*কর্মচারী হাসপাতালে শতাধিক ডেঙ্গু রোগী
*ডেঙ্গু মোকাবিলায় ঢাকা উত্তরে ছুটি বাতিল
মহসীন আহমেদ স্বপন : ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত অভিযান চলবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি বলেছেন, এটি আমাদের কাছে এক প্রকার যুদ্ধ।
একইসঙ্গে এই মশা নিয়ন্ত্রণে নগরবাসীর সচেতনতার ওপরও জোর দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।
তারা বলছেন, এডিস মশা ঘরে স্বচ্ছ পানিতে জন্ম নেয়। এজন্য পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। এডিস মশা নিধন এটা এখন এক প্রকার যুদ্ধ বলা চলে। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে আমাদের যা কিছু করা দরকার তার সব কিছুই করা হচ্ছে। এডিস মশার উৎপত্তিস্থল বন্ধ করতে পারলে এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব।
শুক্রবার রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে আয়োজিত মশক নিধন কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন মন্ত্রী ও মেয়র।
অনুষ্ঠানে মশা নিধন কার্যক্রম তরান্বিত করতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীদের ছুটি বাতিলের ঘোষণাও দেন ঢাকা উত্তরের নগর পিতা।
এক দশক ধরেই বছরের এই সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে। চলতি বছর নতুন ধরনের ডেঙ্গুর কথা জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন মারা গেছেন হাসপাতালে। এই পরিস্থিতিতে মশা নিধনে নগর কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম নিয়েও সমালোচনা তৈরি হয়েছে।
নানা সময় দেখা গেছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের সিংহভাগই উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির। এর কারণ এডিস মশার জীবনাচরণ। নালা, নর্দামায় জন্ম হওয়া কিউলেস মশার তুলনায় এই মশাগুলো অন্য রকম। এডিসের জন্ম পরিস্কার ও স্বচ্ছ পানিতে। তারা খায় ফলের রস জাতীয় খাবার।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বৃষ্টি হলে, কোথাও পানি জমে থাকলে এই মশা সহজে বিস্তার লাভ করে। তাই আমাদের নিজ নিজ আঙিনা পরিষ্কার রাখতে হবে। নিজেদের আগে সচেতন হতে হবে। তাহলেই এই রোগ ও মশা থেকে আমরা মুক্তি পাব।
সরকারও হাত গুটিয়ে বসে নেই জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এডিস মশা নিধনে আমাদের যার যার অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে। ২০০০ সালের প্রথম দিক থেকেই এ রোগের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। গেল বছরের আগ পর্যন্ত এটি নিয়ে আমরা তেমন একটা চিন্তিত ছিলাম না। কিন্তু এবার চিন্তার বিষয় আছে। আর তাই এই এডিস মশা নিধনে সরকারের যে সকল প্রচেষ্টা ছিল। সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
জনসচেতনতায় জোর দিয়ে মেয়র আতিকুল বলেন, বাসায় কোনোভাবেই পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। পরিষ্কার পানিও তিন দিন জমিয়ে রাখলে এডিস মশার জন্ম হয়। জমে থাকা স্বচ্ছ পানি নিজ দায়িত্বে পরিষ্কার করতে হবে। ডেঙ্গু নিধনে এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি জনসচেতনতা সৃষ্টি।
নগর কর্তৃপক্ষ কেবল বাড়ির বাইরের মশা মারতে পারে জানিয়ে আতিকুল বলেন, বাসা-বাড়ির বাইরে মশক নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসির মশক নিধন কর্মী, সুপারভাইজাররা নিয়মিত কাজ করছে। প্রতিটি এলাকার মশক কর্মী, সুপারভাইজার ও মনিটরিং কর্মকর্তার নাম ও মোবাইল নম্বর ডিএনসিসির ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। যে কেউ তাদেরকে ফোন করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারেন।
এডিস মশা নিধন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কার্যক্রম চলবে। এ কাজ যেন নির্বিঘেœ চলে সেই জন্য, ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও মশক নিধন বিভাগের সকল কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। মশা নিধন না হওয়া পর্যন্ত এই আদেশ বহাল থাকবে।
অনুষ্ঠানে ডিএনসিসির বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে এডিস মশা ও ডেঙ্গু জ্বর নিধনে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য শোভাযাত্রায় অংশ নেন সবাই।
কর্মচারী হাসপাতালে শতাধিক ডেঙ্গু রোগী : রাজধানীর ফুলবাড়িয়া সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল থেকে গত কয়েকদিনে চিকিৎসা নিয়েছেন শতাধিক ডেঙ্গু রোগী। কম খরচের আশায় এসব রোগীরা এখানে ভর্তি হলেও অনেকেই কাঙ্খিত সেবা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটিতে ডেঙ্গুসহ যাবতীয় রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার আধুনিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে। তারপরেও এক শ্রেণীর ডাক্তার ও কর্মচারী মিলে রোগীদের পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার অথবা ইবনে সিনা হাসপাতাল থেকে টেস্ট করাতে বাধ্য করছেন।
সূত্র জানায়, সরকারি কর্মচারি হাসপাতালে ডেঙ্গুসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা নিতে এসে অনেকেই মাঝপথে বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে যেতে বাধ্য হয়েছেন। আবার যাদের বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য নেই এমন অনেক রোগী এখানে চিকিৎসা নিলেও তাদেরকে রোগ নির্ণয়ের জন্য যেতে হচ্ছে পপুলার অথবা ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। হাসপাতালের চিকিৎসকরাই বলে দিচ্ছেন ওই দুই জায়গা থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে। শুধু তাই নয় অনেক ক্ষেত্রেই রোগীদের স্যালাইনসহ অধিকাংশ ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হচ্ছে। আবার কখনও কখনও সিট খালি থাকার পরও ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) ড. এবিএম শরীফ উদ্দিন বৃহস্পতিবার তার কার্যালয়ে বলেন, আমাদের হাসপাতালে ডেঙ্গুসহ অধিকাংশ রোগের রোগ নির্ণয়ের আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। ফলে ২/১ একটা ব্যতিক্রম ছাড়া অন্য কোনো হাসপাতালে টেস্ট করার প্রয়োজন হয় না। যদি এই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে আমি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।
তিনি বলেন, বর্তমানে ডেঙ্গু সারাদেশে আলোচিত ইস্যু। আমাদের হাসপাতালে প্রচুর ডেঙ্গু রোগী আসছেন। এদের মধ্যে যারা বেশি সিরিয়াস তাদেরকে আমরা ওয়ার্ড থেকে আইসিইউতে নিয়ে চিকিৎসা দিচ্ছি।
ড. শরীফ উদ্দিন আরও বলেন, বেশির ভাগ ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাচ্ছে। আমরা এইসব রোগীদের প্রতি বিশেষ নজর দিচ্ছি। এছাড়াও দেখা যাচ্ছে পেটে পানি, বুকে পানি, ব্রেইনে পানি, ডায়রিয়া, কলেরা, প্রেশার দ্রুত নেমে যাওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ নিয়ে আসছে। আমরা তাদের দ্রুত চিকিৎসা দিচ্ছি।
অন্যদিকে সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ডেপুটি ডাইরেক্টর (ডিডি) ডা. শাহ আলম বলেন, আমি যতটুকু জানি আমাদের এই হাসপাতালে যে সব পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়, তা অত্যন্ত মানসম্পন্ন। প্রায় সব পরীক্ষা এখানে করার সুযোগ রয়েছে। ফলে বাইরে থেকে খুব একটা টেস্ট করার দরকার পড়ে না। এমনকি চিকিৎসকদেরও নিরুৎসাহিত করা হয় যাতে বাইরে থেকে রোগীকে টেস্ট করাতে না বলে।
সূত্র জানায়, সর্বশেষ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ১৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। এদের মধ্যে জাকিয়া সুলতানা (৭২)ও রীমা (৩০) নামের দুই নারী আইসিইউতে রয়েছেন। বাকি চারজন কেবিনে এবং ১০ জন ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আইসিইউতে থাকা জাকিয়া সুলতানা একই হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. লিয়াকত এর মা বলেও জানা গেছে। অন্যদিকে গত জুন মাস থেকে এখন পর্যন্ত ৮৩ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তাদের মধ্যে ওয়ার্ডে ৪২ জন, কেবিনে ২৭ জন এবং ১৪ জন আইসিইউ থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন।
এদিকে উম্মে কুলসুম নামের এক নারী গত ২৭ জুন সরকারি কর্মচারি হাসপাতালের ৩০২ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডের ৪৬ নম্বর বেডে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হন। সেখানে ৩ জুলাই পর্যন্ত চিকিৎসা নিলেও তার অবস্থার উন্নতি না হয়ে অবনতি হয়। ভর্তির সময় রোগীর প্লাটিলেট ১ লাখ ৯২ হাজার থাকলেও পরে তা কমে ৬৯ হাজারে নেমে আসে। এ অবস্থায় রোগী গত ৩ জুলাই হাসপাতাল পরিবর্তন করে হলি ফ্যামিলিতে ভর্তি হন। সেখানে চারদিন চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন।
এ ব্যাপারে রোগীর স্বামী জুলকার নায়েন বলেন, আমার স্ত্রী গত ২৭ জুন থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা নেন। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় বাধ্য হয়ে হলিফ্যামিলি হাসপাতালে নিতে হয়।
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, কর্মচারী হাসপাতালে সব টেস্ট করার ব্যবস্থা থাকার পরেও ডেঙ্গু সংক্রান্ত কয়েকটি টেস্ট পপুলার অথবা ইবনে সিনা থেকে করতে বলা হয়। কিন্তু রোগীকে পপুলারে নেওয়ার মতো অবস্থা না থাকায় পপুলার থেকে এসে রোগীর ব্লাড নিয়ে যাই। সেজন্য অতিরিক্ত ৩০০ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে।
অন্যদিকে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে কর্মচারী হাসপাতালে মেডিসিন ওয়ার্ডের ৩০২ নম্বর রুমে গত ৮ দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন বিউটি বেগম (৫০)। বৃহস্পতিবার দুপুরে তার স্বামী বিআরটিসিতে কর্মরত মো. মনিরুজ্জামান বলেন, গত আটদিন ধরে এখানে চিকিৎসা নিয়ে আমার স্ত্রী অনেকটা সুস্থ। আশা করছি, আজ/কালকের মধ্যে রিলিজ পাব।
তিনি বলেন, এখানে চিকিৎসা নিলেও ডেঙ্গুর এনএস-ওয়ান টেস্টসহ কয়েকটি টেস্ট আমাকে পপুলার থেকে করে আনতে হয়েছে। শুধু তাই নয় ডায়রিয়ার স্যালাইন এখানে না থাকায় কিছু স্যালাইনসহ বেশির ভাগ ওষুধ আমাকে বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়েছে।
এছাড়াও হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন বেশ কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, টাইফয়েড, ডেঙ্গুসহ বেশির ভাগ টেস্ট পপুলার/ইবনে সিনা থেকে করতে বলা হচ্ছে। এতে করে আমাদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।