বিশেষ প্রতিবেদক : পুলিশের বিতর্কিত ডিআইজি মিজানুর রহমানের ‘ঘুষ কেলেঙ্কারির’ তদন্তে অবশেষে কমিটি গঠন হয়েছে। তিন সদস্যের এই কমিটি প্রতিবেদন দিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। তবে এই বিষয়টি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীটির কোনো কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করে কিছু বলতে চাননি। যদিও একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশ সদরদপ্তরের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে উঠা নতুন অভিযোগের তদন্তের নেতৃত্বে থাকবেন অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মইনুর রহমান চৌধুরী (অ্যাডমিন অ্যান্ড অপারেশন)। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) শাহাবুদ্দীন কোরেশী ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার মিয়া মাসুদ হোসেন।
কত দিনের মধ্যে এই কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে, তারা কীভাবে কাজ করবে এবং কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে, এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ডিআইজির বিরুদ্ধে সবশেষ অভিযোগ, তার বিরুদ্ধে উঠা দুর্নীতির অনুসন্ধান নিজের পক্ষে নিতে দুদক কর্মকর্তাকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন। ঘুষ নেয়া এবং দেওয়া-দুটোই আইনের চোখে অপরাধ। ডিআইজি প্রকাশ্যে এই অপকর্ম করার কথা ঘোষণা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। অথচ পুলিশের প্রকাশ্য কোনো তৎপরতাই নেই তার বিরুদ্ধে। যদিও খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, ঘুষ যিনি দিয়েছেন এবং নিয়েছেন-ব্যবস্থা নেয়া হবে দুই জনের বিরুদ্ধেই।
ডিআইজি মিজান যাকে ঘুষ দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন, তিনি দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির। গত ১০ জুন তাকে বরখাস্ত করে অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে দুদক। কিন্তু পুলিশের নির্লিপ্ততা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছিল। ডিআইজি মিজানকে তারা বাঁচাতে চাইছে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠে।
এর আগেও ডিআইজির বিরুদ্ধে উঠা গুরুতর একটি অভিযোগের তদন্ত করেছিল পুলিশ। তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনও পাঠানো হয়। কিন্তু প্রায় দেড় বছরেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কেন ডিআইজি সে সময় পার পেয়ে গেছেন, সেটি এখনো বড় প্রশ্ন।
ডিআইজি মিজান গণমাধ্যমের শিরোনাম হন ২০১৭ সালের একেবারে শেষের দিকে। তখন তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে কাজ করেন। ওই বছরের মাঝামাঝি সময়ে এক নারীকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বিয়ে করার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। একটি জাতীয় দৈনিকে বিস্তারিত তথ্য ছাপা হলে তদন্ত করে পুলিশ। ডিআইজিকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয় পুলিশ সদরদপ্তরে।
এর পরেও আরো একটি গুরুতর অভিযোগ উঠে ডিআইজির বিরুদ্ধে। তখনও পার পেয়ে যান তিনি। ২০১৮ সালের এপ্রিলের দিকে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের উপস্থাপিকা ও তার স্বামীকে মোবাইল ফোনে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠে ডিআইজির বিরুদ্ধে। দুই জনের কথোপকথন সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ফাঁসও হয়। এতে ডিআইজি বলেন, ওই উপস্থাপিকা এবং তার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করে তাকে ৬৪ টুকরো করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেবেন তিনি।
ওই উপস্থাপিকা সে সময় থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। কিন্তু তার তদন্ত আর করেনি পুলিশ। কেন তদন্ত হয়নি, এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়নি। এরপর ওই নারীর নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে তাতে অশালীন ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনাতেও ডিআইজির বিরুদ্ধে সাইবার ক্রাইম ইউনিটে অভিযোগ জমা পড়ে। কিন্তু তারও তদন্ত আর আগায়নি।
এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন ডিআইজির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধানে নামে। তদন্তে দেখা যায়, এই পুলিশ কর্মকর্তার বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে যা তার আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
ডিআইজি মিজান বারবার পার পেয়ে যাওয়ায় তার বিরুদ্ধে ঘুষ কেলেঙ্কারির তদন্ত ও বিচার নিয়েও আছে সংশয়। গত ১১ জুন গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতি দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এই সংশয় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে আমরা জেনেছি যে, পুলিশ প্রশাসন এখনও কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। তারা তদন্ত করে দেখার কথা বললেও সেটা কবে শুরু বা শেষ হবে তা আমরা জানি না। আমরা এটাও জানি না যে শেষ পর্যন্ত এই অভিযোগও ধামাচাপা পড়ে যাবে কি না।
ডিআইজি মিজানের বিষয়ে পুলিশ তথা সরকারের নির্লিপ্ততায় বিস্মিত খোদ দেশের সর্বোচ্চ আদালত। গত ১৬ জুন অন্য একটি মামলার শুনানিতে তার প্রসঙ্গ আসে। দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলমকে বিচারপতি বলেন, ডিআইজি মিজান কি দুদকের চাইতে বড়? তাকে তো আপনি অ্যারেস্ট করতে পারছেন না। হ্যাঁ তাকে কেন অ্যারেস্ট করছেন না? এই মামলায় তাকে কেন আপনি (দুদক) অ্যারেস্ট করছেন না?