বিশেষ প্রতিবেদক : দুর্নীতির দুই মামলায় দ- নিয়ে গত প্রায় ১৫ মাস ধরে কারাবন্দি বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তার মুক্তির দাবিতে মাঝেমধ্যে ঝটিকা মিছিল করেন দলের কিছু নেতাকর্মী। আর গণমাধ্যমে নেতাদের বক্তব্য। তিনবার সরকার পরিচালনাকারী দলটির সেসব মিছিলও আবার মাত্র কয়েক শ গজের রাস্তায় সীমাবদ্ধ। ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। আর দলের নেত্রীর মুক্তি চেয়ে এখান থেকে মিছিল বের করে নেতাকর্মীরা নয়াপল্টন সন্নিহিত নাইটিঙ্গেল মোড় ঘুরে আবার নয়াপল্টনেই শেষ হয়।
ইদানীং মিছিলে আগের চেয়ে কর্মীদের উপস্থিতি বেড়েছে। কিন্তু রাজধানীর আর কোথাও মিছিল-সমাবেশ না থাকায় ক্ষুব্ধ দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কারাবাস বছর পার করেছে। শারীরিক সমস্যার কারণে এখন তিনি কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন।
দল-প্রধান কারবন্দি হওয়ার পর শীর্ষ নেতাদের কয়েকজন তার মুক্তির দাবিতে জোরালো আন্দোলনের তাগিদ দিয়ে আসছেন। তবে এখন পর্যন্ত দলটির সিদ্ধান্তকর্তারা তেমন কোনো কর্মসূচি দিতে পারেননি। এ নিয়ে দলটিতে নানা মতভেদও ফুটে এসেছে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে প্রথমে প্রত্যাখ্যান, পরে অংশগ্রহণ করে আবার নির্বাচিতদের সংসদে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত, সেটা ভেঙে সংসদে যোগদান- এমন হ য ব র ল নেতৃত্বের কারণে বিএনপি তার চেয়ারপারসনের মুক্তি নিয়ে আদৌ কোনো কর্মসূচি দিতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান খোদ দলটির মধ্যমস্তরের নেতৃত্ব।
গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা হওয়ার পর কারাগারে নেয়া হয় বেগম খালেদা জিয়াকে। এরপর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও তার সাজা হয়। রায়ের পরই সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে পুরোনো ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। মাঝে একবার বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে চিকিৎসা শেষে আবার নেয়া হয় নাজিম উদ্দিন রোডে। গত এপ্রিলের শুরু থেকে আবার বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে চিকিৎসা চলছে তার।
এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেই তাকে নিয়ে যাওয়া হবে কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখানে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে তার বিরুদ্ধে চলমান অন্যান্য মামলার বিচারকাজ শুরু হয়েছে।
এদিকে দলীয় প্রধানের মুক্তির দাবিতে শুরু থেকেই অনেকটা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি। মানববন্ধন, কালো পতাকা মিছিল, স্মারকলিপি প্রদান, অনশনের মত কর্মসূচি পালন করেই ক্ষান্ত ছিল দলটি। যদিও নেত্রীর মুক্তির জন্য কঠোর কর্মসূচি নেওয়ার কথা প্রায়ই শোনা যায় দলটির শীর্ষ নেতাদের মুখে।
তবে বর্তমানে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে তেমন কোনো কর্মসূচি নেই বিএনপির। এ অবস্থায় কিছুটা সক্রিয় দেখা গেছে দলটির অঙ্গসংগঠনগুলোকে। এক দিন পর পর এসব সংগঠনের নেতাকর্মীরা সুযোগ পেলেই বিক্ষোভ করছেন। এসব মিছিলের সবগুলোতেই নেতৃত্বে থাকেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এ নিয়ে খোদ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যেই ক্ষোভ রয়েছে। তারা বলছেন, বিক্ষোভ করে নেত্রীর মুক্তি মিলবে না। এ জন্য কঠোর কর্মসূচি দেয়ার পরামর্শ তাদের।
গত ৬ মে ঢাকা মহানগর পশ্চিমের নেতাকর্মীরা রিজভীর নেতৃত্বে মিছিল করেন। গত শনিবার আবার নয়াপল্টন এলাকায় মিছিল করে ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া ঢাকার সব ইউনিট ও বড় বড় শাখার নেতাকর্মীরা। গত ১০ মে নয়াপল্টনে মহিলা দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে মিছিল করেন রিজভী। তারাও ‘নির্ধারিত এলাকা’ অর্থাৎ নয়াপল্টন থেকে নাইটিঙ্গেল পর্যন্ত ঘুরে মিছিল শেষ করেন।
গত সোমবার একই জায়গায় রিজভী আহমদের নেতৃত্বে মিছিল করে যুবদল। মিছিলটি নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হয়ে নাইটিঙ্গেল ঘুরে আবারও নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে গিয়ে শেষ হয়।
এর আগের দিন অর্থাৎ রবিবার একই এলাকায় রিজভীর নেতৃত্বে মিছিল করে ওলামা দল। মঙ্গলবার মিছিল করে স্বেচ্ছাসেবক দল। এ ছাড়াও একই স্টাইলে তাঁতী দল, মৎসজীবী দলসহ অন্যান্য সংগঠনের পক্ষ থেকে ঝটিকা মিছিল করা হয়।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তৈমুর আলম খন্দকার কর্মসূচি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এভাবে খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে না। দিনক্ষণ ঠিক না করে ঈদের পর, পূজার পর আন্দোলনের কথা না বলে এখনই মাঠে নামা উচিত। দলের কাইকমান্ডকে এটা বুঝতে হবে।
যদিও কেউ আবার মনে করেন কিছু না হওয়ার থেকে বিক্ষোভ হচ্ছে সেটাও মন্দ নয়। যদি এতে করে নেতাকর্মীরা উদ্বুদ্ধ হয় সেটাও অর্জন।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নাজমুল ইসলাম বলেন, কিছু না হওয়ার চেয়ে এটা ভালো। সবাই যদি উদ্বুদ্ধ হয় সেটাও তো খারাপ না। যদিও সবার প্রত্যাশা আরো কার্যকর কর্মসূচি। তবে আশা করছি এমন বিক্ষোভ থেকে সামনে ভালো কিছু হবে।
বিএনপির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দিন যাচ্ছে অথচ দলের চেয়ারপারসনের মুক্তির জন্য কিছুই করতে পারছি না। তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও হতাশ। কারণ কার্যকর আন্দোলন করতে না পারলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে তা বুঝতে হবে।
এদিকে দীর্ঘদিন আইনি চেষ্টা চালিয়েও জামিনের ব্যবস্থা করাতে না পেরে অনেকটা হতাশ খালেদা জিয়ার আইনজীবীরাও। তারা প্রায়ই বলছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি আইনিভাবে সম্ভব নয়। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তার মুক্তি হতে পারে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমরা আইনের সবগুলো দিক থেকে চেষ্টা করেছি। কিন্তু বারবার জামিন আটকে দেয়া হয়েছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি। তবে কতটুকু সফল হওয়া যাবে তা সময় বলে দিবে।
এদিকে এক আইনজীবী যখন এ কথা বলছেন তখন দলের প্রভাবশালী নেতা ও আইনজীবী মওদুদ আহমদ বলেছেন, সরকারের কূটকৌশলের কারণে খালেদা জিয়া জামিন পাচ্ছেন না। তারপরও আমাদের আইনি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ শেষ পর্যন্ত আন্দোলন ছাড়া বেগম জিয়ার মুক্তি অর্জন করা সম্ভব হবে না। এটা আমরা সবাই বুঝি।
সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্দোলন এবং আইনি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে চেয়ারপারসনের মুক্তি চাই। যদিও তাতে সরকারের কোনো কর্ণপাত নেই। তাই বিকল্প ভাবার সময় এসেছে। নিশ্চয়ই ভাবা হবে। বিকল্প কী ভাবা হতে পারে এমন প্রশ্নের অবশ্য জবাব দেননি এই প্রবীণ আইনজীবী।