করোনা মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে সংশয়

এইমাত্র জাতীয় স্বাস্থ্য

বিশেষ প্রতিবেদক : শুরু থেকেই নভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি তিন জনের দেহে করোনার ভাইরাস ধরা পড়ায় এই শঙ্কা আরও বেড়েছে। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, বিশ্বজুড়েই কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য কিট, পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট, হাসপাতালের প্রস্তুতিসহ অনেক বিষয়েই প্রশ্ন ও সংশয় রয়েছে। এগুলো আমাদের জন্যও চ্যালেঞ্জ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চোখ কান খোলা আছে, সমস্যা হবে না। তবে দেশের মানুষ কতটা হোম কোয়ারেন্টাইনে অভ্যস্ত হবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বাংলাদেশের ঘনবসতিকে একটি বিরাট দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, আরেকটি দুর্বলতা হচ্ছে, দেশের বাইরে রয়েছে আমাদের এক কোটি মানুষ। ১০২টা দেশে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিটি দেশে আমাদের লোক রয়েছে, তারা যদি করোনা ভাইরাস নিয়ে দেশে আসেন, তাহলে এই রোগের সংক্রমণ বাড়বে। তখন নিয়ন্ত্রণ করাও কষ্ট হবে।
দ্রুত রোগী শনাক্ত করে তাকে আলাদা করার কথা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বারবার বলা হলেও এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশে সেটা কতটা সম্ভব, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে এই হোম কোয়ারেন্টাইন যথাযথ হচ্ছে না জানিয়ে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘কোয়ারেন্টাইনের ১৪ দিন বাড়িতে অবস্থানের ক্ষেত্রে তাদের স্বজনদেরও সচেতন থাকতে হবে। তিনি যদি ভুল করে বাড়ি থেকে বের হয়েও যান, তাকে মনে করিয়ে দিতে হবে যে, তিনি কোয়ারেন্টাইনে আছেন।’ আর এজন্য বিদেশ ফেরতদের স্বজন, বাড়িওয়ালাসহ সবার সহযোগিতা চেয়েছেন মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।
কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করার উপায় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মূল কৌশল হলো দ্রুত রোগীকে শনাক্ত করে তাকে সবার থেকে আলাদা করে ফেলা। তবে রোগের উপসর্গ নিয়ে বাড়িতে বসে থাকলে করোনা রোগী শনাক্ত করা সম্ভব হবে না বলেও জানান তিনি।
দেশের বাইরে থেকে আসা একাধিক যাত্রী জানিয়েছেন, বিমানবন্দরে তাদের ঠিকভাবে চেকিং করা হয়নি।
এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে আইইডিসিআর পরিচালক বলেন, ‘কিছু কিছু অভিযোগ আমরাও পেয়েছি, এগুলো মনিটর করা হচ্ছে।’ একইসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘অসুস্থ কেউ যদি আইইডিসিআর-এর হটলাইনে যোগাযোগ করেন, তাহলে আইইডিসিআর-এর টিম বাড়ি থেকে তার নমুনা সংগ্রহ করবে।’
বিশ্বজুড়েই কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার কিটের অপ্রতুলতা রয়েছে জানিয়ে ডা. ফ্লোরা বলেন, ‘এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য না। বিশ্বজুড়েই এর অপ্রতুলতার কারণ হলো—এটি একটি নতুন ভাইরাস। প্রতিনিয়ত কিট তৈরি করা হচ্ছে এবং তার ভিত্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে কিটগুলো বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়ে থাকে।’
হাসপাতালগুলোর আইসোলেশন প্রস্তুতির প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আমীনুল হাসান জানান, ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে দেশের সব পর্যায়ের সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোকে আইসোলেশন বেড প্রস্তুত রাখার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই প্রস্তুতিকে যথার্থ বলেই মনে করেন তিনি।
তবে রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের সরকারি হাসপাতাল, যেমন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বা মিটর্ফোড হাসপাতালের মতো হাসপাতালগুলোতে একজন কোভিড-১৯ রোগী গেলে পুরো হাসপাতাল ঝুঁকিতে পড়বে বলেও মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘যেকোনও সংক্রামক রোগের জন্য ইনফেকশন প্রিভেনশন কমিটি (আইপিসি) রয়েছে, এই কমিটিগুলোকে সক্রিয় করা দরকার।
সীমান্তের স্ক্রিনিংয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘শতভাগ যে হচ্ছে সেটা বলার সুযোগ নেই। সাধ্য অনুযায়ী সীমান্তে স্ক্রিনিং করা হচ্ছে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়।’ একইসঙ্গে দেশে ব্যাপকহারে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে প্রতিটি মানুষকে পৃথক করে তাদের শনাক্ত করাও কঠিন হবে বলেও মনে করেন ডা. মুশতাক।
তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোতে ইনফেকশন কন্ট্রোলের ব্যবস্থা খুবই খারাপ। কেউ জ্বর-সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হলেন, কিন্তু জানলেন না তিনি কোভিড-১৯ আক্রান্ত, তখন বড় হাসপাতালগুলোতে গেলে তা পুরো কমিউনিটির মধ্যে ছড়িয়ে যাবে।
প্রস্তুতিতে অনেক ঘাটতি রয়েছে জানিয়ে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘চীনের বাইরে যত রোগী শনাক্ত হয়েছে, তার একটাও বিমানবন্দরে ধরা পরেনি। তারা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর শনাক্ত হয়েছেন। তাই দরকার ছিল হাসপাতালগুলোকে সতর্ক করা, কিন্তু হাসপাতালগুলোকে তেমন সতর্ক করা হয়নি।’
এছাড়া যদি বেশি রোগী চলে আসেন, তখন তাদের কোথায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হবে সেটাও একটা অন্যতম চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু আমাদের হাসপাতালগুলোতে অনেক রোগীর ভিড়, সেই তুলনায় স্থান কম, করোনা আক্রান্তরা অন্য রোগীদের সঙ্গে মিশে গেলে রোগটা ছড়িয়ে পড়বে। হয়তো ব্যবস্থা আছে, কিন্তু সেটা কীভাবে করা হবে; এগুলো বড় চ্যালেঞ্জ।’
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘যারা শুধু সাধারণ সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত (হয়তো করোনা ভাইরাসের সর্দি-কাশি না), বহির্বিভাগের একটু দূরে তাদের চিকিৎসা দেওয়া যায় কিনা, সে ব্যাপারে হাসপাতালগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধিতে স্থানীয়ভাবে মাইকিং, ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্ক ও মসজিদ-মন্দিরসহ সোশ্যাল কমিউনিকেশন ব্যবহার করা হবে। জেলা, উপজেলা প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এরসঙ্গে যুক্ত আছেন।’


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *