নিজস্ব প্রতিবেদক : স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে স্বৈরশাসকের আস্থাভাজনরা এখনও লোভনীয় পদে বসে আছেন। বড় বড় প্রকল্প তাদের দখলে। বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে বড় বড় প্রকল্পের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন দাপুটে প্রকৌশলীরা। এ ক্ষেত্রে নির্বাহী প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালকের নাম উল্লেখযোগ্য। তারা জয়বাংলার শ্লোগানে বিশ্বাসী হলেও বর্তমান খোলস পাল্টিয়ে ফেলেছেন। সূত্র জানায়,সাবেক আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দােসর চিহ্নিত কতিপয় প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে তারা মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে ম্যানেজ করে ফেলছেন। গত ৫ আগস্টে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলন সংগ্রামের ফলে শেখ হাসিনার পতনের ৬ মাসেও তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে প্রকল্প থেকে লুটের টাকায় তারা সব ম্যানেজ করে ফেলেছেন বলে সূত্র জানায়।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে পলায়নের পর দেশের অন্য সব সরকারি দপ্তর, অধিদপ্তরের ন্যায় এলজিইডিতেও চলছে চরম বিশৃঙ্খলা ও অসন্তোষ । এর নেপথ্যে কাজ করছেন শেখ হাসিনার মদদপুষ্ট আবেদ আলী কমিশনের মাধ্যমে ২০১৩ সালে নিয়োগ প্রাপ্ত কতিপয় চিহ্নিত মুজিববাদী প্রকৌশলীগণ। তাদের মদদ দিচ্ছে এলজিইডিতে কর্মরত আওয়ামীপন্থী এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের একান্ত আস্থাভাজন দালাল ও সুবিধাভোগী মুজিববাদী প্রকৌশলীরা।
এই দালাল প্রকৌশলীরাই জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্পের পিডি নিয়োগের ক্ষেত্রে সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের সঙ্গে অর্থ লেনদেনের কাজে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে পূর্বে ও বর্তমানে সুযোগ সুবিধা নিচ্ছে। । জানা গেছে এ ফাঁদে পা দিয়েছেন গত সরকারের সুবিধাপ্রাপ্ত ও উচ্ছিষ্ট ভোগী কিছু বিএনপিপন্থি প্রকৌশলীরাও। বিগত ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর অনুমোদিত সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মোঃ আলী আখতার হোসেনকে আহ্বায়ক করে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট এলজিইডিতে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের একটি শাখা কমিটি গঠন করা হয়।
উক্ত কমিটিতে ২০১৩ সালে নিয়োগ প্রাপ্তদের মধ্যে ১৮ জন সদস্য রয়েছেন। এই ১৮ জন প্রকৌশলীই এলজিইডিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ক্ষেত্রে কলকাঠি নাড়ছেন। তারা সকলেই সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী এবং কেউ কেউ ইসকন সদস্য। তাদের একজনের স্ত্রী অডিট অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে এলজিইডিতে প্রভাব বিস্তার করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন।
অন্য একজন কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের প্যানেলে ২০২২ সালে আইইবির নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি পুলিশ কর্মকর্তা স্ত্রীর মাধ্যমে এলজিইডি হতে অবৈধ সুযোগ সুবিধা নিয়ে চলেছেন বলেও তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে। সূত্র জানায়, উক্ত পুলিশ কর্মকর্তার সাথে সম্পর্ক রয়েছে জন প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক একজন উচ্চপদস্থ নারী কর্মকর্তা যিনি ৫ আগস্টে আওয়ামী সরকারের পতনের পর ওএসডি হয়েছেন।
অন্য একজন নারী কর্মকর্তা যার ভাই ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী আমজাদ হোসেন। উক্ত আমজাদ হোসেন আওয়ামী সরকারের সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলীর এপিএস ছিলেন। নানা খামখেয়ালিপনার কারণে এলজিইডিতে উচ্চ আদালতের আদেশে কখনো নিয়মিতকরণ করা হয়েছে রাজস্ব খাতে, কখনো বা করা হয়েছে নামমাত্র পরীক্ষার আয়োজনের মধ্য দিয়ে। এমনই এক ঘটনা ঘটেছে ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। ঐ বছর সংস্থাটির সহকারী প্রকৌশলীর একটি পদের জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মাত্র ৩জন পরীক্ষার্থী। তথ্য বলছে, সেই পরীক্ষায় ১৫৪টি শূণ্য পদের বিপরীতে বৈধ আবেদন ছিলো ১৫১৮টি। সেই লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মাত্র ৩৫২ জন আর উত্তীর্ণ হন ১৬২ জন। অর্থাৎ একটি শূণ্য পদের বিপরীতে ১ জন উত্তীর্ণ হয়। অন্যদিকে মৌখিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয় ১২৭ জন। অর্থাৎ শূণ্য পদের চেয়ে কম পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়।
পিএসসির সুপারিশ নিয়ে পরের বছর ২০১৩ সালে এ পরীক্ষা থেকে যোগদান করেন ৫২ জন প্রকৌশলী। অভিযোগ রয়েছে, সকল নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে প্যানেলের মেয়াদ শেষ হওয়ার সাড়ে ৩ বছর পর অর্থাৎ ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট ও ২৭ ডিসেম্বর উক্ত প্যানেল থেকে আরও ৩১ জন নিয়োগ দেওয়া হয়। যেখানে নিয়ম রয়েছে পিএসসির সুপারিশের মেয়াদ হবে মাত্র ১ বছর। বড় ধরণের এই অনিয়মে পিএসসি এবং এলজিইডি সিণ্ডিকেটের যোগসাজশের বিষয়টি এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৬ সালের বিজ্ঞপ্তির আলোকে ২০১৩ এবং ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রাপ্তরাও সিনিয়রিটি দাবি করে আসছেন ২০০৬ সাল থেকেই। কিন্তু বিধি বলছে পিএসসির সুপারিশের তারিখ ও নিয়োগের তারিখ ঠিক রেখে দাবি আদায়ে করা হয় একের পর এক মামলা দিয়ে। ফলশ্রুতিতে নানা জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরেই আটকে আছে এলজিইডির প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের পদোন্নতি। একইভাবে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে প্রকল্পে নিয়োগপ্রাপ্তদের উচ্চ আদালতের নির্দেশে নিয়মিতকরণ হওয়া সত্বেও পদোন্নতি বঞ্চিত করে আওয়ামী লীগ সরকার। এলজিইডি সূত্র বলছে, যোগ্যতা সত্ত্বেও সিনিয়র প্রকৌশলীদের যথা সময়ে পদোন্নতি প্রদান না করায় তাদের মধ্যে মারাত্মক ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। যার বিস্ফোরণ ঘটতে পারে যে কোন সময়। এতে প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পদোন্নতি বঞ্চিত বেশ কয়েকজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যম কে বলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ায় তাদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে এবং দ্রুত পদোন্নতি না দিলে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে’।
যথা সময় পদোন্নতি না পাওয়ায় বিপুল সংখ্যক সিনিয়র সহকারি প্রকৌশলী ইতোমধ্যে অবসরে চলে গেছেন। যে কারণে এলজিইডিতে দেড়শ জন নির্বাহী প্রকৌশলীর পদ শূণ্য রয়েছে বর্তমানে। পদোন্নতি বঞ্চিতরা গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগে জানান, দীর্ঘদিনের চাকরি জীবনে প্রাপ্য সম্মানটুকুওপাচ্ছেন না তারা। এ ব্যাপারে তারা এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং সচিবের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।