# প্রতিমন্ত্রীর চাচা ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের অফিস সহায়ক # অবসরে গিয়েও নিয়ন্ত্রণ করতেন অফিস # শত শত কোটি টাকার সম্পত্তি # অভিযুক্ত অফিস সহায়ক বারেক সরকার সম্পর্কে সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের চাচা # তাঁর নামে প্রতি দলিলে ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হতো #
নিজস্ব প্রতিনিধি (ময়মনসিংহ) : ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের অফিস সহায়ক ছিলেন আব্দুল বারেক সরকার। ২০১৫ সালে অবসরে গিয়েও ৫ আগস্টের আগপর্যন্ত সাবরেজিস্ট্রি অফিস নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। পটপরিবর্তনের পর ভুক্তভোগীরা বলছেন, তাঁর নামে প্রতি দলিলে ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হতো। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারত না। কেননা বারেক সরকার সম্পর্কে সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের চাচা। অনিয়ম-দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
সাবরেজিস্ট্রি অফিস সূত্রে জানা গেছে, নকলনবিশ থেকে পদোন্নতি পেয়ে তারাকান্দা উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের অফিস সহায়ক হয়েছিলেন আব্দুল বারেক সরকার।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বারেক সরকারের বাবা এবং ময়মনসিংহ-২ (তারাকান্দা-ফুলপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের বাবা মামাতো-ফুফাতো ভাই। প্রতিমন্ত্রীর প্রভাবের পাশাপাশি নিজেদের জায়গায় ভাড়ায় সাবরেজিস্ট্রি অফিস পরিচালিত হওয়ায় সেটি এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন বারেক সরকার। অবসরে গেলেও সেই নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিল বলে জানিয়েছে দলিল লেখক সমিতি।
বারেক সরকারের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, তারাকান্দা শহরে ৬০ শতাংশ জমি; উপজেলায় আড়াই একর কৃষিজমি, দুই একর জমির মধ্যে মৎস্যখামার, গ্রামের বাড়িতে বহুতল ভবন এবং ময়মনসিংহ শহরে শেয়ারে ছয়তলা বাড়ি ও মার্কেট রয়েছে বারেক সরকারের। এসবের বাজারমূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
ময়মনসিংহ নগরীর পাটগুদাম এলাকায় ৬ শতাংশ জায়গার মধ্যে ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন বারেক সরকারসহ তিনজন। বাড়ির কেয়ারটেকার মাঈন উদ্দিন বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর তাঁদের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ নেই। তবে বাড়িটির কাজ গত বছর সম্পন্ন হয়েছে। বাড়িটি বাবুল মিয়া সরকার তাঁর ভাই বারেক সরকার এবং তাঁদের ভাগনে আব্দুল করিম নির্মাণ করেছেন।
জমির দলিল করতে গিয়ে ঘুষ দিতে হওয়া ঢাকুয়া গ্রামের আমিন উদ্দিন বলেন, ‘২০২৩ সালে ২০ শতাংশ জমির দলিল করতে আমার অতিরিক্ত ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। দলিল লেখক আমার কাছ থেকে বারেক সরকারের কথা বলে নিয়েছে। ওনার কথা বলায় আমি কাউকে না জানিয়ে চুপচাপ টাকাটা দিয়ে দিয়েছি। না হয় আমার দলিলটাই হতো না।’
স্থানীয় ফজর আলী বলেন, ‘সাবরেজিস্ট্রি অফিসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বারেক সরকার যা করেছেন, তা বলার ভাষা রাখে না। আমরা ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারিনি। এখন সরকার পরিবর্তন হয়েছে। তাঁদের খুঁজে বের করে বিচার করা হোক।’
তারাকান্দা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক সমিতির সভাপতি বিল্লাল হোসাইন বলেন, ‘২০১৮ সালে দলিল লেখক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি। তার আগে থেকেই বারেক সরকারকে দেখেছি অফিস নিয়ন্ত্রণ করতে; যা সরকার পরিবর্তনের আগপর্যন্ত ছিল। তিনি অবসরে গেছেন কি না, আমরা তা জানতাম না। আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর নেওয়া আমার পক্ষে শোভা পায় না। তবে অফিশিয়াল সব কাজ বারেক সরকারই করেছেন।’
তবে আব্দুল বারেক সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘কারও প্রভাব খাটিয়ে বাড়ি-গাড়ি, জায়গা-জমি করিনি। ১১ বছরে মন্ত্রীর সঙ্গে দুই দিন দেখা হয়েছে, সে আমার দোয়া নিয়েছে। তাহলে তাঁর প্রভাব কেমনে খাটিয়েছি। চাকরির পাশাপাশি মাছ চাষ এবং গরুর খামার করে উপার্জন করেছি। পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলেকে মানুষ করেছি মাত্র। সাবরেজিস্ট্রি অফিস আমাদের জায়গায় হওয়ায় মানুষ মনে করে প্রভাব বিস্তার করছি, আসলে তা কিন্তু না।’
তারাকান্দা উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার শেখ নাছিমুল আরিফ বলেন, ‘অফিসটি তাদের (বারেক সরকার) জায়গার মধ্যে। দোতলা ভবনের নিচতলায় আমাদের কার্যক্রম, আর ওপরের তলায় তিনি মাঝেমধ্যে যেতেন। তবে বারেক সরকার অবসরে যাওয়ার পর আমাদের অফিসে তাঁকে খুব একটা পাইনি।’
সাবরেজিস্ট্রার আরও বলেন, ‘দৈনিক ২৫-৩০টি দলিল হয়ে থাকে, যা নিয়ম মেনেই হয়। সেখানে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে ২০২২ সালের আগে কী হয়েছে, তা আমার জানা নেই।’
ময়মনসিংহ দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট এম এ হান্নান খান বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পিয়ন যখন ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়, তাহলে সাবরেজিস্ট্রি অফিসের পিয়ন ২০০ কোটি টাকার মালিক হলে বিষয়টি আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।’