শিশু ধর্ষণকারীদের অধিকাংশই নিকটাত্মীয়!

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ

বিশেষ প্রতিবেদক : ১৪ বছরের মেয়েটি এসেছে মানসিক চিকিৎসকের কাছে। সঙ্গে বাবা-মা বা পরিবারের কেউ নেই। মেয়েটি চিকিৎসককে জানায়, সাত বছর আগে নিজের খালুর কাছে দিনের পর দিন সে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে বাবাকে জানাতে পারেনি, মাকে জানিয়েছিল। কিন্তু মা সেদিন মেয়েকে বলেছিল এসব নিয়ে বেশি কথা না বলতে। সেই থেকে মেয়েটি কুঁকড়ে গেছে, নিজের ভেতরে ঢুকে গেছে। এরপর সে এসেছে চিকিৎসকের কাছে, সে তার মানসিক ভয়ংকর অবস্থা থেকে মুক্তি চায়।
কেবল ১৪ বছরের এ মেয়েটি নয়, মানসিক চিকিৎসকদের কাছে ধর্ষণের শিকার হয়ে শিশুকিশোরী রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বলছেন চিকিৎসকরা। তবে ছেলে শিশুদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়—বলছেন তারা। প্রচুর রোগী পাচ্ছেন বলছেন চিকিৎসকরা। এসব শিশুদের জীবনে তার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি, এটা সে সারাজীবন বয়ে বেড়ায়, তার বিকাশে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। মানসিক সমস্যা বেশি পান চিকিৎসকরা।
তারা উঁচু গলায় কথা বলতে পারে না, স্কুলে, বন্ধুদের সঙ্গে কোনও দায়িত্ব সে ঠিক মতো পালন করতে পারে না, তার ভেতরে ইনফিউরিটি কমপ্লেক্স ভর করে, মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না। আত্ম বিশ্বাস, আত্মসম্মানবোধ কমে যায়। আর এর ফলে সমাজ একজন ‘প্রোডাকটিভ মানুষ’ হারায়।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, শিশু ধর্ষণের মূল কারণ পিডোফিলিয়া। পিডোফিলিয়া এক ধরণের অস্বাভাবিক যৌন তাড়না যারা শিশুদেরকে ‘টার্গেট’ করে, তাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করে আনন্দ লাভ করে। সাধারণত পুরুষরা পিডোফাইল হলেও নারীরাও পিডোফাইল হয়ে থাকে, যদিও এ সংখ্যা খুবই কম। তবে এসব পিডোফেলিকদের বেশিরভাগই পরিবারের সদস্য বা ‘ক্লোজ রিলেটিভস’। সংখ্যাগতভাবে বলতে গেলে শতকরা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই নিকট আত্মীয়। যারা মাঝে মাঝে বাসায় আসেন, যাদের বাসায় যাওয়া হয় মাঝে মাঝে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সাইক্রিয়াটিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নিয়াজ মোহাম্মদ খান বলেন, পিডোফাইলকে মানসিক অসুস্থতা হিসেবে মনোচিকিৎসকরা নির্ণয় করলেও এর প্রকাশ যেভাবে হয় সেটা অপরাধমূলকভাবেই হয়ে থাকে।
বর্তমানে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, অনেক বাবা-মাই সন্তানকে তার প্রাইভেট পার্ট, সেভ টাচ-আনসেভ টাচ, সেভ পিপল, আনসেভ পিপল নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু এটা আরও গভীরভাবে, বিষদভাবে আলোচনায় আসা উচিত, মেইনস্ট্রিম আলোচনায় আসা উচিত। যেটা এখন হচ্ছে কিছুটা গোপনে গোপনে। কিন্তু এটা বাবা–মায়ের দায়িত্ব সন্তানের সঙ্গে এ ধরণের কিছু হলে তার সঙ্গে কথা বলা।
স্কুলগুলোতে এ ধরনের বেশি শিশু পাওয়া যায় এবং তাদের জন্য ‘গ্রুপ সেক্চুয়াল এডুকেশন’ দিতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, তাদেরকে ‘ভালনারেবল চাইল্ড’ নির্ণয় করে তাদের জন্য কাজ করতে হবে। তবে এজন্য শিক্ষকদের নিয়েও কাজ করতে হবে, তাদেরকে সংবেদনশীল হতে হবে। একইসঙ্গে স্কুল মেন্টাল হেলথ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে শিক্ষকরাই কাজ করবেন। চাইল্ড বিহেভিয়ার চেকলিস্ট ( সিবিসিএল) দিয়ে খুব সহজেই শিশুদের আচরণগত সমস্যা হচ্ছে সেটা নির্ণয় করা যায়।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বলছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুনে মোট ৪৯৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গত বছর প্রথম ছয় মাসে ৩৫১। চলতি বছরের এপ্রিল ও মে মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২১৪ শিশু, যা কিনা মোট ধর্ষণের অর্ধেকেরও বেশি। আর ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫৭১ । গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে শতকরা ৪১ শতাংশ যা অত্যন্ত আশংকাজনক।
এই বছরের প্রথম ৬ মাসে ধর্ষণ হওয়া এই ৪৯৬টি শিশুর মধ্যে ৫৩ জন শিশুকে গণধর্ষণ করা হয়েছে এবং ২৭টি প্রতিবন্ধী শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং ২৩ জন শিশুকে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়াও এই ৬ মাসে ৭৪টি শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।
অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ৮০টির অধিক শিশু ধর্ষিত হয়েছে; যা অতিতের যেকোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। বিএসএএফ বলছে, সব ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় না। তাই এই সংখ্যা আরও বেশি হবে বলেই মনে করে সংস্থাটি।
আবার বেসরকারি সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারাদেশে ৩ শ ৯৯ জন শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ৮ জন ছেলে শিশু। ধর্ষণের পরে একজন ছেলে শিশুসহ মারা গেছে ১৬টি শিশু। অপরদিকে, ২০১৮ সালে ৪৩৩টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয় এবং ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা যায় ২২টি শিশু বলে জানিয়েছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। এছাড়াও, একজন মারা গেছে যৌন নির্যাতনের কারণে। আর ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছিল ৫৩টি শিশুর ওপর।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে,২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হওয়া বেশিরভাগ শিশুর বয়স ৭ থেকে ১২ বছর। ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা বেশি হন যৌন নির্যাতনের শিকার। বিশেষ করে পুরুষ শিক্ষকের হাতে এই ধরনের নির্যাতনের ঘটনা বেশিঘটে। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১২৯ জন। এদের মধ্যে ১৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
একইসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী, বছরের প্রথম ছয় মাসেই সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩১ জন নারী ও শিশু। যাদের মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ২৬ জনকে। মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানাম জানান, গতবছর সারাদেশে নয় শ ৪২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয় ৬৩ জন নারী ও শিশুকে। অর্থাৎ, গতবছর যে পরিমাণ ধর্ষণ হয়েছে তার অর্ধেক সময়ে এবছর ধর্ষণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় দেড়গুণ।
তিনটি সংগঠনের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা যেকোনো সময়ের চেয়ে চলতি বছরে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে পেডোফেলিয়া নিয়ে আলোচনা বা গবেষণা কম থাকায়, অধিকাংশ সময় আমাদেরকে আন্তর্জাতিক গবেষণা ও অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করতে হয়। যদিও আমরা সহজভাবে পেডোফেলিয়া বলতে শিশুদের প্রতি বড়দের যৌন আকর্ষণকে বুঝে থাকি এবং এটিকে বিশ্বব্যাপী একটি মানিসিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এটাও প্রমাণিত যে অনুকুল পরিবেশ ও সুযোগ পেলে পেডোফাইল ব্যক্তিও হয়ে উঠতে পারেন ভয়ংকর অপরাধী ও যৌন নির্যাতনকারী। কাজেই বাংলাদেশের এই বিষয়ে আরো গবেষণা ও আলোচনার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে।
ধারাবাহিকভাবে এসব ঘটনা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন মন্তব্য করে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুছ সহিদ মাহমুদ বলেন, শিশু ধর্ষণের ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণ মূলত, অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া, দুর্বল চার্জশিট, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা এবং সর্বোপরি সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়।
আবদুছ সহিদ মাহমুদ বলেন, শিশু যৌন নির্যাতন বন্ধে দ্রুত বিচারের আওতায় শিশু নির্যাতনের মামলাগুলো নিতে হবে। প্রচলিত আইন সংশোধন করে শিশু ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দিয়ে সেই সাথে রায় দ্রুতগতিতে কার্যকর করতে হবে। বিষয়টি এখন আর কোনোভাবেই উপেক্ষা করার পর্যায়ে নেই এবং শিশু ধর্ষণের অপরাধ জামিন অযোগ্য করা খুবই জরুরি।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বলেন, একটা সময় ছিল যখন আত্মীয়রা আগলে রাখতেন শিশুদের, সেই ধারণা এখনও পরিবারে রয়ে গেছে। কিন্তু এখন দিন পাল্টেছে, আমাদের মূল্যবোধ, শ্রদ্ধা, শিষ্টাচার এসব উঠে যাচ্ছে সমাজ হতে, একইসঙ্গে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে মোবাইলে ইন্টারনেট এসে, এতে করে পর্ণ হাতের কাছে পাচ্ছে।
সেই সাথে বিচারহীনতা, বিচার প্রক্রিয়ার অলি-গলি দিয়ে ক্ষমতাশীলদের বের হয়ে যাওয়া, কিংবা ক্ষমতাশীলদের আশ্রয় প্রশ্রয় ধর্ষককে আরও সাহসী করে তোলে বলেন রাশেদা রওনক খান।
সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড রাইটস গভর্নেন্স অ্যান্ড চাইল্ড প্রটেকশন ডিরেক্টর আবদুল্লা আল মামুন বলেন, সহজভাবে পিডোফিলিয়া বলতে শিশুদের প্রতি বড়দের যৌন আকর্ষণকে বোঝানা হয় এবং একে একটি মানসিক সমস্যা হিসেবেচিহ্নিত করা হয়েছে বিশ্বজুড়েই।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনে পেডোফাইল ব্যক্তি ঝুকিপূর্ণ হলেও, শিশু যৌন নির্যাতনকে মানসিক স্বাস্থ্যের লেন্সের পরিবর্তে অপরাধ লেন্স দিয়ে বিশ্লেষণ করার প্রতি বিশেষজ্ঞদের অভিমত বেশি। কিন্তু এটাও প্রমাণিত যে অনুকুল পরিবেশ ও সুযোগ পেলে পেডোফাইল ব্যক্তিও হয়ে উঠতে পারেন ভয়ংকর অপরাধী ও যৌন নির্যাতনকারী মন্তব্য করে আব্দুল্লা আল মামুন বলেন, কাজেই বাংলাদেশের এই বিষয়ে আরো গবেষণা ও আলোচনার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। একইসঙ্গে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে, স্কুল ও পরিবারে যৌন শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে, যাতে করে যৌনতা, সার্বিক নিরাপত্তা, শিশু নির্যাতন, মানসিক স্বাস্থ্যসহ প্রতিটি বিষয় নিয়ে শিশু সুরক্ষা বিষয়ক নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলো নিতে পারি এবং তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের সহকারী পরিচালক ফেরদৌস আরা রুমী বলেন, বিকৃত যৌন আকাঙ্ক্ষার ব্যক্তিরাই এই অপরাধে বেশি জড়িত। পাশাপাশি প্রতিটি অপরাধের দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার বিকল্প নেই কোন অপরাধ কমাতে। এখন প্রশ্ন থেকেই যায়, রাষ্ট্র আসলে সেই অপরাধ কমাতে চায় কিনা!


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *