উপজেলায় আওয়ামী লীগ বিদ্রোহীদের জয়জয়কার

অন্যান্য এইমাত্র জাতীয় ঢাকা রাজনীতি সারাদেশ

বিশেষ প্রতিবেদক : দেশে পাঁচ ধাপের উপজেলা নির্বাচন শেষ হয়ে গেলো গত ১৮ জুন। নির্বাচনে ৪৭৩ উপজেলার মধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকে ৩২০টিতে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন। এর মধ্যে ১১৫ জন নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। চেয়ারম্যান পদে জয়ীদের মধ্যে ১৩৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। তবে এর মধ্যে ১৩ জন বাদে সবাই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। উপজেলা নির্বাচনের এ ফলাফলকে ‘বিদ্রোহীদের জয়জয়কার’ বলে অভিহিত করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বিদ্রোহীদের ক্ষেত্রে নমনীয় মনোভাব, মনোনয়ন দেওয়ার সময় ক্ষেত্র বিশেষে তারুণ্যের মত উপেক্ষা করা, নির্বাচনে স্থানীয় প্রভাব, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং মন্ত্রী-এমপিরা দল মনোনীত প্রার্থীকে সমর্থন-সহায়তা না করা বা বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় এত সংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী জিতেছেন।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. হারুন অর রশীদ বলেন, শক্তিশালী প্রতিপক্ষ না থাকায় এত বিপুল সংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। হয়তো নির্বাচনি মাঠে শক্তিশালী বিরোধী প্রতিপক্ষ না থাকায় আওয়ামী লীগও বিদ্রোহীদের বিষয়ে নমনীয় ছিল। আবার কিছু ক্ষেত্রে মন্ত্রী-এমপিরাও বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছেন।
জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে জাতীয় পার্টির চার জন আছেন। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে উপজেলা নির্বাচন বর্জন করলেও দলের অনেকেই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে নির্বাচনে অংশ নেন। এমন তিন জন জয়ীও হয়েছেন।
নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নৌকা প্রতীকে যে সংখ্যক আওয়ামী লীগ প্রার্থী জিতেছেন, তার প্রায় অর্ধেক প্রার্থী জিতেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ করে ভিন্ন প্রতীকে।
গত ১০ মার্চ প্রথম দফায় ৭৯টি উপজেলার মধ্যে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ ৫৬টিতে জয়লাভ করে। এর মধ্যে দলটির ১৪ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন বিনা ভোটে। বাকি ২৩টি উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচিত হন। এই স্বতন্ত্রদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী।
গত ১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে ১২৩টি উপজেলার মধ্যে ২৩টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাসহ আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ৭৭টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। এ দফায় জাতীয় পার্টি (এ) ২টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৪৪টিতে জয়ী হয়েছেন।
তৃতীয় ধাপের ভোট হয় গত ২৪ মার্চ। এতে ১২২টির মধ্যে আওয়ামী লীগ ৮৩টিতে জয়ী হয়। এর মধ্যে ৩১টির চেয়ারম্যান পদে দলের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এছাড়া জাতীয় পার্টি ১টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ৩৮টিতে জয়ী হয়।
চতুর্থ ধাপে ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত এ ধাপে ১২১টি উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগ ৩৯টি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাসহ ৮৮টি, জাতীয় পার্টি (জেপি) ১টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩২টিতে জয়ী হয়। এ ধাপে ১৫টি উপজেলায় সব পদে প্রার্থীরা বিনা ভোটে বিজয়ী হওয়ায় সেগুলোতে ভোটের দরকার হয়নি।
সর্বশেষ ১৮ জুন অনুষ্ঠিত পঞ্চম ধাপের ভোটে ২২ উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাঁচটিসহ ১৩টিতে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছে। এ ধাপে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে ৯টিতে বিজয়ী হয়েছেন।
মাগুরার মোহাম্মদপুর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান। কিন্তু জয়ী হয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী আবু আব্দুল্লাহ হেল বাকী বিল্লাহ। তিনি ওই উপজেলার একটি ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
আবু আব্দুল্লাহ বলেন, দলের স্থানীয় সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরও দলীয় নেতাকর্মীরা আব্দুল মান্নানের পক্ষে ছিলেন না। অর্থনৈতিক দুর্নীতি, নারী কেলেঙ্কারি এবং নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ হয়ে সবাই আমার পক্ষে কাজ করেছেন।
নড়াইলের লোহাগাড়ায় দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের উপ-সম্পাদক রশিদুল বাশার ডলার। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন থানা সভাপতি রুনু শিকদার এবং সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হক লিটু। স্থানীয় সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজা সমর্থন করেন রুনু শিকদারকে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকও দু’ভাগে ভাগ হয়ে থানা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পক্ষ নেন। ফলে হেরে যান ডলার। এজন্য তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং নেতাকর্মীদের অসহযোগিতার অভিযোগ করেন।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় দলীয় প্রার্থী ছিলেন রেজাউল করিম রাশেল। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে জয়ী হয়েছেন কামাল উদ্দিন সিকদার। রাশেলের দাবি, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক কামালের হয়ে সরাসরি প্রচার চালান। তার মিছিলেও অংশ নেন।
বিদ্রোহী প্রার্থী জেতার বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লী ও মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ বলেন, দল এটার কারণ খতিয়ে দেখবে। স্থানীয়ভাবে অনেকেই দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে, ক্ষেত্রবিশেষে অন্য প্রার্থীর পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দলের পরবর্তী কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লী ও মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘উপজেলায় আমাদের বেশ কিছু প্রার্থী হেরেছে। সেটার কারণ খুঁজে বের করতে সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা কাজ করছে। আওয়ামী লীগকে হারিয়ে যারা জয়ী হয়েছেন, তাদের জয়ের কারণ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। বিদ্রোহী বলে কিছু নাই। উপজেলা নির্বাচন হলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন। স্থানীয় অনেক ফ্যাক্টর সেখানে কাজ করে। আশা করি সাংগঠনিক সম্পাদকদের কাছ থেকে রিপোর্ট পেলে সব জানতে পারবো। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরোধিতাকারীদের শাস্তির যে আলোচনা হয়েছিল, আগামী কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসবে বলে আশা করছি।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *