অবৈধ ওষুধের রমরমা বাণিজ্য

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন ঢাকা বানিজ্য রাজধানী সারাদেশ স্বাস্থ্য

*মসলা দিয়ে তৈরি হচ্ছে হার্টের ক্যাপসুল!
*ডাক্তারের চেম্বারে সব ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ
*মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংসে আদালতের নির্দেশ

মহসীন আহমেদ স্বপন : দেশজুড়ে চলছে অবৈধ ওষুধের রমরমা বাণিজ্য। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজসে ঢাকার আশপাশে গড়ে উঠেছে নিম্নমানের অনেক ওষুধ কারখানা। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকায়ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। দু’একটি ওষুধের অনুমোদন নিয়ে তার আড়ালে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করছে ওইসব কোম্পানি। এর মাধ্যমে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ফলে হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের কিছু কর্মকর্তা নিয়মিত অবৈধ অর্থের ভাগও পাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।
রাজধানীর জুরাইনে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়েছে র‌্যাব। এসময় বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে ৯ টি গোডাউনসহ একটি প্রতিঠানকে সিলগালা করা হয়েছে। এছাড়া ৩০ লাখ টাকা জরিমানাসহ ৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়েছে। সোমবার (১৭ জুন) দুপুরে জুরাইনে এ অভিযান চালানো হয়।
গোডাউনে গিয়ে দেখা যায়, সাধারণত আমরা যেসব মসলা খেয়ে থাকি সেসবই বোতলে ভরে রাখা হয়েছে। এছাড়া এসব সাধারণ জিনিসপত্র দিয়েই হার্টের ব্যথানাশক ক্যাপসুল বানানো হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে এসব ওষুধ খেলেই নাকি যেকোনো ব্যথা চলে যাবে। এদিকে এসব ক্যাপসুল একটি প্যাকেটে ভরে রাখা হয়েছে। যার গায়ে কোনোরকম কোনো ব্যাচ নং, ওষুধ তৈরি বা মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ কিছুই নেই। অথচ এসব ক্যাপসুল খুলে দেখা যায়, কালিজিরার গুড়া ছাড়া আর কিছুই হয়তো নেই। এই কোম্পানির আরো যেসব গোডাউন রয়েছে সেখানেও ভ্রাম্যামাণ আদালত অভিযান চালাবেন বলে জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালকের দফতরে বেশ কিছু লিখিত অভিযোগও জমা পড়েছে। এসব অভিযোগপত্রে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির মালিক ও অধিদফতরের কর্মকর্তাদের নানা অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
ডাক্তারের চেম্বারে সব ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ: বগুড়া শহরের চেলাপাড়ার মধুবন হল এলাকার চক্ষু চিকিৎসক বিপুল চন্দ্র সরকারের চেম্বারের ভেতর থেকে বিপুল পরিমাণ মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ জব্দ করা হয়েছে। একই সঙ্গে চেম্বারে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রাখায় ওই চিকিৎসককে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সোমবার বিকেলে বগুড়ার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে এ অভিযান পরিচালনা করা হয়।
বগুড়ার ড্রাগ সুপার আহসান হাবীব বলেন, বগুড়ার শহরতলীর চেলোপাড়া এলাকায় বিপুল চন্দ্র সরকার চোখের চিকিৎসা করান। তার কাছে গিয়ে সাধারণ রোগীরা মাঝেমধ্যে হয়রানির শিকার হন। এমনকি অনুমোদনহীন লাইসেন্স দিয়ে চলছে তার প্রতিষ্ঠান। এসব সংবাদের ভিত্তিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসক বিপুল চন্দ্র সরকারের চেম্বারে অভিযান পরিচালনা করেন। সেখান থেকে কার্টনভর্তি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ জব্দ করা হয়। সেই সঙ্গে কিছু চোখের লেন্সও জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় চিকিৎসক বিপুল চন্দ্র সরকারকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজ উদ্দিন।
এ ব্যাপারে জানতে চক্ষু চিকিৎসক বিপুল চন্দ্র সরকারের মোবাইলে বারবার কল দেয়া হলেও রিসিভ করেননি তিনি।
মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংসের নির্দেশ : সারা দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বাজার থেকে জব্দ করে এক মাসের মধ্যে ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। সেই সাথে এসব ওষুধ ব্যবসায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে মঙ্গলবার রুলসহ এ আদেশ দেন বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
রিটের পক্ষে আদালতে শুনানি করেন আইনজীবী এবিএম আলতাফ হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবিএম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
জানা যায়, গত বছর ২ জুলাই ধানম-ির পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও রাসায়নিক সংরক্ষণের অপরাধে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত বছর ২ জুলাই ধানম-ির পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও রাসায়নিক সংরক্ষণের অপরাধে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। সম্প্রতি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, গত ছয় মাসের বাজার তদারকি করে রাজধানীর প্রায় ৯৩ শতাংশ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ পেয়েছেন তারা।
এবিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন সংযুক্ত করে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি বন্ধ ও অবিলম্বে সেগুলো প্রত্যাহারের নির্দেশনা চেয়ে সোমবার আবেদনটি করেন জাস্টিস ওয়াচ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহফুজুর রহমান মিলন।
রিটকারী আিইনজীবী মাহফুজুর রহমান মিলন সাংবাদিকদের বলেন, আদালত অন্তর্র্বতীকালীন আদেশের সঙ্গে ফার্মেসি, ওষুধাগারে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি ও সংরক্ষণ বন্ধে নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে।
স্বাস্থ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, বাণিজ্য সচিব, শিল্প সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও উপ পরিচালক, পুলিশের মহাপরিদর্শক, বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি ও মহাসচিবকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
পত্রিকার প্রতিবেদন তুলে ধরে আইনজীবী এবিএম আলতাফ হোসেন বলেন, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নিজেই বলছে, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। এটা কিসের ভিত্তিতে বলছে, সে প্রতিবেদনটা দেখা দরকার। তাহলে বিষয়টি বুঝা যাবে। এসময় আদালত বলে, আমাদের সরকারি সংস্থা থাকার পরেও বাজারে ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ আছে এবং বিক্রি হচ্ছে। বিদেশে এ বিষয়গুলো শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেখে। এখানে বসে অনেক কথা তো বলা যায় না, অনেক কিছু গণমাধ্যমে চলে আসে।
পরে ‘রাজধানীর ৯৩ শতাংশ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে’ মন্তব্যের পক্ষে তথ্য-প্রমাণসহ প্রতিবেদন দিতে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও সংশ্লিষ্ট উপপরিচালককে নির্দেশ দেয় আদালত।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *