এলজিইডিতে বিটুমিন সংকট
নিজস্ব প্রতিবেদক : নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের সড়ক অবকাঠামো খাতে। বন্ধের পথে সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের অন্যতম প্রধান উপকরণ বিটুমিন আমদানি। বিটুমিন সংকটে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে পড়েছে স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রায় ১০ হাজার ৫০০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ।
সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়ে থাকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। গ্রামীণ অবকাঠামো ও সড়ক নির্মাণে এ মন্ত্রণালয়ের অধীন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো এলজিইডি। নির্মাণকাজে বর্ষা এড়াতে এ বিভাগের কার্যক্রম মূলত জানুয়ারি থেকে মে এ পাঁচ মাসেই গতি পেয়ে থাকে। কিন্তু এ পিক সময়ের শুরুতেই নভেল করোনাভাইরাসের ধাক্কা লেগেছে এলজিইডির সড়ক নির্মাণ ও সংস্কার কার্যক্রমে।
জানা গেছে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট ১৭ হাজার ৫০০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের পরিকল্পনা ছিল এলজিইডির। এ পরিকল্পনার মধ্যে ছিল ৫ হাজার ৫০০ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক পাকা করা এবং ১৩ হাজার কিলোমিটার সড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ। এখন পর্যন্ত পরিকল্পনার মাত্র ৪০ শতাংশ বা প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার সড়কের কাজ শেষ করতে পেরেছে সংস্থাটি। বাকি আছে ১০ হাজার ৫০০ কিলোমিটার রাস্তার কাজ। মূলত বিটুমিন আমদানি বন্ধ থাকার কারণে ৬০ শতাংশ সড়কের কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে এলজিইডি। পাশাপাশি করোনার কারণে শ্রমিক সংকট এবং অন্য বিষয়গুলোও রয়েছে। চলতি অর্থবছরে এসব কাজ শেষ করতে না পারলে পরবর্তী সময়ে রাস্তাঘাটের বেহাল দশা হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এ বিষয়ে বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রায় সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রমে এক ধরনের গতিহীনতা রয়েছে। প্রকল্পের কোথায় কী ধরনের বাধা রয়েছে, সে বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে মন্ত্রণালয়। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে প্রকল্পের কার্যক্রমগুলো কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সে বিষয়ে আমরা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। সড়ক নির্মাণে আমাদের কী ধরনের বাধা রয়েছে, সেগুলো নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই আমরা সব ধরনের উদ্যোগ একত্রে নিয়ে প্রকল্পের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে পারব।
দেশে সড়ক নির্মাণে বিটুমিনের চাহিদা প্রায় পাঁচ লাখ টন। এ চাহিদার মাত্র ১০ ভাগ সরবরাহ করে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। বাকি ৯০ ভাগ বিটুমিন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বেশিদিন মজুদ করে রাখা সম্ভব নয় বলে প্রতি মাসেই বিটুমিন আমদানি করতে হয়। সড়ক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কাজে প্রতি মাসে প্রায় ৪০ হাজার টন বিটুুমিনের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বৈশ্বিক যোগাযোগ এক প্রকার বিচ্ছিন্ন। যার ফলে সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এ উপাদানের আমদানিও বন্ধ। আর বিটুমিন সংকটে দেশের বিভিন্ন এলাকায় এলজিইডির চলমান সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের কাজও প্রায় এক মাস ধরেই বন্ধ।
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এবং বিটুমিন আমদানি করা গেলে সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারকাজ শুরু করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন এলজিইডিসংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. মতিয়ার রহমান বলেন, সড়ক নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উপযুক্ত সময় জানুয়ারি থেকে মে মাস। সেই হিসেবে আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রায় ৪০ শতাংশ কাজ শেষ করতে পেরেছি। বাকি ৬০ শতাংশ কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই করতে পারব বলে আশা ছিল। কিন্তু বর্তমানে নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিটুমিন আমদানি করতে না পারায় কাজ বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি যদি এ মাসের মধ্যে ভালো না হয়, তাহলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মাধ্যমে ইস্টার্ন রিফাইনারি উৎপাদিত বিটুমিন নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা নিতে হতে পারে। তাছাড়া রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণের অভাবে বিদেশ থেকে আনা বিটুমিন অনেক ক্ষেত্রেই মানে খারাপ হয়। আগামীতে সব সড়ক নির্মাণ ও মেরামতের কাজে দেশে উৎপাদিত বিটুমিন ব্যবহার করতে পারলে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যমতে, এডিপির বরাদ্দকৃত মোট অর্থের সবচেয়ে বেশি বরাদ্দকৃত মন্ত্রণালয় ও বিভাগের তালিকায় রয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। মোট এডিপির প্রায় ১৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ বা ২৯ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা রয়েছে চলতি অর্থবছরে। এ সময়ে ২২৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিভাগটি। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে বিভাগটি প্রায় ৪৫ শতাংশ বা ১৩ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা ব্যয় করতে পেরেছে। প্রকল্পের কার্যক্রম বিটুমিন সংকটে চলমান না রাখতে পারলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন অনেকটাই পিছিয়ে পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে ২২ হাজার কিলোমিটার সড়ক ও মহাসড়ক রয়েছে। এসব সড়ক ও মহাসড়কের অধিকাংশ স্থানেই সম্প্রসারণের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সরকার দেশের প্রতিটি জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এসব কাজেও প্রচুর পরিমাণে বিটুমিন প্রয়োজন হবে। সম্প্রতি দেশের অন্যতম বড় করপোরেট গ্রুপ বসুন্ধরা গ্রুপ বিটুমিন উৎপাদনে কারখানা চালু করেছে।
তাদের বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতাও দেশের চাহিদা পূরণে সক্ষম। আগামী ২০২১ সালের মধ্যে নয় লাখ টন উৎপাদনে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। তবে নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি রূপ নিলে বিটুমিন না পাওয়া গেলে এসব নির্মাণকাজ ব্যাহত হবে। এতে এডিপি বাস্তবায়ন যেমন পিছিয়ে যাবে, তেমনই গ্রামে মানুষের চলাচলসহ পণ্য পরিবহন ব্যাহত হতে পারে। পাশাপাশি পরিবহন ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।