোন কমিটি করা হয়নি। যারা আমার সাথে কমিটিতে ছিল তাদেরকেও ডাকলে পাওয়া যায় না। মাঠ কবরস্থান ও মাজার রক্ষার জন্য আমি জালিয়ারপাড়ের মুরব্বিদের সাথে নিয়ে বার বার চেষ্টা করেও কোন লাভ হচ্ছে না। মাজার রক্ষায় আমরা এখন আইনি প্রদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তা করছি।
খান বাহাদুর এহিয়া ওয়াকফ এস্টেটের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ইসলাম উদ্দিনের যোগাযোগ করলে তিনি জানান, মাজার ধ্বংসের বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। আমাদের শাহ আরেফিনের মাজার ও ওয়াকফের জায়গা রক্ষায় আমার প্রদক্ষেপ নিব। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আমি দেখছি।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আনোয়ার উজ জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট ইউএনওকে আমি বিষয়টি জানাচ্ছি। এ বিষয়ে তাকে প্রদক্ষেপ নিতে বলবো।