নিজস্ব প্রতিনিধি (কুমিল্লা) : কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের টেলিফোন অপারেটর পদটি ১৬তম গ্রেডের। এই পদে দীর্ঘ দিন ধরে চাকরি করেছেন আবুল খায়ের। ৯ হাজার ৩শ’ স্কেলের এই কর্মচারীর প্রতিমাসে বেতন-ভাতা বাবদ সর্বসাকুল্যে পেয়ে থাকেন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে। এই টাকায় পরিবার নিয়ে কোনো মতে সংসার চলে যাওয়ার কথা। অথচ আবুল খায়েরের কাছে এটিই যেন সোনার হরিণ। এই ‘কোনো মতে পেট চালানো’ চাকরি করেই গড়েছেন বাড়ি-গাড়ি। অঢেল সম্পদ নিয়ে বিলাসী জীবন তার। কিভাবে গড়লেন এত সম্পদ? সেই প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সংস্থার পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার পরও তাকে হিসাব রক্ষক পদে পদোন্নতি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। শুধু দুদক নয়, স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক তদন্তেও অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে তাকে অন্যত্র বদলীসহ তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে। কিন্তুরহস্যজনক কারণে তা দীর্ঘ দিনেও বাস্তবায়ন হয়নি। হাসপাতালের পাশের গ্রামেই পৈত্রিক বাড়ি হওয়ায় তার দাপটের কারণে সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ডাক্তাররা মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। আবুল খায়ের টেলিফোন অপারেটর থেকে স্টেনোগ্রাফার কাম কম্পিউটার অপারেটর এবং সর্বশেষ গত ১০ আগস্ট তাকে পদোন্নতি দিয়ে হিসাব রক্ষক করা হয়।
আবুল খায়েরের যত দুর্নীতি : দুদকের তদন্ত সংক্রান্ত নথি থেকে জানা গেছে, হাসপাতালের অভ্যন্তরে স্ত্রীর নামে রোগীদের খাবার সরবরাহের ঠিকাদারী, দালাল সিন্ডিকেট তৈরী, ভুয়া জখমী সনদ বিক্রি, ক্লিনিকে রোগী পাঠিয়ে কমিশন আদায়, কর্মচারী ও নার্সদের বদলী ও অন্যান্য সুবিধা দেয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেয়াসহ সীমাহীন অনিয়ম-দুনীতির মাধমে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন আবুল খায়ের।
দুদকে জমা পড়া লিখিত অভিযোগ থেকে ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ১৯৯২ সালের ১১ জানুয়ারি কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি চালু করা হয়। শুরুতে হাসপাতালের কর্মকর্তা, ডাক্তার, রেজিষ্ট্রার, অপারেশন থিয়েটার ও ১৩টি ওয়ার্ডে স্টাফ নার্সদের জন্য মোট ৭০টি টেলিফোনে সেট ছিল। অভিযোগ রয়েছে, পরবর্তীতে ৫/৬টি সেট নষ্ট দেখানো হয় এবং বাকী সেটগুলো টেলিফোন এক্সচেঞ্জ মেশিন ও পিএ সেটসহ বিক্রি করে দেন আবুল খায়ের। পরে তিনি নিরা টেলিকম নামে হাসপাতালের সামনে লাল মিয়া ম্যানশনে একটি টেলিফোনের দোকান পরিচালনা করেন। এর টেলিফোন নম্বর ৭৬৩৪৫ ও ৬৮২৩৬। ওই নম্বরগুলো হাসপাতালের। এসব নম্বরের মাধ্যমে অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা ব্যবসা করেন।
এছাড়াও হাসপাতালের টেলিফান একচেঞ্জের ১০টি হাইপাওয়ার ফুল চার্জ লাইট ছিল যা তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ মেশিন, পি.এ সেট টেলিফোনসহ স্থাপন ব্যয় প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. স্বপন কুমার অধিকারী এসব বিষয়ে আবুল খায়েরকে ২০১৯ সালের ১৯ মে ও ৭ আগস্ট দু’দফায় কারণ দর্শানোর পত্র দিয়ে টেলিফোন একচেঞ্জ, পিএ সেট ও টেলিফোন সেট কোথায় আছে এবং তা হাসপাতালে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য বলেন। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে ইতিবাচক কোনও উত্তর দেননি। পরে বিষয়টি গড়ায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পর্যন্ত।
এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে আবুল খায়েরকে বদলীসহ তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে এখনো সেই নির্দেশ কার্যকর হয়নি।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারী হয়েও আবুল খায়ের ২০০১ সাল থেকে হাসপাতালের অভ্যন্তরে তার স্ত্রী জেসমিন আক্তারের নামে কাপড় ধোলাই ও পথ্য সরবরাহের ঠিকাদারী কাজ করে আসছেন। স্ত্রীর নামে হাসপাতালে ঠিকাদারীর নামে রোগীদের যথাযথভাবে খাবার সরবরাহ না করে স্থানীয় দাপটের কারণে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে আসছেন। হাসপাতালের ঠিকাদারী কার্যাদেশ ও তার স্ত্রীর নামে জমা দেয়া ট্রেড লাইসেন্স জব্দ করে এরই মধ্যে তদন্তে প্রমাণ পেয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক টিম ও গোয়েন্দা সংস্থা।
লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, আবুল খায়ের কতিপয় নার্স, আউটসোর্সিং ক্লিনার ও স্থানীয় দালালদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরী করেছেন। বিভিন্ন ক্লিনিকে রোগী পাঠানো, হাসপাতাল থেকে ভূয়া জখমী সনদ বের করা এবং ময়নাতদন্তের রিপোর্ট লোকজনের চাহিদা মতো করে দেয়ার কথা বলে অবৈধ অর্থ আদায় করে যাচ্ছেন।
এছাড়াও হাসপাতালের অভ্যন্তরে তার নিজ লোকদের নিয়ে ভ্রাম্যমান দোকান পরিচালনার এবং প্রধান গেটের পাশে দোকান বসিয়ে প্রতি মাসে লাখ লাখ চাঁদা আদায় করেন। সাধারণ কর্মচারী হয়েও বিলাসী জীবন যাপন করেন আবুল খায়ের। তার নামে বেনামে রয়েছে ৪টি গাড়ি ও এ্যাম্বুলেন্স। কুচাইতলী এলাকায় তিনি অবৈধ টাকায় তৈরী করেছেন ২টি বাড়ি। তার নামে বেনামে থাকা বেশ কিছু সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে শুধু তার নামে থাকা ৪টি স্থানে কয়েক কোটি টাকার সম্পদের সন্ধ্যান পাওয়া গেছে। এছাড়াও কুমিল্লা শহরের গোয়ালপট্টি এলাকায় তার দুটি দোকান রয়েছে বলে জানা গেছে।
শুধু অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনেই আবুল খায়ের দক্ষ নন, হাসপাতালের কাগজপত্র জালিয়াতি করে ২০১১ সালের ১৬ নভেম্বর সিলেকশন গ্রেড গ্রহণ করে প্রায় ৩০ লাখ টাকা অতিরিক্ত ভোগ করেছেন।
অভিযোগকারী বিল্লাল হোসেনের তথ্য মতে, সেলিনা আক্তারকে ওটি ইনচার্জ করে দেয়া এবং তাকে দিয়ে ওটির ওষুধ কেনাকাটা করা হবে বলে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। তাকে ৩ লাখ টাকা দেয়া হলেও বেশী টাকা পেয়ে ওটি ইনচার্জ করা হয় অন্যজনকে। সিনিয়র স্টাফ নার্স সুলতানা পারভীন, শিরিন আক্তার ও ফাতেমা আক্তারকে সুবিধাজনক স্থানে বদলীর কথা বলে ১৫ লাখ টাকা আবুল খায়েরকে দেয়া হয়। কাজ না হলেও এখনো তিনি ঠাকা ফেরত দেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নার্স জানান, দিনের পর দিন আবুল খায়ের হাসপাতাল অভ্যন্তরে নানা অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা উপার্জনসহ দালাল সিন্ডিকেট তৈরীর মাধ্যমে হাসপাতালের স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত করলেও তার দাপটের কারণে কেউ মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না। তাই তারা অবিলম্বে তার বিরুদ্ধে আনীত এসব বিষয়ে তদন্ত করে বিভাগীয় আইনগগত ব্যবস্থা নেয়াসহ অন্যত্র বদলী দাবি করেছেন।
অভিযোগ প্রমাণ ও মামলা দায়েরের পরেও পদোন্নতি:
অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে আবুল খায়েরকে বদলিসহ তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেই নির্দেশ প্রতিপালন হয়নি। উল্টো এরপরেই পদোন্নতি পেয়ে তিনি হন স্টেনোগ্রাফার কাম কম্পিউটার অপারেটর।
এরপর চলতে থাকে দুদকের তদন্ত। দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর ১০ লাখ ৬৫ হাজার ৫৬৬ টাকা দুর্নীতির অভিযোগে আবুল খায়েরের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। দুদক কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান রুবেল মামলাটি দায়েরের পর ২০২৩ সালের ২০ ডিসেম্বর কুমেক হাসপাতালের পরিচালক বরাবর একটি নথি যায়।
দুদক প্রধান কার্যালয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক (প্রশাসন) রেজওয়ানুর রহমান স্বাক্ষরিত নথিতে বলা হয়, স্টেনোগ্রাফার কাম কম্পিউটার অপারেটর আবুল খায়েরের বিরুদ্ধে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় কুমিল্লায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এমতাবস্থায় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো। কিন্তু ব্যবস্থা গ্রহণ না করে দেওয়া হয় তাকে পদোন্নতি। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১০ আগস্ট আবুল খায়েরকে পদোন্নতি দিয়ে একটি অফিস আদেশ জারি করেন হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক ডা. শেখ ফজলে রাব্বি।
এ বিষয়ে সাবেক এই পরিচালকের সঙ্গে গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, শূন্য পদ থাকায় তাকে সাময়িক কাজ করতে বলা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলার বিষয়ে আমি জানতাম না।
সার্বিক বিষয়ে আবুল খায়ের সঙ্গে গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে তার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমার বিরুদ্ধে ওঠা সকল অভিযোগ মিথ্যা। আমি কোনো দুর্নীতি করিনি। নিয়ম মেনেই আমার দাপ্তরিক কার্যক্রম চলছে।