নিজস্ব প্রতিবেদক : নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ’আনসার আল ইসলাম’ এর আধ্যাত্মিক নেতা মাহমুদ হাসান গুনবি ওরফে হাসান ওরফে গুনবি’কে রাজধানী ঢাকার শাহ আলী থানার বেড়িবাধ এলাকা থেকে র্যাব গ্রেপ্তার করেছে । র্যাব জানায়, সে ‘দাওয়াত ইসলাম’ এর ব্যানারে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করে জঙ্গিবাদে অন্তর্ভুক্তির বিশেষ উদ্যেগ গ্রহণ করতো। এ ক্ষেত্রে ‘মনস্তাত্তিক অনুশোচনা’ জাগ্রত করার কৌশল অবলম্বন করে। এছাড়া সে মাহফিলের আড়ালে জঙ্গি সদস্য রিক্রুট করতো।
শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৪টায় কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
এর আগে, র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা এবং র্যাব-৪ এর অভিযানে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় তার কাছ থেকে উগ্রবাদী পুস্তক ও লিফলেট উদ্ধার করা হয়।
মাহমুদ হাসান গুনবির উত্থান
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সে ৫ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। এরপর ২০০৮ সালে জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া, মোহাম্মদপুর থেকে তাইসির দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করে। এরপর সে ঢাকাসহ কুমিল্লা, নোয়াখালী, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও কক্সজারের বিভিন্ন মাদ্রাসায় শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হয়। পাশাপাশি ধর্মীয় মতাদর্শের বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়। সে ২০১০ সাল থেকে ওয়াজ শুরু করে এবং ২০১৪ সাল থেকে ধর্মীয় বক্তব্যে উগ্রবাদীত্ব প্রচারে নিজেকে সম্পৃক্ত করে। এছাড়া সে ধর্মীয় পুস্তকের ব্যবসার সাথে যুক্ত হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, সে প্রথমে হুজি (বি) সাথে যুক্ত ছিল। পরবর্তীতে জসিম উদ্দিন রহমানির সঙ্গে তার পরিচয় সূত্রে ঘনিষ্ঠতা তৈরী হয়। উক্ত ঘনিষ্ঠতার সূত্রে সে আনসার আল বাংলা টিম (আনসার আল ইসলাম) এর সাথে সম্পৃক্ত হয়। জসিম উদ্দিন রাহমানি গ্রেপ্তারের পর সে উগ্রবাদীত্ব প্রচারক হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের এই কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তার গুনবি আনসার আল ইসলামের দাওয়াত ও প্রশিক্ষণে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কয়েকটি মাদ্রাসায় খন্ডকালীন/অতিথি বক্তা বা দীর্ঘ মেয়াদী শিক্ষকতা বা পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। এসব মাদ্রাসায় সম্পৃক্ত হয়ে জঙ্গিবাদের বিস্তৃতি ঘটিয়ে থাকে বলে জানা যায়। এছাড়াও এসব মাদ্রাসায় সে উগ্রবাদী বক্তব্য প্রদান ও একই সঙ্গে উগ্রবাদী বিভিন্ন বই বিস্তারের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের আগ্রহী করে তোলে। পরবর্তীতে সেই উগ্রবাদী বইগুলো সরবরাহ করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষকদের উগ্রবাদী লেকচার প্রদানে উদ্বুদ্ধ ও উগ্রবাদী বই তৈরী, প্রকাশ, প্রণয়নে সহায়তা করে থাকে।
গুনবির জঙ্গি কর্মকাণ্ড
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গুনবি আনসার আল ইসলাম (এবিটি) এর পক্ষে অন্যতম একজন দর্শন পরিবর্তনকারী। দর্শন পরিবর্তনের কৌশল সম্পর্কে গুনবি জানায়, জঙ্গি কার্যক্রমগুলো গোপন আস্থানায় বিশেষ প্রশিক্ষণ মাধ্যমে দেওয়া হয়। যেখানে প্রশিক্ষণার্থীরা আত্মীয়-স্বজন, পরিবার বন্ধু বান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। প্রশিক্ষণার্থীদের বাহিরের জীবন, সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান ইত্যাদি থেকে দূরে রাখা হয়। এরপর তাদের মস্তিকে ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ভয় ভীতি তৈরী ও স্বাভাবিক জীবন সম্পর্কে বিতৃষ্ণা জাগ্রত করা হয়ে থাকে। এর ফলে প্রশিক্ষণার্থীদের ভিতর আবেগ, অনুভূতি, বুদ্ধিমত্তা, পারিবারিক বন্ধন, বিচারিক জ্ঞান ইত্যাদি লোপ পায়। এভাবে কোমলমতিদের নৃশংস জঙ্গি হিসেবে গড়ে তোলা হয়।
এর আগে গত ৫ মে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার হয় জঙ্গি আল সাকিব (২০)। সাকিবের মতাদর্শ পরিবর্তন ও পরবর্তীতে তাকে আত্মঘাতি পন্থায় উদ্বুদ্ধ করণে গ্রেপ্তার মাহমুদ হাসান গুনবির বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বলে জানা যায়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার জঙ্গি মাহমুদ হাসান গুনবি একজন আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা। সে নিজ পেশার আড়ালে জঙ্গিবাদ প্রচার করে থাকে। সে একাধিক ধর্মীয় সংগঠন/প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। সংগঠন/প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিতর তার ঘনিষ্টদের মধ্যে বেশ কয়েকজন জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্টতায় ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে।
এদের মধ্যে সাইফুল ইসলাম, আব্দুল হামিদ, আনিছুর রহমান ও হাসান উল্লেখযোগ্য। সংগঠনের অভ্যন্তরে উগ্রবাদী মতাদর্শদের প্রচারে সে “ছায়া সংগঠন” পরিচালনা করতো। এদেরকে ‘মানহাজী’ সদস্য বলা হয়। এসব সদস্যরা সংগঠনের ভিতরে জঙ্গি সদস্য তৈরি করতো। এছাড়া বিভিন্ন ইস্যুতে উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসবাদকে উস্কে দিত। সে ‘দাওয়াত ইসলাম’ এর ব্যানারে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করে জঙ্গিবাদে অন্তর্ভুক্তির বিশেষ উদ্যেগ গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে তারা বিশেষ করে ‘মনস্তাত্তিক অনুশোচনা’ জাগ্রত করার কৌশল অবলম্বন করে। এছাড়া সে মাহফিলের আড়ালে জঙ্গি সদস্য রিক্রুট করতো।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার মাহমুদ হাসান গুনবি গত মে মাসের প্রথম দিকে গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যায়। সে কুমিল্লা হতে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়িতে অবস্থান নেন এবং দূগর্ম এলাকায় আত্মগোপন করে। এরপর জুন এর শেষের দিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের আশঙ্কায় সে পুনরায় স্থান পরিবর্তন করে বান্দরবানে অবস্থান নেয়। সেখানে ২-৩ দিন অবস্থান করে। পরবর্তীতে সে লক্ষীপুরের চর গজারিয়া ও চর রমিজে বেশ কয়েকবার স্থান পরিবর্তন করে বেশ কয়েকদিন সেখানে সেখানে থাকেন। আবারও সে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বুঝতে পেরে স্থানও ত্যাগ করে। পরে উত্তরবঙ্গে আত্মগোপনের ও প্রয়োজনে দেশ ত্যাগের পরিকল্পনা করে গুনবি।