হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের দীর্ঘ লাইন

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন স্বাস্থ্য

লকডাউন ঘোষণার দিনে করোনায় মৃত্যু বাড়ল
আইসিইউয়ের বাইরে ফ্লোর-বেঞ্চে

বসে দিনরাত কাটে স্বজনদের

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর করোনা হাসপাতালে ঠাঁই হচ্ছে না রোগীর। মিলছে না শয্যা। দিনরাত হাসপাতালে দিগি¦দিক ছুটোছুটির পর অবশেষে অজানা আশঙ্কা নিয়ে ফিরতে হচ্ছে বাড়িতে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও বলছে, রোগীর চাপ সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না তাদের পক্ষে।
সাইরেন বাজিয়ে আসা এক-একটা অ্যাম্বুলেন্স যেন প্রবেশ করছে এক একটা দুঃসংবাদকে সঙ্গী করেই। এমনিতে করোনা রোগীতে ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই অবস্থায় নাজুক হাসপাতালের চিকিৎসাব্যবস্থা। তার সঙ্গে প্রতি মিনিটে যোগ হচ্ছে নতুন রোগী।
কেউ অপেক্ষায় আছেন আগের দিন রাত থেকে ন্যূনতম ৩/৪ ঘণ্টা। তবু মিলছে না সিট। যারা জরুরি অবস্থায় আসছেন, হাসপাতালের বেডে জায়গা না পেলেও বাইরে অপেক্ষমাণ অবস্থায় তাদের অনেককে অক্সিজেনসহ জরুরি চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে।
রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড ১০সরকারি হাসপাতালে ২হাজার ৫১১সাধারণ শয্যার সবগুলোতে রোগী তো আছেই, কোথাও কোথাও শয্যার চেয়ে দ্বিগুণ এখন ভর্তিকৃতর সংখ্যা। আর আইসিইউ তো এখন রীতিমতো সোনার হরিণ! রোগী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক (সহকারী) নাহিদ হোসেন বলেন, সেটআপ করতে সময় লাগবে। সময়টা দিতে হবে। অনেক হাসপাতালে জায়গা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্নভাবে অক্সিজেন বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এভাবে যদি রোগী বাড়তে থাকে তাহলে এগুলোও শেষ হয়ে যাবে।
দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করলেও অনেক রোগীরা জানেন না আদৌ ভর্তির সুযোগ পাবেন কিনা, এ অবস্থায় বিদ্যমান হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে ফিল্ড হাসপাতাল নির্মাণের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এমএসএ মনসুর আহমেদ।
এর মধ্যে রাজধানীর উত্তর সিটি করপোরেশানের মহাখালী মার্কেটে এক হাজার ২৫০ শয্যার কোভিড হাসপাতালের জন্য প্রস্তুত করার কাজ চলছে। এ ধরনের হাসপাতাল সংখ্যা দ্রুত বাড়িয়ে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার দাবি সংশ্লিষ্টদের।
লকডাউন ঘোষণার দিনে করোনায় মৃত্যু বাড়ল : মহামারি করোনা ভাইরাসে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন আরও ৫৮ জন। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৯ হাজার ২১৩ জনে। এছাড়া দেশের ইতিহাসে গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৬৮৩ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত মোট করোনা রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৩০ হাজার ২৭৭ জনে।
করোনাভাইরাস নিয়ে শনিবার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, এদিন সুস্থ হয়েছেন আরও ২ হাজার ৩৬৪ জন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ৪৯ হাজার ৭৭৫ জন।
এর আগে শুক্রবার দেশে আরও ৬ হাজার ৮৩০ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়। এছাড়া আক্রান্তদের মধ্যে মারা যান আরও ৫০ জন।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডওমিটারের তথ্যানুযায়ী, শনিবার সকাল পর্যন্ত বিশ্বে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ কোটি ৮ লাখ ৭ হাজার ১৯০ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ২৮ লাখ ৫০ হাজার ৩৮৫ জনের। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১০ কোটি ৫৩ লাখ ৮৫৬ জন।
করোনায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়েছে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রে। তালিকায় শীর্ষে থাকা দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমিত হয়েছেন ৩ কোটি ১৩ লাখ ১৪ হাজার ৬২৫ জন। মৃত্যু হয়েছে ৫ লাখ ৬৭ হাজার ৬১০ জনের।
আক্রান্তে ও মৃত্যুতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ব্রাজিলে এখন পর্যন্ত সংক্রমিত হয়েছেন এক কোটি ২৯ লাখ ১২ হাজার ৩৭৯ জন এবং মারা গেছেন ৩ লাখ ২৮ হাজার ২৬৬ জন।
আক্রান্তে তৃতীয় এবং মৃত্যুতে চতুর্থ অবস্থানে থাকা ভারতে এখন পর্যন্ত করোনায় এক কোটি ২৩ লাখ ৯১ হাজার ১২৯ জন সংক্রমিত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে এক লাখ ৬৪ হাজার ১৪১ জনের।
আক্রান্তের দিক থেকে চতুর্থ স্থানে ফ্রান্স রয়েছে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪৭ লাখ ৪১ হাজার ৭৫৯ জন। ভাইরাসটিতে মারা গেছেন ৯৬ হাজার ২৮০ জন।
আক্রান্তের দিক থেকে রাশিয়া রয়েছে পঞ্চম স্থানে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন ৪৫ লাখ ৬৩ হাজার ৫৬ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৯৯ হাজার ৬৩৩ জন।
এদিকে আক্রান্তের তালিকায় যুক্তরাজ্য ষষ্ঠ, ইতালি সপ্তম, তুরস্ক অষ্টম, স্পেন নবম এবং জার্মানি দশম স্থানে আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩তম।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২১৮টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯।
আইসিইউয়ের বাইরে ফ্লোর-বেঞ্চে বসে দিনরাত কাটে স্বজনদের : রাজধানীর একটি হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) সংলগ্ন ছোট্ট বারান্দার ফ্লোরে মাদুরের ওপর বেঘোরে পড়ে ঘুমাচ্ছেন দুই তরুণ। তাদের একজনের পরনে লুঙ্গি ও হাফ হাতা টিশার্ট, মুখে মাস্ক, আরেকজনের পরনে জিন্স ও হাফ হাতা টিশার্ট। আশেপাশে কয়েক জোড়া জুতা, বেঞ্চের উপর মেলে দেয়া গামছা, পানির বোতল, একাধিক সেট পিপিই, প্লাস্টিকের বল ও কাপড়ের পোটলা।
হঠাৎ একজন নিরাপত্তারক্ষী উচ্চস্বরে আইসিইউ বেডের রোগী আছেন, বলতেই দুই যুবকের একজনকে লাফিয়ে উঠে কয়েক সেকেন্ডে লুঙ্গি খুলে প্যান্ট পরে আইসিইউ-এর দরজার সামনে দৌড়ে যেতে দেখা যায়।
উপস্থিত একজন নার্স হাতে একটি স্লিপ ধরিয়ে দিতেই ওই যুবককে দৌড়ে লিফটে নিচে নামতে দেখা যায়। যে যুবকটি কিছুক্ষণ আগে দৌড়ে ওষুধ ও ইনজেকশন আনতে গিয়েছিলেন, তিনি ফিরে এসে নার্সের হাতে ওষুধ ও ইনজেকশন তুলে দিয়ে এবার বেঞ্চিতে বসে হাঁপাতে থাকেন।
গত বুধবার (৩১ মার্চ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এর কেবিন ব্লকে করোনা রোগীদের জন্য আপাতত ব্যবহৃত সাততলার করোনা আইসিইউ-এর বাইরে এ প্রতিবেদকের চোখে এমন দৃশ্যে ধরা পড়ে।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা সুমন ইসলাম নামের ওই যুবক জানান, তার ৭০ বছর বয়সী বাবা করোনায় আক্রান্ত। এখন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। বাবাকে হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে পালা করে ডিউটি করেন ভাইবোনেরা। আইসিইউ এর পাশে ছোট্ট ওয়েটিং রুমই এখন তাদের বাড়িঘর। কখনও শুয়ে কখনও বসে দিনরাত কাটে তাদের। দৃষ্টি থাকে আইসিইউ এর দরজার দিকে। কখন বাবার বিষয়ে খবর আসে সেই অপেক্ষায়।
শুধু সুমন একা নন, আইসিইউতে ভর্তি থাকা ১৬টি শয্যার প্রতিটি শয্যার মুমূর্ষু রোগীদের বাড়িঘর এখন আইসিইউ সংলগ্ন ছোট্ট বারান্দায়। চিকিৎসকদের পরামর্শেই রোগীর এক বা একাধিক স্বজন আইসিইউ-এর বাইরে অপেক্ষায় থাকেন। প্রায় সময়ই আইসিইউ থেকে বিভিন্ন ওষুধ ও ইনজেকশন কিনে আনতে স্লিপ ধরিয়ে দেয়া হয়। এ কারণে সার্বক্ষণিক কাউকে না কাউকে অপেক্ষায় থাকতে হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন একাধিক রোগীর স্বজনরা জানান, করোনাকে সাধারণ রোগ ভেবে ঘরে বসে থাকা মোটেও ঠিক না। বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে করোনার উপসর্গ দেখা দেয়া মাত্রই হাসপাতাল বা চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে হবে। রোগীকে আইসিইউতে ভর্তি করে চিকিৎসা করাতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আইসিইউ বেডও সোনার হরিণ উল্লেখ করে তারা নানা তদবির করে আইসিইউ বেড পেয়েছেন।
বিএসএমএমইউ সূত্রে জানা গেছে, করোনা সেন্টারে ১৬টি আইসিইউ শয্যাসহ সর্বমোট ১৮৭টি শয্যা চালু আছে। গত ১ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ কোভিড-১৯ এর ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে শিগগিরই সাধারণ শয্যা সংখ্যা আরও ৫০টি এবং আইসিইউর শয্যা সংখ্যা আরও ১০টি বৃদ্ধি করার কথা জানিয়েছেন।
গত বছরের জুলাই মাস থেকে বিএসএমএমইউ করোনা ইউনিট চালু করে। গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত হাসপাতালে সর্বমোট সাত হাজার ১১৫ জনকে চিকিৎসা দেয়া হয়। তাদের মধ্যে চার হাজার ২৩৫ জনকে ভর্তি করা হয়। ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৫৫৯ জনের মৃত্যু হয়।


বিজ্ঞাপন