ঘরে না থাকলে করোনা ভয়ংকর হওয়ার আশঙ্কা

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন রাজধানী স্বাস্থ্য

ঢাকায় এসে দিশেহারা গার্মেন্টস কর্মীরা

 

এম এ স্বপন : বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই মুহূর্তে কেউই নিরাপদ নয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাই নিজ উদ্যোগে ঘরে না থাকলে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন ও ইতালির চেয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থা হবে বাংলাদেশে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন। মহামারি করোনা ভাইরাসে রোববার বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৮ জন। ঠিক ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে গতকাল ৩৫ জন আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ৪ জন। দ্বিগুণ হয়ে করোনার আক্রান্তের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২৩ জন। আর মৃতের সংখ্যা বেড়ে হলো ১৩ জন।
এদিকে করোনার ঝুঁকি ঢাকায় সবচেয়ে বেশি। ঢাকার মধ্যে মিরপুর, টোলারবাগ ও বাসাবো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ অবস্থায় ঢাকা থেকে যাতে কোনো লোক বাইরে যেতে না পারে এবং ঢাকার বাইরে থেকে কোনো মানুষ যাতে ঢাকায় আসতে না পারে, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশের সব ইউনিটকে নির্দেশনা দিয়েছেন আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। গত রোববার তিনি এই নির্দেশনা দেন। আইজিপির এই নির্দেশে ঢাকা লকডাউনের কথা উল্লেখ না করা হলেও কার্যত ‘লকডাউন’ হলো ঢাকা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে অ্যাকশন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজনে কারফিউ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, কেউই নিরাপদ নই। তাই সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। সামাজিক দূরত্ব সবাই যদি না মানি, তবে স্বাস্থ্য বিভাগ একা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। ঘরে থাকতে হবে। তা না মানলে পরিস্থিতি আমেরিকার ও ইতালির চেয়ে ভয়াবহ হবে।
ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা লকডাউনের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের : দেশে ব্যাপক হারে সামাজিক সংক্রমণ ঠেকাতে ঢাকার দুটিসহ সারাদেশে মোট পাঁচটি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পুরোপুরি লকডাউনের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। দেশে একদিনে দ্বিগুণ বেড়েছে করোনাভাইরাসে শনাক্তের সংখ্যা। তবে সামাজিক সংক্রমণ এখনও এলাকাভিত্তিক বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর। আলাদা করা হয়েছে সারাদেশের পাঁচটি অঞ্চল। তাপমাত্রা বা আর্দ্রতা ভেদে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে সক্ষম ভাইরাসটি ছড়িয়ে যায় মানুষের সংস্পর্শে। কাজেই আক্রান্ত ব্যক্তির আশপাশের মানুষ থাকেন চরম ঝুঁকিতে। ভাইরাসটির সংক্রমণ ঠেকাতে তাই লকডাউনই হতে হবে নিñিদ্র।
একজন বলেন, লকডাউন বলতে প্রকৃত অবস্থাতে যা বোঝায়, তা হলো বাসার বাইরে কোনোভাবেই যাওয়া যাবে না। তবে জরুরি কাজ যাদের রয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে অফিসের পাশে এসে বাসা নেয়া উচিত। ভাইরাস তো হাঁটতে পারে না। ভাইরাসটা আমার কাছ থেকে অন্য একজনের কাছে ছড়ায়। কাজে নিজ দায়িত্ব থেকে যদি ট্রান্সমিশন বন্ধ করা যায়। তাহলে সংক্রমণ কমে যাবে।
ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা ছাড়া এমন দুর্যোগ মোকাবিলা সম্ভব নয় জানিয়ে প্রতিটি মানুষকে সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলার আহ্বান তাদের।
ঢাকায় এসে দিশেহারা গার্মেন্টস কর্মীরা : করোনা পরিস্থিতিতে কারখানা বন্ধ হওয়ায় টিকে থাকার লড়াইয়ে গ্রামে ছুটে গিয়েছিলেন গার্মেন্ট কর্মীরা। শহরে থাকলেই খরচ বাড়বে সে কারণেই গ্রামে ছুটে যান তারা। এরইমধ্যে খবর আসে ৫ এপ্রিল কারখানা খুলবে এবং বেতন দেওয়া হবে। আবার হুড়মুড় করে ফেরার পালা। গণপরিবহন বন্ধ, রাস্তায় নেই গাড়ি, ট্রাকে গাদাগাদি করে, হেঁটে, কোনও কোনও এলাকায় পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢাকায় ঢোকেন তারা। কিন্তু ঢাকায় পৌঁছে জানতে পারেন ছুটি ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
শ্রমিকদের অভিযোগ, এভাবে ঢাকায় ফিরে এসে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন তারা। ইতোমধ্যে ঢাকা থেকে বের হওয়ার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় শূন্যহাতে টিকে থাকা তাদের জন্য মুশকিল হবে। বাসা ভাড়ার জন্য তাদের ওপর চাপও দেওয়া হচ্ছে। আর শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, শ্রমিকদের সময়মতো বেতন না দিয়ে গ্রাম থেকে শহরে টেনে আনার দায় মালিকদের নিতে হবে। বেতন না হওয়া পর্যন্ত তাদের তিন বেলা আহারের দায়িত্ব তাদের নিতে হবে।
বন্ধের মধ্যে হঠাৎ লে-অফের নোটিশ দেয় উত্তরার ভার্সেটাইল কারখানা। একাধিক কর্মী প্রতিবাদ করায় মালিকের লোকদের হুমকি-ধমকির শিকার হন। পাশের কারখানা চৈতির কর্মী জাহানারা বলেন, এই এলাকার তিনটি কারখানা লে-অফ হয়েছে। আমাদের বেশিরভাগ শ্রমিকই এলাকা ছেড়ে যায়নি। কিন্তু বেতন নেই, খাবে কী তার ঠিক নেই। রোববার সকালে কারখানায় গিয়ে ছুটির নোটিশ দেখে ফিরে এসেছেন জানিয়ে জাহানারা বলেন, আমাদের যদি কাল বিকালেও জানানো হতো তাহলে হয়রানির শিকার হতাম না। তিনি আরও বলেন, যখন সারাদেশ দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তখন লে-অফের প্রতিবাদ করে শ্রমিকরা মারধরের শিকার হয়। এখন তো এই ভাইরাসের জন্য প্রতিবাদ আন্দোলনও হবে না। ঘরে খাবার নাই, পকেটে টাকা নাই, সাহায্য চাইতে এখানে-সেখানে ঘুরছে শ্রমিকরা। দেখার কেউ নাই।
মিরপুরে একটি গার্মেন্টে কাজ করেন শাহজাদি। ছুটি শেষ শুনে রংপুর থেকে এসেছেন। ৫ তারিখ সকালে কারখানার সামনে গিয়ে দেখেন ছুটি বাড়ানো হয়েছে। ১২ তারিখ কারখানায় যেতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, বাড়ির উদ্দেশে যাই যখন তখনই হাত খালি। কিছু টাকা ঋণ নিয়ে এসেছি। এখন শুনি কারখানা বন্ধ, বেতন কবে হবে সেই খবরও কেউ বলতে পারে না। এখন কী করবো ভেবে কূল পাই না। গ্রামে থাকতে শুনলাম বাড়ি ভাড়া মওকুফ করা হবে, অথচ কাল রাতেই বাড়িওয়ালা ভাড়ার জন্য তাগাদা দিলো। এ কয়দিন খাবো কী?
মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় একটি কারখানার ৫ জন থাকেন এক বাসাতে। তাদের একজন রকিব মিয়া। তিনি বলেন, শনিবার রাতে ঢাকায় ফিরেছি। যখন শুনেছি কারখানা খুলছে তখন ভাবছি আসবো না। পরে দেখলাম চাকরিটা যদি চলে যায়। এখন এসে দেখি বিপদ। বিকালে এক ঘণ্টা কারওয়ানবাজারে বসে থেকেছি, যদি কোনও ট্রাকে ফিরতে পারি। কেউ নেয়নি। ঢাকা থেকে বের হওয়া নাকি নিষেধ। একরকম বন্দিই হয়ে গেলাম। আমার সঙ্গে আরও যে চারজন থাকে, তাদের মধ্যে দুইজন হেঁটে রওনা দিয়েছে কুমিল্লার পথে। কোনোমতে ঢাকা ছাড়তে পারলে একটা না একটা ব্যবস্থা হবে। কিন্তু ঢাকায় থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। আর বাড়ি ভাড়ার চাপ তো আছেই। আমাদের কেবল যাওয়া আর আসাই হলো। এই ভোগান্তির জন্য কার কাছে অভিযোগ করবো।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, একদিকে করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক, অন্যদিকে গার্মেন্টস মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে লাখ লাখ শ্রমিক হয়রানির শিকার। ওদের ঘর ভাড়া দিতে না পারলে থাকার জায়গা নেই।
করোনা মহামারির মধ্যে এমন অমানবিক অবস্থার মধ্যে ফেলে দেওয়ার দায় কোনোভাবেই মালিক এড়াতে পারে না। তিনি বলেন, ২৫ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণার ফলে একবার শূন্যহাতে মাসের শেষে বাড়ি গিয়েছেন তারা। এরপর আবার অর্থ জোগাড় করে কোনোমতে কাজে ফিরেছেন বেতনটা পাবার আশায়। আসার সময় ভাইরাস কতটা সংক্রমিত হয়েছে তা আমরা এখনও জানি না। যে শ্রমিক ঢাকায় এসেছেন তারা কি ফিরে যাবেন না থাকবেন এই অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। আর যেতে চাইলেই তো এখন আর সেটা পারছেন না। ঢাকা থেকে বের হতেও তাদের পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হবে। সেক্ষেত্রে মালিককেই তার কারখানার শ্রমিকের বাঁচার দায়িত্ব নিতে হবে। যে কয়দিন বেতন দিতে পারছেন না তাদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করেন। এই লোকগুলো আত্মসম্মান নিয়ে কাজ করে খেয়েছে, হাত পাততে শেখেনি।
এ বিষয়ে বিজিএমইএ ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল মান্নান বলেন, তাদের বেতন আমরা সঠিক সময়েই দিতে পারবো, ফলে চিন্তার কিছু নেই। সঠিক সময় বলতে কী বুঝাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণত প্রথম সপ্তাহে বেতন ভাতা পরিশোধ করা হয়ে থাকে, সেটাই হবে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *