আজকের দেশ রিপোর্ট : সব মানুষের স্বপ্ন তোমার চোখের তারায় সত্যি হোক, আমার কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক। কলকাতার শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্রের জনপ্রিয় এই গানের কথা সত্য করে করোনাভাইরাসের সংকটকালে দেশের তরুণদের একটা অংশ অন্যদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে সহযোগিতার হাত। কোভিড-১৯-এর আক্রমণ ঠেকাতে পুরো দেশের মানুষ যখন ঘরবন্দি, তখন এই স্বেচ্ছাসেবক তরুণরা পাশে দাঁড়াচ্ছেন অসহায় মানুষদের।
বিপদগ্রস্ত মানুষদের অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা, বাধ্য হয়ে বাইরে বের হওয়া মানুষদের ‘সামাজিক দূরত্ব-এর ধারণা দেওয়াসহ কাজ না থাকা দিনমজুর মানুষদের খাবারের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছেন এই স্বেচ্ছাসেবক তরুণরা। করোনাভাইরাস মোকাবিলার অংশ হিসেবে তাদের কেউ কেউ অনলাইন ওয়ার্কশপসহ, প্রয়োজনীয় ট্রেনিংয়েরও আয়োজন করেছেন এরই মধ্যে।
এমন একটি সংগঠন করোনায় তারুণ্য। ফেসবুকে গ্রুপ করে এই স্বেচ্ছাসেবক দলের আত্মপ্রকাশ। নিজেদের লক্ষ্য বিষয়ে তারা বলছে, আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত আমাদের বাধ্যতামূলক ঘরে থাকার কথা। গণপরিবহন বন্ধ। জরুরি চিকিৎসা ছাড়া অন্য চিকিৎসাসেবা বন্ধ। এই সময়ে ঘরে বসে দেশের যেকোনও প্রান্তে বা আপনার এলাকায় কেউ অসুস্থ বোধ করতে পারে। অসুস্থতায় কোনও ব্যক্তি বা পরিবার আতঙ্কিত হয়ে পড়তে পারেন বর্তমান বাস্তবতায়। তিনি বা তার পরিবার যেন অসহায়বোধ না করেন, তাই তাদের পাশে থাকতে চাই আমরা। শুনতে চাই তার, তাদের কথা। এই সংকটকালে কথা শোনার লোকেরও অভাব। হটলাইন স্বেচ্ছাসেবকরা কথা শুনে যদি মনে করেন, কারো জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন, তাহলে করোনায় তারুণ্যের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার চেষ্টা করবেন। প্রয়োজনীয় ওষুধ, হাসপাতালসেবা কীভাবে পাবেন, সেই তথ্য দেওয়ার চেষ্টা থাকবে। সম্ভব হলে ওষুধ, অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতালের ব্যবস্থা করে দেওয়ার চেষ্টা করবে করোনায় তারুণ্য।
এর উদ্যোক্তা গণমাধ্যমকর্মী তুষার আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা এখন যে সময় পার করছি, তখন মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ। এই তরুণেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়। সাধারণ ছুটি বা অনানুষ্ঠানিক লকডাউনের সময় এই তরুণদের সক্রিয় রাখতে চেয়েছি। রাজধানীসহ সারাদেশে মহল্লা, উপজেলা, জেলাভিত্তিতে তরুণরা আমাদের ডাকে সাড়া দেন। এবং তারা ঘরে বসেই টেলিফোনে মানুষের সমস্যার কথা শুনছেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন। নি¤œ আয়ের মানুষ, পথশিশু, বৃহন্নলাদের কাছেও তারা খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, তরুণ চিকিৎসকদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। তারা সার্বক্ষণিক টেলিমেডিসিন দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের দেখে দেশের প্রবীণ চিকিৎসকরাও ‘করোনায় তারুণ্যে’র সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আমরা দেখছি বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জন, ইউএনও, ম্যাজিস্ট্রেট এবং জেলা প্রশাসকরাও যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছেন। সারাদেশের তরুণদের বিভিন্ন সংগঠনও নিয়মিত যুক্ত হচ্ছে করোনায় তারুণ্যের সঙ্গে।
মাত্র সাড়ে ৪০০ টাকার বিনিময়ে রোজ বেশকিছু ঘরে খাবার জুটবে। চাল, ডাল, আলু। বাঁচার জন্য। এই ইভেন্ট পেজ করে কাজ করছেন সাবেক ছাত্রনেতা ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মী ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল। তিনি বলেন, আমি এ পরিস্থিতির আগেই কিছুটা টের পেয়েছিলাম। আমাদের বাসার কাজের সহকারী বলছিলেন, অনেকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিচ্ছে। আমিও ৩-৪টা বস্তিতে খোঁজ নিলাম, তারাও একই কথা বলছিলেন। আমি জানি, ঢাকা শহরে প্রায় ৪০ লাখ নি¤œ আয়ের বস্তিবাসী ও ভাসমান মানুষ আছে। তাই কিছু একটা করার তাগিদ বোধ করলাম সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে।
তিনি বলেন, কিন্তু আমরা এই চাল, ডাল, আলু দিতে গিয়ে দেখছি ভয়াবহ চিত্র। আমরা যে সামান্য খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছি, তা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই না। এই মানুষগুলো বলছে, তারা অসুখে যত না মরবে, তারচেয়ে খিদেয় মারা যাবে বেশি। কারণ, কাজ না থাকলে তারা ২-৩ দিনও চলতে পারবে না।
রাজশাহী থেকে কাজ করছেন ‘কিছু করতে চাই’ নামে একটি পেজের মাধ্যমে কিছু তরুণ। তারা বলছেন, লকডাউনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো হলো যারা দিন আনে দিন খায়। শুধু তাদের জন্য কিছু করতে চাই।
নারায়ণগঞ্জে কিছু উদ্যোমী ছেলেমেয়ে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করে বেশ কয়েকটা মহল্লা, ব্যাংকের বুথ, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, খাবারের দোকানে ফিজিক্যাল ডিসটেন্স মার্কিং আর জীবাণুনাশক ছিটানোর কাজ করছে।
ক্লাইমেটঅ্যাকশন টিম নামের এই সংগঠনের মাহবুব সুমন বলেন, তাদের টিম করোনা সংক্রমণের প্রথম দিক থেকেই সচেতন ছিল। এজন্য শুরুর দিকে আমেরিকা প্রবাসী ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ড. হাসান ইমামের সাহায্য নিয়ে অনলাইন ওয়ার্কশপসহ, প্রয়োজনীয় ট্রেনিংয়ের আয়োজন করা হয়। এখান থেকে টিম নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রশিক্ষণ পায় এবং কমিউনিটিতে সংক্রমণ কমানোর লক্ষ্যে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হয়। এ ছাড়া স্বল্প আয়ের মানুষদের মধ্যে হ্যান্ডওয়াশ বিতরণ করা হয়।
তিনি বলেন, ক্লাইমেটঅ্যাকশন টিম দৈনিক ২০০ টাকার আয়ে নির্ভরশীল পরিবারকে টানা ২ মাস জরুরি খাদ্য বিনামূল্যে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা তোলা হচ্ছে। কাজে লাগানোর মতো একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ উঠলেই তালিকাভুক্ত শ্রমজীবী পরিবারদের খাবার সংগ্রহ করা শুরু হবে।
সুমন মাহবুব বলেন, আজ থেকে টিম নতুন আরেকটি কাজে যাচ্ছে। করোনা লকডাউনের এই সময়ে বাইরে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ঘুরে বেড়ানো কুকুর না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। এগুলোর খাবারের ব্যবস্থা করা খুবই কঠিন কাজ। তবে কমিউনিটির উদ্দেশে একটা বার্তা পাঠানোর লক্ষ্যে আমরা কুকুরদের খাওয়াবো।
তিনি আরও বলেন, ক্লাইমেটঅ্যাকশন টিম মনে করে করোনা কোনও ল্যাবে তৈরি ভাইরাস নয়। কারণ, করোনাভাইরাসের যে ডুয়েল প্রোটিন এলিমেন্ট স্পার, ফ্যাট আউটার সারফেস ও তথাকথিত ক্লিভেজ—এই ত্রয়ের সমন্বয়ে এটি খুব সহজে মানুষের ফুসফুসের কোষ ভেদ করে ঢুকে যেতে পারে। ভাইরাসের শরীরের এই সুবিধাগুলো ল্যাবে তেরি করা সম্ভব নয়। তবে জৈব বিবর্তনের ভেতর দিয়ে মিউটেশন হয়ে হয়ে এটি আজকের জায়গায় এসেছে। ফলে করোনা একটি প্রকৃতির সংকট।