নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ গত ১১ আগস্টে বাংলাদেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। প্রধান বিচারপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর গত ১২ আগস্টে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত অভিষেক বক্তব্যে (felicitation address) এবং গত ২১ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের ইনার কোর্ট ইয়ার্ডে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিবৃন্দ ও ডিস্ট্রিক্ট জুডিসিয়ারির বিচারকগণের সম্মুখে উপস্থাপনকৃত বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ (Roadmap) – এ রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্বতন্ত্রীকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক পৃথকীকরণ এর উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।
উল্লেখিত প্রেক্ষাপটে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বাস্তবায়নে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় আইনি ও কাঠামোগত সংস্কার আনয়ন, বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দকরণ, অধস্তন আদালতের বিচারকগণের বদলি ও পদায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণসহ বিচার বিভাগে মেধার চর্চার উন্মেষের লক্ষ্যে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে উন্নত দেশসমূহের ন্যায় সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন এর লক্ষ্যে প্রধান বিচারপতি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
এরই অংশ হিসেবে বিগত ২৭ অক্টোবর ২০২৪ খ্রি. তারিখ বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট হতে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। উক্ত প্রস্তাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ যথাযথরূপে পালনের উদ্দেশ্যে একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশের খসড়া, প্রস্তাবিত সচিবালয়ের অর্গানোগ্রাম এবং Rules of Business ও Allocation of Business এর সম্ভাব্য সংস্কার সম্পর্কে পরিপূর্ণ প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়।
পরবর্তীতে গত ১০ ডিসেম্বর, বাংলাদেশে সুপ্রীম কোর্ট রেজিস্ট্রির ৩ জন কর্মকর্তা আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মহোদয়ের কক্ষে আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাগণের উপস্থিতিতে সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক প্রস্তাবিত বিচার বিভাগীয় সচিবালয় এর বিভিন্ন কৌশলগত বিষয় সম্পর্কে প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন। এর ফলে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনের বিষয়টি পুনরায় বেগবান হয়। বর্তমানে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় তৈরির বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ে সক্রিয়ভাবে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
আশা করা যায় যে, অচিরেই বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপনের বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহ দৃশ্যমান হবে। পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হলে অধস্তন আদালতের বিচারকগণের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা, ছুটি ইত্যাদি বিষয়ে প্রচলিত দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটবে এবং বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
এছাড়া, গত ২১ সেপ্টেম্বর, ঘোষিত রোডম্যাপের ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে দেশের উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। প্রতিবেশী দেশসমূহসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে যে সকল প্রক্রিয়া অনুসৃত হয় তা গভীরভাবে বিশ্লেষণপূর্বক এ সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশ এর খসড়া প্রস্তুত করে উক্ত খসড়া সম্পর্কে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের উভয় বিভাগে কর্মরত বিচারপতিবৃন্দের মতামত গ্রহণের জন্য গত ১৪ নভেম্বর, মাননীয় বিচারপতি মহোদয়গণের নিকট খসড়া প্রস্তাবটি প্রেরণ করা হয়।
তৎপ্রেক্ষিতে বিচারপতিদের কাছ থেকে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত মোট ১৫ টি মতামত পাওয়া যায়। প্রাপ্ত মতামতসমূহ নিরীক্ষাপূর্বক সুপ্রীম কোর্টের সুপারিশটি গত ২৮ নভেম্বর, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়।
সুপ্রীম কোর্টের উক্ত প্রস্তাবে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের জন্য একটি জুডিসিয়াল এপোয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য, বিশ্বের অন্যান্য দেশ, যেমন- ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও পাকিস্তানে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে স্বাধীন নিরপেক্ষ কমিশন বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান রয়েছে।
সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক প্রেরিত প্রস্তাবে সুপ্রীম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগের লক্ষ্যে উপযুক্ত ব্যক্তি বাছাইক্রমে রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ করার জন্য একটি ‘জুডিসিয়াল অ্যাপোয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’ গঠনের কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে উক্ত কাউন্সিলের মোট সদস্য সংখ্যা হবে ১০ জন। প্রধান বিচারপতি উক্ত কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হবেন।
এছাড়া, উক্ত কাউন্সিলের সদস্যগণ হবেন, যথাক্রমে, আপীল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম জ্যেষ্ঠ বিচারক, আপীল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগের কর্মে প্রবীণতম জ্যেষ্ঠ বিচারক, অধস্তন আদালত এর বিচারক হতে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন এরূপ বিচারকগণের মধ্য হতে কর্মে প্রবীণতম জ্যেষ্ঠ বিচারক, বাংলাদেশের অ্যাটর্নি-জেনারেল, সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক মনোনীত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন আইনের অধ্যাপক এবং দুইজন নাগরিক প্রতিনিধি।
প্রস্তাবটিতে নাগরিক প্রতিনিধি নিযুক্ত করার নিয়ামাবলী সম্পর্কে বলা হয়েছে যে কাউন্সিলের শিক্ষক সদস্য ব্যতিরেকে অন্যান্য সদস্যগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রণীত বিধি মোতাবেক, কিংবা এরূপ বিধি প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের লিখিত আদেশ অনুসারে দুই বছরের জন্য নাগরিক সদস্যগণ নিযুক্ত হবেন।
সুপ্রীম কোর্টের বিচারক পদে উপযুক্ত প্রার্থীকে সুপারিশ প্রদানসহ কাউন্সিলের যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে মর্মে প্রস্তাবে উল্লেখ রয়েছে।
সংবিধানের ৯৫ ও ৯৮ অনুচ্ছেদের অধীনে বিচারক নিয়োগের নিমিত্ত সুপারিশ প্রদান করার জন্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুরোধ জ্ঞাপন করা হলে কাউন্সিল সম্ভাব্য প্রার্থীগণের নিকট হতে দরখাস্ত আহবান করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করবে মর্মে প্রস্তাবে সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া, কাউন্সিল প্রাথমিকভাবে বাছাইকৃত প্রার্থীদের বিষয়ে মতামত বা পরামর্শ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট যে কোন ব্যক্তিকে কাউন্সিলের সভায় আহবান করতে পারবে বা যে কোন সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কাউন্সিল কর্তৃক চাহিদাকৃত তথ্য উপস্থাপনের নির্দেশ দিতে পারবে বলে প্রস্তাবে উল্লেখ রয়েছে।