নিজস্ব প্রতিবেদক : ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সময়ে রাজধানীর উত্তরা ছিল অন্যতম ম্যাসাকার স্পট। উত্তরায় বড় ধরনের এ ম্যাসাকারের অন্যতম হোতা ছিল সাবেক এমপি ও চাঁদাবাজ নেতা হাবিব হাসান ও আফসার উদ্দিন খান। তাদের অর্থ জোগানদাতা ছিল উত্তরার প্রায় দিক ব্যবসায়ী। আর এসব দলবাজদের পক্ষ নিয়ে ক্রমাগত প্রচার চালিয়েছে কিছু নামধারী সাংবাদিক।
জানা গেছে— গত ১৭ বছরে এসব সাংবাদিকরা আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করে নানা ধরনের চাঁদাবাজি যেমন করেছে, আবার আন্দোলন সংগ্রামে জামায়াত-বিএনপির বিরুদ্ধে ক্রমাগত ষড়যন্ত্রেও লিপ্ত ছিল তারা। যার ফলশ্রুতিতে ৫ আগস্টের বিপ্লবকালীন সময়ে উত্তরায় এতো রক্তপাত হয়। খুন হয় প্রায় ২৫০ জনের অধিক তাজা প্রাণ। পঙ্গু হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ছাত্র-জনতা।
অভিযোগ আছে— ঢাকা-১৮ আসন এলাকায় বসবাসকারী এসব সাংবাদিকদের অনেককেই প্রতিষ্ঠিত করেছে উত্তরা ফ্যাসিবাদীর অন্যতম হোতা হাবিব হাসান, খসরু চৌধুরী ও আফসার উদ্দিন খান। তাদের সুপারিশে চাকরি পাওয়া এসব সাংবাদিকদের দাপটে কোণঠাসা ছিল বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিকরা। সরকারি দলের একচ্ছত্র চাঁদার ভাগ পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠে নামধারী এসব সাংবাদিক। তারা বিভিন্ন সময় বিরোধী সাংবাদিকদের জামায়াত বিএনপি ট্যাগ লাগিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে হয়রানি করতেও দ্বিধা করেনি। ওপেন চাঁদাবাজিসহ প্রকাশ্য প্রশাসনিক সহায়তা পেয়ে তারা এতটাই বেপরোয়া ছিল যে– দাবিকৃত চাদা না দিলেই মিথ্যা সংবাদসহ পুলিশি হয়রানি ছিল তাদের একমাত্র হাতিয়ার। কিছু হলেই এমপি কাউন্সিলর দিয়ে সাধারণ মানুষকে করতেন হয়রানি।
সর্বশেষ ছাত্র-জনতার বিপ্লবকালীন সময়ে তারা বিপক্ষে উসকানিমুলক নিউজ প্রকাশের পাশাপাশি পুলিশের সাথে মাঠে থেকে আন্দোলনকারীদের নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, ঝরিয়েছে রক্ত। এসব সাংবাদিকরা মাঠের আন্দোলন দমনে নেতা-পুলিশের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। আন্দোলনকালীন সময়ে সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরনের উসকানীমূলক পোসট দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতিও তৈরী করে।
এ বিষয়ে উত্তরার একজন প্রবীণ সাংবাদিক প্রতিবেদককে বলেন, উত্তরায় কিছু আওয়ামীপন্থি সাংবাদিকের ভূমিকা রাজনৈতিক নেতাদের থেকেও বেশি ছিল। তারা এমন সব আচরণ করতো যেন ওরাই আওয়ামী লীগের বলিষ্ঠ নেতা। এসব সাংবাদিকরা তাদের বড় নেতা আবু জাফর সূর্য্যর দিক নির্দেশনায় চলতো। নেতাদের বেসুমার অর্থের যোগান এবং সূর্য্যর নেতৃত্বে উত্তরায় তারা নানাভাবে শক্তিও অর্জন করে।
অপর একজন নির্যাতিত সাংবাদিক বলেন, গত ১৭ বছরে যেমন সাহারা খাতুনের সময় অশিক্ষিত একটি মেয়েকে এশিয়ান টেলিভিশনের সাংবাদিক বানিয়ে উত্তরাকে নিয়ন্ত্রণ করতো, সাথে ছিল গোপালগঞ্জের আরো দুই সাংবাদিক জুয়েল আনান ও কাজী রফিক (কাজী রফিক বিপ্লব পরবর্তী তিনটি হত্যা মামলার আসামি)। তারা সাংবাদিক পরিচয় বহন করে আওয়ামী লীগের নেতার ভূমিকা পালন করতো।
এছাড়া হাবিব হাসানের সময় কাজী রফিক কতৃক প্রতিষ্ঠা করা হয় আরিফুর রহমান ওরফে রাসেল খানকে। সেই সময়ে তার সাথে আরো যারা সঙ্গ দেয় তারা হলেন– হাবিব ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদ পারভেজ, হোটেল বয় থেকে সাংবাদিক বনে যাওয়া দম্পতি পুষণ–জুয়েল, আশরাফ ডালি ও দেলোয়ার হোসেনসহ অনেকে।
তিনি আরো বলেন, এসব সাংবাদিকদের উত্তরা প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার পিছনে কাজ করেছেন হাবিব হাসানসহ অন্য আওয়ামী লীগ নেতারা। বিশেষ করে রাসেল খানকে মানবকন্ঠ (ম্যাসাকারের হত্যা মামলার আসামি) পুষণ–জুয়েলকে মাই টিভিতে, সানজিদাকে মোহনা টিভিতে, মাসুদ পারভেজকে ইনকিলাব-এ, আশরাফ ডালিকে দেশ রূপান্তর এ সরাসরি চাকুরির ব্যবস্থা করেন সাবেক এমপি হাবিব হাসান। তাই চাকরির সুপারিশকারীর পক্ষে বিশেষ করে উত্তরা ম্যসাকারে তাদের ভূমিকা ছিল দলীয় কর্মীর মতো। এমনকি ফ্যাসিবাদবিরোধী সাংবাদিকদের জামায়াত বিএনপি ট্যাগ লাগিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দিতেও পিছপা হয়নি তারা। সেই সময়ে আন্দোলনের পক্ষে কোন সংবাদ প্রকাশ করা যায়নি বলে সামাজিক মাধ্যমে সোচ্চার থেকে ভূমিকা পালন করেছে ফ্যাসিবাদবিরোধী সাংবাদিকরা।
খোজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী পরিবারের সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত মনির হোসেন জীবন (ম্যাসাকার হত্যা মামলার আসামি), দেলোয়ার হোসেন ও নুরুল আমিন হাসানের মতো সাংবাদিকরা আইনশৃংখলা বাহিনীর সোর্স হিসেবে শতাধিক বিএনপি জামায়াতের নেতাদের পুলিশে ধরিয়ে দিতে সহায়তা করে।
বিশেষ করে দেলোয়ার কতৃক বিএনপি নেতা এস এম জাহাঙ্গীর, গাজীপুর যুবদল নেতা ভাট্টিকে ধরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সাংবাদিক মহলে বেশ আলোচিত। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা দেলোয়ার ও হাসান পুলিশের সোর্স হিসেবে উত্তরায় বেশ প্রতিষ্ঠিত। দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশের সহায়তায় তারা গত ১৭ বছরে বহু মানুষকে পথে বসিয়েছে। অতি সম্প্রতি হাবিব হাসানের ভাইয়ের দোসর হিসেবে দেলোয়ার একজনের কাছ থেকে কোটি টাকা দামের একটি গাড়িও চিনিয়ে নেয়।
জানা গেছে, হত্যা মামলার আসামি রাসেল খান (হাবিব হাসানের নাতি পরিচয় দানকারী) উত্তরার আন্দোলনে হাবিব হাসানের মিছিলে সরাসরি লাঠি হাতে অংশ নেয়। ওই দিনই আন্দোলনকারীদের দাওয়ায় খেয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় মার খায় এবং তার ব্যবহৃত মটর সাইকেল পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। সেই সময়ে এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাদের সমালোচনা করে দেওয়া তার একটি পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। তার এক ভাই যুবলীগ ৫২ নং ওয়ার্ডের নেতা। রাসেল খান নিজেও কৃষকলীগের নেতা এবং দলীয় দায়বদ্ধতা থেকেই সরাসরি আন্দোলনে অংশ নিতে দেখা গেছে তাকে।
এদিকে উত্তরা ম্যাসাকারের অন্যতম হোতা আফসার উদ্দিন খানের দোসর হিসেবে দেখা যায় আশরাফ ডালিকে। আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে একাধিক উসকানিমূলক নিউজ করে সে। যদিও তার পরিবার বিএনপি হিসেবে পরিচিত। এর বাইরে মাসুদ পারভেজ হাবিব হাসান ও প্রমি গ্রুপের মালিক এনামুল হক খান শহিদের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে পরিচিত। শহিদ খান ( ম্যাসাকারের ডোনার হিসেবে হত্যা মামলার আসামী) গত ১৭ বছরে উত্তরা আওয়ামী লীগকে প্রায় শত কোটি টাকা ডোনেশন দিয়েছে। তার ডোনেশন এবং প্রভাবে উত্তরখান আওয়ামী লীগ বেশ শক্তিশালী। শহিদ ও হাবিন হাসানের দোসর হিসেবে মাসুদও বেশ সম্পদের মালিক। সে ইতিমধ্যে উত্তর খান মাজারের আশেকান কমিটির সভাপতি পদও বাগিয়েছেন।