নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ৩৮ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এম এম আখতারুজ্জামান। ছাত্রলীগের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন। ছাত্রত্ব শেষ করে চিকিৎসক হওয়ার পরও রাজনীতি ছাড়েননি। তিনি আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সদস্য হন। বর্তমানে তিনি স্বাচিপের কেন্দ্রীয় কমিটির সমাজকল্যাণহ সম্পাদক। স্বাচিপ, ছাত্রলীগের নেতা হওয়ার ফলে এম এম আখতারুজ্জামান একই সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কয়েকটি পদ দখল করে আছেন। তিনি রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সহকারী পরিচালক। পাশাপাশি এ বছরের ৫ মে তাকে অধিদপ্তরের ৪টি কর্মসূচির ব্যবস্থাপক করা হয়েছিল। এগুলো হচ্ছে ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, ফাইলেরিয়া এবং ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি। অর্থাৎ ৫ টি পৃথক পদ তিনি একা দখল করে ছিলেন। অভিযুক্ত এম এম আখতারুজ্জামান বলেন, সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি বর্তমানে দুটি কর্মসূচি দেখেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এসব কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার সারা দেশে বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে। এর মধ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম, টিকাদান, পুষ্টি কার্যক্রম, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়াসহ বিশেষ রোগনিয়ন্ত্রণ, যন্ত্রপাতি কেনা ও প্রশিক্ষণের মতো ১৪ টি কর্মপরিকল্পনা (অপারেশনাল প্ল্যান বা ওপি) বাস্তবায়ন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এতে বছরে সরকারের বরাদ্দ থাকে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। এসব কর্মপরিকল্পনার জনবল বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাবেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বা স্বাচিপের সদস্যরা প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন। অন্য রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে এ রকমই নতুন চক্র হবে। দরকার স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার।
সৈয়দ আবদুল হামিদ, অধ্যাপক স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ টি কর্মপরিকল্পনার জন্য ১৪ জন বিষয়ভিত্তিক পরিচালক বা লাইন ডিরেক্টর রয়েছেন। প্রতিটি কর্মপরিকল্পনায় আছেন একাধিক কর্মসূচি ব্যবস্থাপক। তারা কাজ করেন লাইন ডিরেক্টরের অধীন। এ রকম কর্মসূচি ব্যবস্থাপক আছেন মোট ৩২ জন। প্রতিটি কর্মসূচি ব্যবস্থাপকের অধীন কাজ করেন এক বা একাধিক উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক। এ রকম উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক আছেন মোট ৮৫ জন। এগুলো স্বাস্থ্য খাতের বড় পদ হিসেবে বিবেচিত।
১৪টি কর্মপরিকল্পনার কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্লেষণ করেমম দেখা গেছে, বিষয়ভিত্তিক পরিচালক, কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ও উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপকের ১৩১টি পদের মধ্যে ৯১টি পদ বা ৭০ শতাংশ পদ সাবেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বা স্বাচিপের সদস্যরা দখল করে আছেন। কর্মকর্তাদের তালিকা ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, স্বাচিপ ও ড্যাব নেতা এবং সাধারণ চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের দলীয় পরিচয় সম্পর্কে জানা গেছে। চিকিৎসকদের মূলম জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। যে কোনো চিকিৎসক বিএমএর সদস্য হতে পারেন; কিন্তু বিএমএ থাকার পরও চিকিৎসকদের বিভিন্ন নামে সংগঠন রয়েছে।
এর মধ্যে বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠনের নাম ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)। জামায়াতের রাজনৈতিক সমর্থকদের সংগঠন ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম (এনডিএফ)। আর আছে আওয়ামী লীগপন্থী স্বাচিপ। এসব কর্মপরিকল্পনার জনবল বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাবেক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বা স্বাচিপের সদস্যরা প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন। মাঠপর্যায়ে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ও উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপকেরা। তালিকা নিয়ে ড্যাব, স্বাচিপ ও দলনিরপেক্ষ চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩২ জন কর্মসূচি ব্যবস্থাপকের মধ্যে ২২ জন স্বাচিপের সদস্য।
তাদের বেশির ভাগ মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। বাকি ১০ জনের মধ্যে ২ জন ড্যাবের সদস্য। অন্যরা কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। একইভাবে ৮৫ জন উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপকের মধ্যে ৬২ জন স্বাচিপের সদস্য। ছাত্রজীবনে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে তারাও ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সবকিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এটি বড় ভাই, মেজ ভাই ও ছোট ভাইদের একটি তালিকা। এটি মূলত একটি চক্র। একই মতাদর্শের ব্যক্তিদের শক্তিশালী চক্র। স্বাস্থ্যের অনিয়ম-দুর্নীতি করছে এই চক্র। অন্য রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে এ রকমই নতুন চক্র হবে। দরকার স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ একটি মেডিকেল কলেজে একসময় ছাত্রলীগের বড় নেতা ছিলেন, এখন লাইন ডিরেক্টর এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, ১৩১ জনের মধ্যে ড্যাব বা এনডিএফের সদস্য কতজন আছেন? ওই কর্মকর্তা ৬ জনের বেশি নাম বলতে পারেননি।
অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ছিলেন রোবেদ আমিন। তিনি কোনো দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। সরকার পরিবর্তনের পর তাকে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্বে) করা হয়েছিল। ড্যাবের বিরোধিতার কারণে তিনি মহাপরিচালকের কার্যালয়ে ঢুকতে পারেননি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো কোনো কর্মপরিকল্পনায় (ওপি) দেখা যায়, লাইন ডিরেক্টর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, কর্মসূচি ব্যবস্থাপক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এবং উপকর্মসূচি পরিচালকও ছাত্রলীগ নেতা। একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, তারা ২ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন।
কে ছাত্রলীগের কত বড় নেতা ছিলেন, অথবা কার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো বড় নেতার সম্পর্ক আছে, তা নিয়ে টানাপোড়েন চলে। অনেক ক্ষেত্রে উপকর্মসূচি পরিচালক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অর্থাৎ বিষয়ভিত্তিক পরিচালকের মতামত অগ্রাহ্য করেন। এ কারণে দীর্ঘদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে ৮৫ জন উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপকের মধ্যে ৬২ জন স্বাচিপের সদস্য। ছাত্রজীবনে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে তারাও ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অন্য সমস্যাটি দুর্নীতি বিষয়ক।
একই কর্মসূচির শীর্ষ কর্মকর্তারা একই রাজনৈতিক চিন্তার হওয়ায় জবাবদিহি ও ভারসাম্যের সুযোগ থাকে না। স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা ও প্রশিক্ষণে ব্যাপক দুর্নীতি হওয়ার এটি বড় কারণ। কেনাকাটা বা প্রশিক্ষণের ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করা সম্ভব হয় মূলত এই ৩ স্তরের কর্মকর্তা একজোট হয়ে কাজ করার কারণে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘সবকিছু দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এটি বড় ভাই, মেজ ভাই ও ছোট ভাইদের একটি তালিকা। এটি মূলত একটি চক্র। একই মতাদর্শের ব্যক্তিদের শক্তিশালী চক্র।
স্বাস্থ্যের অনিয়ম-দুর্নীতি করছে এই চক্র। অন্য রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে এ রকমই নতুন চক্র হবে। দরকার স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার।’ এম এম আখতারুজ্জামান সহকারী পরিচালক স্বপদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মহলের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সচেতনমহল।