রাজধানীর বহুতল ভবন
মহসীন আহমেদ স্বপন : প্রতিদিনই রাজধানীবাসী অসহনীয় যানজটের ভোগান্তিতে পড়ছেন। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসহনীয় এমন যানজটের জন্য পার্কিংয়ের স্থানে দোকানপাট অনেকাংশে দায়ী। শহরজুড়ে এমনিতেই পর্যাপ্ত পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। আবার যেসব ভবনে আছে, সেখানকার পার্কিং পরিসরও যথাযথভাবে ব্যবহার হচ্ছে না।
সরোজমিনে দেখা যায়, রাজধানীতে বিপুলসংখ্যক বহুতল ভবনের পার্কিংয়ের জায়গা অন্য কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। কোন কোন ভবনের নিচের অংশে পুরোটাই দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দিয়ে বা পজেশন আকারে অন্যত্র বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। যা ইমরাত বিধিমালার লঙ্ঘন। বহুতল ভবনের পার্কিংয়ের জায়গা অন্য কাজে ব্যবহৃত হওয়ায় ওসব ভবনের সামনে রাস্তায় গাড়ি রাখায় রাজধানীতে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। তাতে নষ্ট হচ্ছে মানুষের দৈনন্দিন কর্মঘন্টা। এমন পরিস্থিতিতে রাজধানীর বহুতল ভবনের পার্কিং স্পেসগুলো অন্য কাজ থেকে সম্পূর্ণ দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। বর্তমানে রাজধানীতে রাজউক সীমানায় ১ হাজার ৮১৮টি বহুতল ভবন রয়েছে। রাজউক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সম্প্রতি রাজধানীর আবাসিক ভবনগুলোতে রাজউক অনুমোদিত কার পার্কিংয়ের স্থানে অবৈধ দোকান-পাট বা অন্যান্য স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশনা দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। আগামী ছয় মাসের মধ্যে ভবনের নিচ থেকে এসব অবৈধ স্থাপনা ভেঙে বা উচ্ছেদ করে তিন মাস অন্তর অন্তর রাজউককে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
বুধবার রিটের চূড়ান্ত শুনানিতে এ বিষয়ে জারি করা রুল নিষ্পত্তি করে হাইকোর্টের বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর ও বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। অন্যদিকে রাজউকের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. ইমাম হাসান। রায়ে বলা হয়েছে, রাজধানীর বাসার মালিকদের অবগতির জন্য রাজউককে বাংলা এবং ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে নোটিশ প্রকাশ করতে হবে। সেই সঙ্গে রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় মাইকিং করে বাসার মালিকদের জানাতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, যেসব এলাকায় অবৈধ গাড়ি পার্কিং রয়েছে তা উচ্ছেদ করতে হবে
আদালত বলেন, রাস্তায় মুক্ত পরিবেশের জন্য রাজউকের অনুমতি ছাড়া কোনো ধরনের পার্কিং ব্যবস্থা করা যাবে না। আগামী ৬ মাসের মধ্যে নিজ দায়িত্বে ভবন মালিকদের এসব স্থাপনা ভাঙতে হবে। ভবন মালিকরা যদি এগুলো না ভাঙে তাহলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে ভেঙে দেবে। এক্ষত্রে অবৈধ স্থাপনা ভাঙা বা উচ্ছেদের খরচ ভবন মালিকদের বহন করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজধানীতে গড়ে ওঠা আবাসিক ও বাণিজ্যিক সকল শ্রেণীর ভবনেই পার্কিং স্পেস ভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইতিমধ্যে ওসব বহুতল ৩০৯ ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে। ওসব ভবনের মালিককে ভবনের পার্কিং স্পেস নির্দিষ্ট কাজে ব্যবহার করতে এবং দখলে থাকা পার্কিং স্পেস সম্পূণ খালি করতে রাজউকের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কেউ রাজউকের ওই নির্দেশ না মানলে পার্কিং স্পেস দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা বা দায়ী সংশি¬ষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে। মূলত বহুতল ভবনের পার্কিং স্পেসকে সঠিক কাজে ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতেই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সরোজমিনে আরো দেখা যায়, রাজধানীর অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে পরিচিত গুলশান, বনানী, বারিধারা, নিকেতন, কাওরান বাজার, খিলক্ষেত, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, নিকুঞ্জ, তেজগাঁও শিল্প এলাকাতে নির্মিত ভবনগুলোর বহুতল ভবনেই সবচেয়ে বেশি রাজউকের নিয়ম মানা হচ্ছে না। তার বাইরে একই জোনের দক্ষিণখান, আফতাবনগর ভাটারা ও জোয়ার সাহারা এলাকাসহ এ ৪ জোনে মোট ১০২ ভবনেই পার্কিং নীতিমালা মানছে না। তারপরই রয়েছে ৬ নং জোন এলাকা। ওই জোনে রাজধানীর অর্থনৈতিক লেনদেনের প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলসহ অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা রয়েছে। মতিঝিল, শান্তিনগর, পল্টন, সেগুনবাগিচা, মালিবাগ, ইস্কাটন, আরামবাগ, রামপুরা, মগবাজার, বনশ্রী, খিলগাঁও, বাসাবো, মুগদা সায়েদাবাদ যাত্রাবাড়ীসহ উলে¬খযোগ্য এলাকা ওই জোনটি অবস্থিত। ওই জোনে পার্কিং স্পেস রাখার নিয়ম মানছে না ১০১ টি ভবন। মূলত ওই দুটি জোনেই সবচেয়ে বেশি নিয়ম ভঙ্গের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বাকি ৬টি জোনের মধ্যে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, সাভার, উত্তরা ৩য় পর্ব (সম্প্রসারিত প্রকল্প) ও তুরাগ থানা নিয়ে গঠিত ৩ নং জোনে রয়েছে ৪৫টি ভবন। তাছাড়া ধানমন্ডি, লালবাগ, হাজারীবাগ নবাবচর, মোহাম্মদপুর (আংশিক) বছিলা, কেরানীগঞ্জ (আংশিক) এলাকা নিয়ে গঠিত জোন ২৪টি বহুতল ভবন রয়েছে। আর জুরাইন শ্যামপুর গেন্ডারিয়া, কোতোয়াাল, সূত্রাপুর, মীরহাজারীবাগসহ কিছু এলাকা নিয়ে গঠিত জোন ৭ এ রয়েছে ১৮টি বহুতন ভবন। তাছাড়া উত্তরা ১নং থেকে ১৪ নং সংলগ্ন সেক্টর, টঙ্গী ও গাজীপুরের আংশিক এলাকা নিয়ে গঠিত ২ নং জোন রয়েছে ১০টি বহুতল ভবন। যাত্রাবাড়ী, দনিয়া, মাতুয়াইলসহ নারায়ণগঞ্জের একাংশ নিয়ে গঠিত জোন ৮ এ রয়েছে ৯টি ভবন। নিয়ম মেনে ওসব ভবন তৈরির পর বর্তমানে ভবনে পার্কিংয়ের জায়গা অন্য কাজে ব্যবহার করছে। ভবনের পার্কিং জায়গাকে অন্য কাজে ব্যবহার না করতে রাজউকের পক্ষ থেকে ভবন মালিকদের বিভিন্ন সময় নির্দেশনা বা চিঠি প্রদান করা হলেও কেউ তা মানতে আগ্রহী নয়। কারণ ওসব ভবনের বেশিরভাগ মালিকই অত্যন্ত প্রভাবশালী ও সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। তারা আইনের কোন প্রকার তোয়াক্কা করে না। সম্প্রতি রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার পর গণপূর্তমন্ত্রী সকল বহুতল ভবনের নক্সা পরীক্ষা ও সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে জরিপ পরিচালনা করতে বিশেষ নির্দেশনা দেন। তারই অংশ হিসেবে রাজউকের মোট ৮ জোনের ২৪ টিম মাঠে নামে ও জরিপকৃত বহুতল ভবনের রিপোর্টে ৩০৯টি ভবনকে চিহ্নিত করেছে।
সূত্র জানায়, অনেক বহুতল ভবন মালিকই ভবনর পার্কিং স্পেসে দোকান নির্মাণ, গ্যারেজ বন্ধ করে, অস্থায়ীভাবে স্থাপনা নির্মাণ, গোডাউন নির্মাণ করে ভাড়া দেয়া, মালামাল রাখাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ভবনের মালিকই পার্কিং সংশ্লিষ্ট কাজে শুরু থেকেই ব্যবহার করছেন না। যা ইমারত বিধিমালা অনুযায়ী অপরাধ। বিল্ডিং কোড না মেনে ওসব ভবনের নিচতলা বা নক্সা অনুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত পার্কিং স্পেস সঠিক কাজে ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য রাজউকের দায়িত্বরত লোকজন রয়েছে। তবে তারাও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না বা সংশ্লিষ্টরা তাদের নির্দেশ মানছে না অভিযোগ রয়েছে। সমাজের সম্ভ্রান্ত মানুষের আবাসস্থল ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে পরিচিত স্থানেই সবচেয়ে বেশি নিয়ম ভঙ্গের মাধ্যমে পার্কিংয়ের স্পেস অন্য কাজে ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। রাজউকের মোট ৮ জোন রয়েছে। তবে রাজউকের পরিদর্শনের তথ্যানুযায়ী, সাভার, আশুলিয়া টঙ্গী ও গাজীপুরের আংশিক এলাকা নিয়ে গঠিত ১নং জোনের কোন বহুতল ভবনে পার্কিংয়ের স্থানে অন্য কোন কাজে ব্যবহার করছে না বলে জানা যায়।
সূত্র আরো জানায়, নক্সার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ও নিয়ম ভঙ্গ করে বহুতল ভবনের পার্কিং অন্য কাজে ব্যবহার করায় ওসব ভবনে বসবাসকারী ও যাতায়াতকারীদের গাড়ি বাধ্য হয়ে রাস্তার ওপরে বা খোলা মাঠ পার্ককে গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে ওসব ভবনের আশপাশে তৈরি হচ্ছে ভয়াবহ যানজট। রাজউক নিয়মানুযায়ী নক্সা গ্রহণের সময় দেয়া শর্তাবলী ওসব ভবনের মালিকগণ কোনমতেই মানছে না। অনুমোদিত নক্সা অনুযায়ী প্রতিটি ভবনের নিচে গাড়ি রাখার জন্য পার্কিং স্পেস শুধু পার্কিং কাজেই ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক থাকলেও ইমারত বিধিমালার তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছেমতো ওসব বহুতল ভবনগুলোর পার্কিংকে অন্য কাজে ব্যবহার করছে।
এদিকে এ বিষয়ে রাজধানীর ধানমণ্ডি লালবাগ এলাকা জোন-৫ এর পরিচালক মোঃ শাহ আলম জানান, বনানীর এফ আর টাওয়ারের ভয়াবহ আগুন লাগার পর গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশক্রমে রাজউকের ৮টি জোনের ২৪টি টিম নিয়ে সকল বহুতল ভবনের পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনে বহুতল ভবনের পার্কিং স্পেস গোডাউন নির্মাণ করে, মালামাল রেখে বা অস্থায়ীভাবে ব্যবসা পরিচালনা করাসহ অন্য কাজে ব্যবহারের চিত্র বেরিয়ে এসেছে। নির্দিষ্ট কাজে ওসব ভবনের পার্কিং কাজে না লাগানোয় বহুতল ভবন বিশেষ করে বাণিজ্যিক ভবনগুলোর ক্ষেত্রে চলাচলকারীদের মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে যাতায়াতকারীরা তাদের গাড়ি বাইরের রাস্তায় বা ফাঁকা স্থানে রেখে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি করছে। যার ফলে জনদুর্ভোগ বাড়ছে। যা বিল্ডিং কোড ও ইমারত বিধিমালা অনুযায়ী অপরাধ। ওসব বহুতল ভবনের পার্কিং স্পেস নির্দিষ্ট কাজে ব্যবহার করতে ও দখলে থাকা পার্কিং স্পেস অতি দ্রুত খালি করতে রাজউকের পক্ষ থেকে ভবন মালিকদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা খালি করতে চিঠি প্রদান করা হচ্ছে। তারপর কোন ভবন মালিকগণ ওই নির্দেশ না মানলে পার্কিং স্পেস দখলমুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করার পরিকল্পনা রয়েছে। তার পরও কোন অনিয়ম থাকলে ওসব ভবনের মালিকদের বিরুদ্ধে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হবে।