বিশেষ প্রতিবেদন : ধর্মীয় উগ্রবাদ বা চরমপন্থা কোনো ধর্মই সমর্থন করে না; বরং প্রতিটি ধর্ম শান্তি, সহনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধকে ধারণ করে। তবুও, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বার্থে ধর্মের অপব্যবহার করে উগ্রবাদকে উসকে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ, সংবিধান অনুযায়ী, একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যেখানে সব ধর্মের সহাবস্থান ও স্বাধীনভাবে চর্চার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ উগ্রবাদের ছায়ায় আক্রান্ত হয়েছে, যা শুধু রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং গণতন্ত্র ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত ১৯ মার্চ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক বক্তব্যে বলেন, “চরমপন্থা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে গণতন্ত্রের কবর রচিত হবে।” এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়বে। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক অবস্থান নয়; বরং যে কোনো স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের টেকসই ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা। ইতিহাসে দেখা গেছে, যখন কোনো দেশে উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন সেই দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উগ্রবাদ শুধু একটি নিরাপত্তা ইস্যু নয়, বরং এটি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে দেখা গেছে, উগ্রবাদ দমন তখনই কার্যকর হয়েছে, যখন রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে এই সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কিন্তু যখন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কিছু দল বা গোষ্ঠী উগ্রবাদকে প্রশ্রয় দেয় বা ব্যবহার করে, তখনই সংকট আরও গভীর হয়।

বাংলাদেশে অতীতে একাধিকবার ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান দেখা গেছে। ২০০৫ সালে জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলা চালায়, যা দেশের নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি সৃষ্টি করেছিল। এরপর ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান হামলা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দেয় যে, উগ্রবাদ কীভাবে একটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে নষ্ট করতে পারে। এসব ঘটনার পর বাংলাদেশ সরকার উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে উগ্রপন্থী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। কিন্তু একবার দমন করা মানেই এর সম্পূর্ণ অবসান হয়েছে—এমনটি ভাবা ঠিক হবে না।
তারেক রহমানের বক্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য হলো, উগ্রবাদ মোকাবিলায় ব্যর্থতা গণতন্ত্রের অবক্ষয় ঘটাবে। কারণ, উগ্রবাদ শুধু সহিংসতা সৃষ্টি করে না; এটি মুক্তচিন্তা, মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিলে কেবল নিরাপত্তার সংকটই তৈরি হয় না; বরং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক সহনশীলতা এবং নাগরিক অধিকারের ওপরও ব্যাপক হুমকি তৈরি হয়।
এই প্রেক্ষাপটে, তারেক রহমানের বক্তব্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা এবং ভারতের ন্যারেটিভ প্রতিস্থাপনের প্রসঙ্গ টেনে সমালোচনা করা এক ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা। কারণ, উগ্রবাদ ও চরমপন্থা মোকাবিলা করা কোনো নির্দিষ্ট দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নয়; বরং এটি প্রতিটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য। ভারতের মতো দেশেও উগ্রবাদী চরমপন্থার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যেমন উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ বা মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযানের মাধ্যমে। ঠিক তেমনি, বাংলাদেশকেও তার নিজস্ব বাস্তবতায় উগ্রবাদ দমনে কার্যকর ও দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নিতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে, কিছু রাজনৈতিক শক্তি উগ্রবাদ দমনের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইছে। এটি গণতন্ত্র ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে সকল পক্ষকে উগ্রবাদবিরোধী অবস্থান নিতে হবে। শুধু সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার দায়িত্ব নয়; বরং রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ও সাধারণ নাগরিকদেরও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
উগ্রবাদ নির্মূলে কেবল সামরিক বা আইনি ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়; এর জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, ধর্মের প্রকৃত বার্তা প্রচার, শিক্ষার প্রসার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নও গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ সমাজকে উগ্রবাদের ফাঁদ থেকে রক্ষা করতে হলে তাদের মাঝে যুক্তিবাদী ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে হবে।
তারেক রহমানের বক্তব্য উগ্রবাদ দমনের জন্য একটি সময়োপযোগী বার্তা বহন করে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া জরুরি। একে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা বা রাজনৈতিক স্বার্থে অপপ্রচার চালানো কেবল বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে, যা রাষ্ট্রের সার্বিক অগ্রগতির জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশকে একটি নিরাপদ, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে এগিয়ে নিতে হলে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
উগ্রবাদ দমনে ব্যর্থতা শুধুমাত্র নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়, বরং এটি গণতন্ত্র ধ্বংসের অন্যতম কারণ হতে পারে। তারেক রহমানের বক্তব্য এ কারণেই প্রাসঙ্গিক এবং যৌক্তিক। উগ্রবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ঐক্য ও জাতীয় স্বার্থে একযোগে কাজ করাই হবে সবচেয়ে কার্যকর সমাধান। লেখক : গাজী সাইফুল, প্রবাসী লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ।