বিশেষ প্রতিবেদক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা প্রদানের জন্য জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। শেখ হাসিনা বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পাশে থাকবে জাপান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সম্মেলনে এশিয়ার পক্ষ থেকে আমি বক্তব্য দিয়েছি। এতে জঙ্গিবাদ ও রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করি। ভালোভাবে তুলে ধরি এসব বিষয়। মুসলিম দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষার বিষয়েও কথা হয়। রোববার (৯ জুন) বিকেলে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। সরকারপ্রধান তার সাম্প্রতিক জাপান, সৌদি আরব ও ফিনল্যান্ড সফরের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে এ সংবাদ সম্মেলন ডাকেন। চীন সফর করে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার চিন্তা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী জুলাই মাসে আমার চীন সফরের পরিকল্পনা আছে। সেখানেও আমি এ বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করব।
অনেকে চায় না রোহিঙ্গারা ফেরত যাক : রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অপ্রীতিকর ঘটনার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সরকারপ্রধান বলেন, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। বিজিবি, পুলিশ ও সেনাবাহিনী আছে। সবসময় টহলসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আর সমস্যা দেখছি- ভলান্টিয়াররা (স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা) চায় না কোনো রিফিউজি তাদের স্বদেশে ফিরে যাক। তালিকা যখন করলাম প্রত্যাবাসনের জন্য, তখন তারা (রোহিঙ্গারা) আন্দোলন করলো তারা ফেরত যাবে না। এর পেছনে কারা কেন উসকানি দেয়? অনেক সংস্থা চায় না তারা ফিরে যাক। কারণ গেলে তাদের চাকরি থাকবে না। ফান্ড আসবে না।
জাপান সফর : প্রথমে জাপান সফরের বিষয়টি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাপান সফরে কিছু চুক্তি সই করেছি। কয়েকটি প্রকল্পে তারা বিনিয়োগ করছে। ২৫০ কোটি ডলারের উন্নয়ন সহায়তা চুক্তি সই হয়েছে। ঢাকার হলি আর্টিজানে নিহত জাপানিদের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করে তাদের সমবেদনা জানানোর বিষয়টিও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
নিক্কেই সম্মেলনে কি নোট স্পিকার হিসেবে বক্তৃতার বিষয়টি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেখানে বক্তৃতায় এশিয়ার দরিদ্র ও গরিব দেশগুলোকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্বরোপ করি।
জাপান সফর শেষে সৌদি সফরের বিষয়টি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাপান থেকে সৌদি আরব যাই। যাওয়ার সময় পাইলট যখন জানালেন, আমরা চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে যাচ্ছি, তখন মনে হলো, কোথায় যাচ্ছি? নিজের দেশে নেমেই যাই, পরের দিন যাই সৌদি আরবে।
কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার উদ্যোগ : তিনি এসময় বলেন, কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার উদ্যোগ নিয়েছি। এটাকে আন্তর্জাতিক রুটের সঙ্গে সংযুক্ত করার কাজ চলছে। এখানে জ্বালানি নেবে আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইটগুলো। শুধু জ্বালানিই নেবে না, সুযোগ পেলে ঘুরবেও। যদি আমরা সেভাবে সি-বিচটাকে দেখাতে পারি। কিছু কিছু এলাকা বিদেশি পর্যটকদের জন্য ডেডিকেটেড (তাদের উপযোগী) করে দেবো। এটা করতে পারলে আমরা পর্যটনে আরও এগিয়ে যাবো।
ঈদে জঙ্গি হুমকি ছিল : এবার ঈদ জামাতের সময় জঙ্গি হামলার হুমকি ছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আন্তরিক চেষ্টায় কোনো অঘটন ছাড়াই সব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ফিনল্যান্ড সফরে প্রবাসীদের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, নানা হুমকির মধ্যেও এবারের ঈদ ভালোভাবে শেষ হয়েছে এবং সেজন্য তিনি শুকরিয়া করছেন। সে প্রসঙ্গ টেনে একজন সাংবাদিক জানতে চান, ঠিক কী ধরনের হুমকি ঈদের সময় ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে ২০১৬ সালের জঙ্গি হামলার পর থেকেই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও পুলিশ কড়া নজরদারি শুরু করে। কোথাও কোনো ধরনের তথ্য পেলেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
আপনারা জানেন যে নানা নামে নানাভাবে সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে নানা ধরনের থ্রেট কিন্তু দিতেই থাকে। সারাক্ষণ কিন্তু এগুলো আসছে। সবটা আমি বলে মানুষকে ভীত করতে চাই না। কিন্তু যতদূর পারি, এগুলোর পেছনে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তদন্ত করে এবং তাদের বিরুদ্ধে যা যা ব্যবস্থা নেওয়ার, তা আমরা নিয়ে থাকি।
এবার ঈদের আগেও তেমন হুমকি ছিল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঈদের জামাতের সময় আমি সত্যিই খুব চিন্তিত ছিলাম। কারণ এমন এমন ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তা যেন কোনোমতে না ঘটে।
সরকারপ্রধান বলেন, তিনি দেশে বা দেশের বাইরে যেখানেই থাকুন না কেন, দেশে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সব সময় তার যোগাযোগ থাকে। এবারও বিভিন্ন ঈদ জামাত সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার কাছে ‘মেসেজ’ চলে গেছে।
আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা, আমাদের পুলিশ বাহিনী, আমাদের র্যাব থেকে শুরু করে সকলেই খুব আন্তরিকতার সঙ্গে তারা কাজ করেছে। সেজন্য খুব সুষ্ঠুভাবে ঈদের জামাতগুলো সম্পন্ন হয়েছে।
গুলশান হামলার এক সপ্তাহের মাথায় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাতে জঙ্গিদের হামলাচেষ্টার ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, একবার শোলাকিয়াতে একটা ঘটনা ঘটেছে, চেষ্টা হয়েছে। এবার কিন্তু কেউ কিছু করতে পারেনি।
জঙ্গিবাদ দমনে জনগণের সচেতনতাকে বাংলাদেশের ‘সবচেয়ে বড় শক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, জনগণ কিন্তু যথেষ্ট সচেতন। আমরা জনগণকে সম্পৃক্ত করেই এ ধরনের হুমকি মোকাবিলা করতে চাই। সেজন্য জনগণের কাছে সব সময় আমার আবেদন থাকবে, তারা যেন এ বাপারে সজাগ থাকেন, সচেতন থাকেন। কারণ এসব ঘটনা আমাদের উন্নয়নের গতিধারাটা ব্যহত করবে। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, কোথাও কোনো তথ্য পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব।
তিস্তা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করার দরকার নেই : ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করার দরকার নেই বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়ন করা গেলে পানির জন্য আর কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না বাংলাদেশকে।
সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক নরেন্দ্র মোদির জয় ও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন করেন। তিনি জানতে চান, গত বছর শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, তিস্তায় সুবাতাস বইবে। নতুন করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই ইস্যুর কী হবে জানতে চান ওই সাংবাদিক।
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা মেরিটাইম বাউন্ডারির মতো কঠিন সমস্যার সমাধান করেছি। ছিটমহল বিনিময় করেছি। অথচ এসব নিয়ে পৃথিবীর বহু দেশে যুদ্ধ বেঁধে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা উৎসবমুখর পরিবেশে এসবের সমাধান করেছি। বহু কঠিন সমস্যা সমাধান করেছি। পানির জন্য কারও মুখাপেক্ষী থাকতে হবে না, ডেল্টা প্ল্যান করেছি। পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করলে, পানি পানি করে কারও দিকে চেয়ে থাকতে হবে না। তাই তিস্তা নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করার দরকার নেই।
ভারত থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমাদনি করা হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আরও নেবো। সাবস্টেশন হচ্ছে, দেশের ৯৯ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে, বাকি আছে যেটুকু, ২০২১ সালের মধ্যে সেটাও হয়ে যাবে। তখন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ যাবে। ২০২৪ সালের মধে আমরা কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারব।
তারেকের শাস্তি কার্যকর হবে : লন্ডনে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এই নাম নিতেও ঘৃণা লাগে। তবে প্রধানমন্ত্রী এও বলেছেন, আজ হোক কাল হোক এক দিন না একদিন তার (তারেক রহমান) শাস্তি কার্যকর হবে।
সংবাদ সম্মেলনে তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে প্রশ্নে শেখ হাসিনা একুশে আগস্ট হত্যা মামলার প্রসঙ্গ তুলে আনেন। ওই মামলায় ঘোষিত রায়ে তারেক রহমানের যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছেন আদালত।
শেখ হাসিনা বলেন, ওই একুশে আগস্টের হামলায় আইভি রহমানসহ ২৮ জন মানুষ নিহত হন। শতাধিক মানুষ আহত হন। শুধু একুশে আগস্ট নয়, ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গেও যুক্ত সে। শেখ হাসিনা বলেছেন, এসব ব্যক্তির জন্য অনেকের মায়াকান্না দেখছি। আমরা যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছি। তবে ওরা অনেক টাকার মালিক। সব সময় চেষ্টা করে ঝামেলা সৃষ্টি করার। আমি সেখানে গেলেও ঝামেলা সৃষ্টি করতে চায়। তবে যাই হোক, তার শাস্তি কার্যকর হবে।
ইমিগ্রেশনের ক্ষেত্রে কঠোর হওয়ার নির্দেশ
ইমিগ্রেশনের ক্ষেত্রে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁকে ফিনল্যান্ড থেকে আনতে যাওয়ার বিমানের উড়োজাহাজের পাইলটের পাসপোর্ট ছেড়ে যাওয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এটা ইমিগ্রেশনের দুর্বলতা। শেখ হাসিনা বলেছেন, দিনে দিনে ভিআইপি ও ভিভিআইপির সংখ্যা বাড়ছে। আরও যত ‘ভি’ লাগুক না কেন কাউকে ছাড়া হবে না।
গত ২৮ মে জাপান দিয়ে ত্রিদেশীয় এই সফর শুরু করেন শেখ হাসিনা। পরে সেখান থেকে সৌদি আরব ও ফিনল্যান্ড যান তিনি। সফরে তৃতীয় ও শেষ দেশ ফিনল্যান্ড থেকে শনিবার (৮ জুন) সকালে দেশে পৌঁছান তিনি। ত্রিদেশীয় এই সফরের শুরুতেই জাপানের টোকিওতে ‘দ্য ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন তিনি। বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য জাপানের সঙ্গে আড়াইশ কোটি ডলারের উন্নয়ন সহায়তা চুক্তি সই হয় তার সফরে। জাপান সফর শেষে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্সের (ওআইসি) চতুর্দশ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে ৩০ মে শেখ হাসিনা সৌদি আরবে যান। সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পর পবিত্র ওমরাহ পালন করেন তিনি, জিয়ারত করেন মহানবীর (স.)-এর রওজা। সৌদি আরব থেকে গত ৩ জুন ফিনল্যান্ড যাত্রা করেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে ৪ জুন দেশটির প্রেসিডেন্ট সাউলি নিনিস্তোর সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। পরদিন ৫ জুন অল ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগ ও ফিনল্যান্ড আওয়ামী লীগ তার সম্মানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজন করে। প্রধানমন্ত্রী সেই অনুষ্ঠানেও যোগ দেন।