প্লাবিত হচ্ছে মধ্যাঞ্চল

অন্যান্য এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন জীবনী সারাদেশ

সব নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে
উত্তরবঙ্গের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ
টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রামে পাহাড় ধস

মহসীন আহমেদ স্বপন : দেশের মধ্যে অতি ভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নামা ঢল অব্যাহত থাকায় দেশের নদ-নদীগুলোর পানি ক্রমেই বেড়ে চলছে। পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। চলতি সপ্তাহ জুড়ে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে, একই সঙ্গে বন্যা মধ্যাঞ্চলেও (ঢাকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল) ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের শনিবারের তথ্য অনুযায়ী, সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, ধলাই, খোয়াই, সোমেশ্বরী, কংস, হালদা, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, ধরলা, তিস্তা, ঘাঘট, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা নদীর পানি ২৩টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
একদিন আগে শুক্রবার সাতটি নদীর পানি ১২টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সাঙ্গু নদীর পানি বান্দরবানে ১২১ সেন্টিমিটার ও দোহাজারীতে বিপৎসীমার ১০৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলেও জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া শনিবার বলেন, আগামী ৩/৪ দিন পানি ভালোই বাড়বে, উত্তরবঙ্গ থেকে বন্যাটা আস্তে আস্তে মধ্যাঞ্চলের দিকে আসবে। বন্যা যমুনা হয়ে পদ্মাতে আসবে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি বাড়তে পারে বলে মনে করছি, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর পানি কোনো কোনো পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতেও পারে।
আগামী বুধ বা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হতে থাকবে জানিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, এরপর থেকে পানি কমতে শুরু করতে পারে। এরপরই বন্যা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে যাবে।
নতুন করে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর অঞ্চলে বন্যা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলেও জানান আরিফুজ্জামান।
দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি সমতলে বৃদ্ধি পাচ্ছে জানিয়ে শনিবার বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর ও ভারত আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং কাছাকাছি ভারতের সিকিম, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল, আসাম ও মেঘালয় প্রদেশের বিস্তৃত এলাকায় আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় মাঝারি হতে ভারী এবং কোথাও কোথাও অতিভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সংলগ্ন ভারতের বিহার এবং নেপালে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
আগামী ৭২ ঘণ্টায় সকল প্রধান নদ-নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে এবং আগামী ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদী সারিয়াকান্দি এবং কাজিপুর পয়েন্ট বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।
উজান থেকে পানির ঢল : ভারত থেকে আসা প্রায় সব নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে উত্তরবঙ্গের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া প্রায় সব নদীতেই উজান থেকে আসা পানির প্রবাহ বাড়ছে। তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি স্লুইস গেটের সব খুলে দিয়ে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতে নদীগুলোর উৎসের কাছে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় নদীর পানিও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধাসহ উত্তরের জেলাগুলোর লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
একটানা ভারী বর্ষণ আর উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শনিবার সকাল ৬টায় ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানির প্রবাহিত হচ্ছিল। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক উপসহকারী প্রকৌশলী আমিনুর রশিদ বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, উজানের ঢল সামাল দিতে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি স্লুইস গেটের (জলকপাট) সবই খুলে রাখা হয়েছে। এছাড়া তিস্তা বিপদসীমার ওপরে চলে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানের বাঁধগুলো হুমকির মুখে পড়েছে।
এদিকে ঢলের পানিতে নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকার প্রায় ১৫টি চর ও চরগ্রাম হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে তলিয়েছে। প্রায় ১৫ হাজার পরিবারের ৭৫ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছেন।
নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার শৌলমারী বানপাড়ায় ডানতীর গ্রাম রক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ওই এলাকার বাসিন্দা আশরাফ আলী জানান, পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব আতঙ্কে আছি। এই বাঁধ ভেঙে শুধু বানপাড়ায় নয়, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের ২০ হাজারেরও বেশি পরিবারের ঘরবাড়ি তিস্তা নদীর পানিতে তলিয়ে যাবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, বানপাড়া বাঁধ ৬০ মিটার পর্যন্ত ভাঙন পাওয়া গেছে। আমরা ১২০ মিটার পর্যন্ত এই ভাঙন রোধের চেষ্টা করছি। তবে এ বাঁধটি প্রকল্পের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে রক্ষার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বর থেকে এর কাজ শুরু করা হবে।
অপরদিকে, ডিমলা উপজেলার চরখড়িবাড়ি এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাঁধটি তিস্তার পানির তোড়ে ভেঙে গিয়ে এলাকার দুই হাজার পরিবার নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে।
লালমনিরহাটে রেড অ্যালার্ট : লালমনিরহাটে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর দুই কূল ছাপিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। গত দুই দিন ধরে তিস্তার পানি অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকায় হাতীবান্ধা উপজেলার গোড্ডিমারী ইউনিয়নে অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজের উত্তর প্রান্তের ফ্লাড বাইপাস সড়কটি যে কোনও মুহূর্তে কেটে দেওয়া হতে পারে বলে জানান কর্মকর্তারা। এ কারণে তিস্তা ব্যারাজের আশপাশে এবং ফ্লাড বাইপাস সড়কটির উজানে ও ভাটিতে বসবাসকারী লোকজনসহ নদী তীরবর্তী লোকজনকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। একইসঙ্গে বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কায় এই এলাকায় রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে।
তিস্তায় পানি পরিমাপের দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী আমিনুর রশীদ বলেন, তিস্তার পানি আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্যা ৪-৫ দিন স্থায়ী হতে পারে। পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজনে ফ্লাড বাইপাসটি কেটে দিতে হতে পারে। এজন্য লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। প্রশাসন সমন্বিতভাবে সবকিছু নিরাপদ করার চেষ্টা করছে।
উজানের ঢলে কুড়িগ্রামের সবকটি নদ-নদীর পানি বাড়ছে। ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে গত ২৪ ঘণ্টায় চর ও দ্বীপ চরসহ নদী তীরবর্তী নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে সাতটি উপজেলার অর্ধ শতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়, শনিবার (১৩ জুলাই) সকাল ৬টা পর্যন্ত ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া তিস্তা নদীর পানি বাড়লেও কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
চিলমারীর প্রবেশ মুখে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে রমনা ইউনিয়নের হরিপুর এলাকার মহির প্রামাণিকের বাড়ির পাশের একটি সাব বাঁধ ভেঙে গিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আজগর আলী সরকার। তিনি জানান, তার ইউনিয়নের বাসন্তিপাড়া, মাঝিপাড়া, রায়পাড়া, টোন গ্রাম, উত্তর রমনা, খেউনিপাড়াসহ অন্তত ১৫টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় এসব গ্রামের বাসিন্দারা ইউনিয়নের ওয়াপদা বেরিবাঁধ, জোরগাছ ২নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং রিয়াজুল জান্নাত মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছেন।
কুড়িগ্রাম সদরের চর যাত্রাপুর, পোড়ারচর, কালির আলগাসহ যাত্রাপুর ইউনিয়নের অন্তত ২০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উমর ফারুখ জানান, ধরলা নদীর পানি বেড়ে তার ইউনিয়নে ধরলার উত্তর তীরবর্তী অংশের গ্রামসহ সারডোব, সাত কালোয়া, খামার হলোখানা এলাকা প্লাবিত হয়ে প্রায় তিন হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. বেলাল হোসেন জানান, তার ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডে পানি প্রবেশ করেছে। এসব এলাকার রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গিয়ে সড়ক যোগাযোগ ভেঙে পড়েছে। চেয়ারম্যান বলেন, ভয়াবহভাবে পানি বাড়ছে। আমার ইউনিয়নের মশালের চর এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। এখন পর্যন্ত ইউনিয়নের প্রায় চার হাজারেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মজিবর রহমান জানান, তার ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে সাতটি ওয়ার্ডের সব গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। তিনি নৌকায় করে তথ্য সংগ্রহ করছেন বলে জানান এই চেয়ারম্যান।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বেড়ে কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের নদীগুলোর উৎসস্থলের ভারতীয় অংশে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় উজানের ঢলে আগামী দুই-তিন দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। এতে করে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।
গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র নদের তিস্তামুখ ঘাটে পানি বেড়ে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটারের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া তিস্তা, যমুনা, করতোয়া, ঘাঘট নদীর পানিও বেড়েছে। তিস্তা ও ঘাঘট নদীর শহর পয়েন্টে পানি বিপদসীমা ছুঁইছুঁই করছে। যেকোনও সময় কয়েকটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে জানিয়েছে গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ড।
বৃষ্টি আর উজানের ঢলে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর তীরবর্তী গাইবান্ধার চরসহ নিম্নাঞ্চলের অন্তত ২০টি গ্রাম ডুবে গেছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ। এসব এলাকার কাঁচা রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। পানিতে ডুবে গেছে ধানের বীজতলা, পাট, মরিচসহ বিভিন্ন ফসলের জমি। পানি বৃদ্ধি আর তীব্র স্রোতের কারণে নদীর তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙনে এরই মধ্যে চার উপজেলার অন্তত পাঁচ শতাধিক বসতভিটা ও আবাদি জমি নদীতে তলিয়ে গেছে।
পানি বেড়ে যাওয়ায় তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীতে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার নদী তীরের অন্তত পাঁচ শতাধিক পরিবারের মানুষ ভিটেমাটি হারিয়েছেন। সবচেয়ে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে সুন্দরগঞ্জের হরিপুর, কাপাসিয়া, বেলকা, সদরের কামারজানি, গোঘাট, ফুলছড়ির ফজলুপুর, এরেন্ডাবাড়ি, উড়িয়া ও গজারিয়াতে। হুমকির মুখে রয়েছে শত শত বসতভিটা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, ফসলি জমিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। অনেকে তাদের সহায়-সম্পদ নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোখলেছুর রহমান জানান, গত কয়েক দিন ধরে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনাসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি অল্প অল্প বাড়লেও বৃহস্পতিবার থেকে পানি বৃদ্ধির হার বেড়ে গেছে। শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া তিস্তা ও ঘাঘটের শহর পয়েন্টে পানি বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। আরও দুই-এক দিন পানি বাড়তে পারে। নদীর তীরবর্তী ও চরাঞ্চলে বসবাসকারীদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদীগুলো দিয়ে পাহাড়ি ঢলের পানি আসছে এবং বৃষ্টির কারণেও পানি বাড়ছে। সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি শনিবার বিপদসীমার ৮৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিক ভুইয়া জানান, শনিবার সকাল পর্যন্ত জেলার ১১টি উপজেলার ১৫ হাজার পরিবারের ৮০ হাজার লোক পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। জেলার বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার, সুনামগঞ্জ সদর, জামালগঞ্জ, ধরমপাশা উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড গত ২৪ ঘণ্টায় ৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে।
সরেজমিন সদর উপজেলার কুতুবপুর গ্রাম পরিদর্শন করে আমাদের প্রতিনিধি জানান, গ্রামের রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় মানুষের চলাচলে খুব অসুবিধা হচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি বাড়িতে পানি ঢোকায় গ্রামবাসী গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি নিয়ে বিপদে আছেন। পানির কারণে তারা রান্না করতে পারছেন না। এ কারণে গ্রামবাসীকে শুকনো খাবার খেতে হচ্ছে।
এদিকে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজারের মনু ও ধলাই নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কমলগঞ্জ উপজেলার পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের রামপাশা এলাকায় ধলাই নদীর একটি স্থানে বাঁধ ভেঙে রামপাশা এলাকা প্লাবিত হয়েছে। শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত মনুর পানি বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ও ধলাইর পানি বিপদসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে পানি কমতে শুরু করেছে।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী শনিবার দুপুরে বলেন, টানা বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে মনু ও ধলাই নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। তবে পানি নামতে শুরু করেছে। বন্যা মোকাবিলায় আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।
অবিরাম বর্ষণে ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানি বেড়ে বান্দরবানের নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়েছে বলে জানান বান্দরবানের মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষণ কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান। সাঙ্গু নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে বলেও জানান তিনি।
আগামী কয়েকদিন অব্যাহত ভারী বর্ষণের আশঙ্কা করছে আবহাওয়া অধিদফতর। এতে দেশে এরই মধ্যে বন্যা কবলিত ১০ জেলায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে আরও নতুন নতুন জেলা। যেকোনও মূল্যে এই বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসনের সবাইকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
প্রধানমন্ত্রীর দফতর, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কোনও অবস্থাতেই যেন বন্যায় কোনও লোক মারা না যান, খাদ্যে কষ্ট না পান বা কোনও দুর্ঘটনা যেন না ঘটে, সে বিষয়ে সার্বক্ষণিক নজর রাখতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে বন্যাকবলিত এলাকায় প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রামে পাহাড় ধস : টানা বৃষ্টির মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ ও কুসুমবাগ এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল শনিবার বেলা ১২টার দিকে নগরীর গরিবুল্লাহ শাহ মাজার সংলগ্ন কুসুমবাগ আবাসিক এলাকায় পাহাড় ধসে এক শিশু আহত হয়। ফায়ার সার্ভিসের আগ্রাবাদ স্টেশনের একটি দল ঘটনাস্থল গেছে। আহত শিশু নুসরাত শারমিনকে উদ্ধারের পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দী বলেন, মাটিচাপা পড়া তিন বছরের একটি শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে। তার হাতে আঘাত পেয়েছে। আমাদের উদ্ধার কাজ চলছে। আর কেউ মাটি চাপা আছে কি না, তা সন্ধান করে দেখা হচ্ছে। পূর্ণচন্দ্র মুৎসুদ্দী বলেন, পাহাড়ের বেশ বড় একটি অংশ ভেঙে পড়েছে। এর নিচে কয়েকটি ঘর আছে। ভেঙে পড়ার আগে ওইসব ঘরে থাকা লোকজন সরে যেতে পেরেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। তার আগে আরেফিন নগরের বিশ্ব কবরস্থান সংলগ্ন মাঝেরঘোনা পাহাড়ে সকাল ৯টার দিকে ভূমিধস ঘটে বলে পুলিশ জানিয়েছে। বায়েজিদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) প্রিটন সরকার বলেন, ভূমি ধসে দুজন মাটিচাপা পড়েন। তাদের উদ্ধার করা হয়েছে। তারা সামান্য আহত হন। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি চলছে চট্টগ্রামে, গতকাল শনিবারও তা অব্যাহত ছিল। বৃষ্টির মধ্যে গত কয়েকদিনে নগরীর বিভিন্ন পাহাড়ে ভূমিধসের ঘটনা ঘটলেও তাতে কারও প্রাণহানি হয়নি। পাহাড় ধসে প্রাণহানি এড়াতে বর্ষার আগে থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো উচ্ছেদে অভিযান চালাচ্ছে জেলা প্রশাসন।
জলমগ্ন নগর: ভারি বর্ষণে ছয় দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফায় ডুবেছে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা। গতকাল শনিবার দুপুর পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও এলাকায় পানি জমে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পাশাপাশি বায়েজিদের আরেফিন নগর এবং কুসুমবাগ আবাসিক এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনাও ঘটেছে। এতে কমপক্ষে তিনজন আহত হয়েছেন। সকাল থেকে নগরীর বহদ্দারহাট, মোহাম্মদপুর, মুরাদপুর, ষোলশহর, বাদুরতলা, কাপাসগোলা, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, জিইসি, ওয়াসা, প্রবর্তক মোড়, হালিশহর আবাসিক এলাকার মূল সড়ক, আই ব্লক, এসি মসজিদ, ওয়াপদা, গাউসিয়া এলাকা, অলংকার মোড়, বিমানবন্দর সড়কের সিমেন্ট ক্রসিং এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। নগরীর এসব এলাকায় যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধ। কোনো কোনো রাস্তায় দুয়েকটি যানবাহন ঝুঁকি নিয়ে চলছে। প্রধান সড়কগুলোতে পথচারীদের মূল ভরসা এখন রিকশা। তিন-চারগুণ ভাড়ায় রিকশা ও ভ্যানে চড়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন যাত্রীরা। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো তলিয়ে যাওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরবাসী। হালিশহরের বাসিন্দা মামুন হোসেন বলেন, আগ্রাবাদ যাওয়ার জন্য সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে দেখি রাস্তায় পানি জমে আছে। এরমধ্যে হেঁটেই পোর্ট কানেকটিং রোডে আসি। আগ্রাবাদ এক্সেস সড়কের বেহাল দশা। ওই রাস্তায় জলাবদ্ধতা না থাকলেও আছে বড় বড় গর্ত। সেসব গর্তে পানি জমে আছে। নগরীর বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা সাইফুল আলম বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এন মোহাম্মদ এলাকায় সড়কের উপর পানি জমেছিল। জঙ্গী শাহ মাজার হয়ে কাপাসগোলা, বাদুরতলা এমনকি কাতালগঞ্জের কয়েকটি সড়কের পানি ছিল। চকবাজার এলাকায় হাঁটু পানি জমে গেছে। এর আগে গত শুক্রবার রাত ৯টা থেকে নগরীতে ভারি বৃষ্টি শুরু হয়। রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে বৃষ্টির বেগ। গতকাল শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত চলে বর্ষণ। এর আগে গত ৮ জুলাই (সোমবার) ভারি বর্ষণে বন্দর নগরীর বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে গিয়েছিল। ৬ জুলাই রাত থেকে চট্টগ্রামে ভারি বৃষ্টি শুরু হয়। এরমধ্যে গত শুক্রবার দিনের বেলায় বৃষ্টি কিছুটা কম ছিল। এদিকে গত সোমবার থেকে জমে থাকা পানি নগরীর কয়েকটি এলাকা থেকে নামেনি। এরকম এলাকাগুলোর মধ্যে আছে চান্দগাঁও পাঠানিয়া গোদা, খড়ম পাড়া, চকবাজার মোহাম্মদ শাহ আলী লেন, হাসমত উল্লাহ মুন্সেফ লেন, বাদুরতলা মাজার গেট সংলগ্ন কয়েকটি গলি। এসব এলাকায় গতকাল শনিবার পানির উচ্চতা আরও বেড়েছে। এতে এখানকার বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসে গতকাল শনিবার বেলা ১২টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ৯৪ দশমিক দুই মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ডের কথা জানিয়েছে। আবহাওয়া অফিসের ডিউটি এসিট্যান্ট প্রদীপ কান্তি রায় বলেন, মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে আরও অন্তত দুই দিন বৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশে মৌসুমী বায়ু সক্রিয় থাকার কারণে গতকাল শনিবার সকাল থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতি ভারি ভর্ষণের সর্তকতা জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। পাশাপাশি ভারী বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রামের বিভাগের কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে বলেও আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্তকবার্তায় জানানো হয়। ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক জসিম উদ্দিন বলেন, আরেফিন নগরে মাঝেরঘোনা এলাকায় পাহাড় ধসে দুইজন মাটির নিচে চাপা পড়েন। তাদের উদ্ধার করা হয়েছে। কুসুমবাগ এলাকায় দুটি পাহাড় ধসে পড়েছে। সেখানে এক শিশুকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। আর কেউ মাটিচাপা অবস্থায় আছে কি না তা সন্ধান করা হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *