বন্যার পানি কমলেও জেগে উঠেছে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা
বিশেষ প্রতিবেদক : গত কয়েকদিন যাবত বৃষ্টি না হওয়ায় নেত্রকোনায় কমতে শুরু করেছে বন্যার পানি। পানি নেমে যাওয়ায় দৃশ্যমান হচ্ছে পানিতে তলিয়ে যাওয়া রাস্তাগুলো। তবে রাস্তাগুলো আর আগের অবস্থায় নেই। যে সব রাস্তার উপর থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে, তাতে ব্যাপক ক্ষতির চিত্র ভেসে উঠেছে। এ অবস্থায় যাতায়াতের ক্ষেত্র এলাকাবাসীর দুর্ভোগ বেড়েছে বহুগুণ। বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত হলেও মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে কয়েক গুন। নেই খাদ্য। নেই বিশুদ্ধ পানি। কারো ঘরে রান্না হলেও নেই তরকারি। ফলে শুকনো ভাত লবণ চটিয়ে খাওয়া ছাড়া কোনও গতি নেই। এ দুর্ভোগ জেলার প্রায় সাড়ে ৮ লাখ বানভাসি মানুষের।
জানা গেছে, ভারতের মেঘালয় থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা ভারী বর্ষণের ফলে বন্যা দেখা দেয়। এতে নেত্রকোনা সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকাসহ জেলার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, বারহাট্টা, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী, মদন ও কেন্দুয়া উপজেলার নিচু এলাকা প্লাবিত হয়। তবে সবচেয়ে বেশি পানিবন্দী হয়ে পড়ে কলমাকান্দা উপজেলার মানুষ। এ উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের প্রায় সবকটি গ্রামই পানিবন্দী হয়ে পড়ে। সম্প্রতি বৃষ্টিপাত না হওয়ায় প্লাবিত এলাকাগুলোর পানি কমতে শুরু করেছে বলে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
এদিকে বন্যার পানি কমে যাওয়ায় তলিয়ে যাওয়া রাস্তাগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে। কিন্তু, বেশির ভাগ রাস্তাই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
জেলার কলমাকান্দা উপজেলার সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ গোলাম মৌলা জানান, কলমাকান্দা-ঠাকুরাকোণা পাকা সড়ক, কলমাকান্দা-বরুয়াকোণা পাকা সড়কসহ এ উপজেলার বিভিন্ন পাকা ও কাচা গ্রামীণ রাস্তা বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। বন্যার পানি কমছে। কিন্তু সড়কগুলো আর আগের মত নেই। ভেঙে ছোট বড় অসংখ্য খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। এতে এলাকার মানুষের চলাচলের ক্ষেত্রে চরম দুর্ভোগ বেড়েছে।
এ বিষয়ে কলমাকান্দা উপজেলা প্রকৌশল (এলজিইডি) অফিসের উপসহকারি প্রকৌশলী মো. ইমরান হোসেন জানান, কলমাকান্দায় ১৩টি গ্রামীণ সড়কের ৩৮ কিলোমিটার রাস্তা বন্যার পানিতে ডুবেছে। এরমধ্যে ৩টি রাস্তা সম্পূর্ণরূপে বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। পানি পুরোপুরি এখনও নামেনি। তাই রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সঠিক পরিসংখ্যান বলা সম্ভব নয়।
রোববার দুপুরে নেত্রকোনা সড়ক ও জনপদ (সওজ) বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী শাকিরুলের ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি বন্যায় রাস্তাঘাটের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমাদের কলমাকান্দা-ঠাকুরাকোণা সড়কটি বন্যায় ভেঙে গিয়ে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। তবে আপাতত ইট-সুড়কি দিয়ে রাস্তা মেরামত করে দেওয়া হচ্ছে।
সাড়ে ৮ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত, খাদ্যের জন্য হাহাকার : কুড়িগ্রাম জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত হলেও মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে কয়েক গুন। নেই খাদ্য। নেই বিশুদ্ধ পানি। কারো ঘরে রান্না হলেও নেই তরকারি। ফলে শুকনো ভাত লবণ চটিয়ে খাওয়া ছাড়া কোনও গতি নেই। এ দুর্ভোগ জেলার প্রায় সাড়ে ৮ লাখ বানভাসি মানুষের।
চিলমারী উপজেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা দাবি স্থানীয়দের। চিলমারী উপজেলা পরিষদের পাঁচবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলী বীরবিক্রম বলেন, ‘তার জানামতে গত ১০০ বছরে এতো পানি চিলমারীর মানুষ দেখে নাই। বিরাজ করছে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি। সর্বত্র পানি আর পানি।
উপজেলার ৩০ হাজারের উপরে পরিবার পুরোপুরি পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পানির তোড়ে অষ্টমীর চর ইউনিয়নের ৭৮টি পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। শনিবার নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে খামার বাঁশপাতারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। রমনা রেল স্টেশনের উত্তরে রেল লাইনের নিচ থেকে ১৫০ মিটার এলাকার মাটি পানির তোড়ে সড়ে যাওয়ায় রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
একইভাবে সকল টিউবওয়েল এখন পানির নিচে। ফলে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সবার ঘরে খাবার নেই। শুকনা খাবারের তীব্র সংকট রয়েছে। এখন পর্যন্ত এ উপজেলায় ১১০ মেট্রিক টন চাল ও ২০০ প্যাকেট শুকনা খাবার সরবরাহ করা হয়েছে।
চিলমারী হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার আব্দুস সালাম জানান, বন্যা স্থায়ী হওয়ায় ইতোমধ্যে পানিবাহিত রোগ-ব্যাধির সংখ্যা বাড়ছে। শনিবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৪ শিশু ও এক বৃদ্ধ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ নিয়ে গত কয়েকদিনে চিলমারী হাসপাতালে চিকিৎসা নেয় ১৩ শিশু, ৭ নারী ও ৭ পুরুষ রোগী। এ সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে তিনি জানান।
চিলমারী উপজেলা সদরের থানাহাট ইউনিয়নের খড়খড়িয়া গ্রামের আবুহার আলী (৫০) বলেন, স্ত্রী ছেলে মেয়েসহ ৬ জনের পরিবার নিয়ে গত ৭ দিন ধরে পানিবন্দি জীবন। এখন পর্যন্ত সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে কোন খাদ্য সহায়তা মেলেনি। ঘরে চালের যা সঞ্চয় ছিল তা দিয়ে অল্প অল্প করে রান্না করলেও ছিল না কোনও তরকারি। বলা চলে শুধু মাত্র লবণ চটকিয়ে কোনও রকম জীবন বাঁচানো মাত্র। সামনের দিনগুলো কিভাবে কাটবে তা নিয়ে চিন্তায় আছি।
ভট্টপাড়ার জাবের হোসেন (৩৫) শ্রমজীবী মানুষ। কাজ নেই ঘরে খাবার নেই। তার উপর সাতদিন ধরে পানিবন্দি জীবন। ৪ জনের সংসার নিয়ে চরম সংকটে পড়েছেন। অর্ধাহারে দিন কাটছে। তার ভাগ্যেও ত্রাণ জোটেনি। একই অবস্থা চিলমারীর অধিকাংশ দুর্গত এলাকায়।
গণকমিটির কেন্দ্রীয় সভাপতি কলামিস্ট নাহিদ নলেজ বন্যার ভয়াবহতা ব্যাখ্যা করে বলেন, এ অঞ্চলের মানুষদের বাঁচাতে হলে সরকারকে এখনই চিলমারী, রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা উচিত। কারণ এ তিনটি উপজেলার ৯৫ ভাগ মানুষ এক সপ্তাহের বেশী সময় ধরে বানের পানিতে ভাসছে। ঘরে ঘরে খাদ্যের জন্য হাহাকার বিরাজ করছে। ঘটছে মানবিক বিপর্যয়। সাধারণ মানুষের একমাত্র সম্বল গবাদিপশুও রক্ষা করতে পারছে না। কারণ গবাদিপশু রাখার জায়গা নেই। নেই গো-খাদ্য।
জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, বন্যার ফলে ৫৭টি ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৮ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পরেছে। ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২০ হাজার হেক্টর। বন্যায় এক হাজার ২৪৫ কিলোমিটার রাস্তা, ৪০ কিলোমিটার বাঁধ ও ৪১টি ব্রিজ/কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নলকূপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯ হাজার ৭৩৪টি। প্রায় ২ লক্ষাধিক গবাদিপশু পানিবন্দি।
শনিবার বিকেল পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৮০ সেন্টিমিটার ও নুনখাওয়া পয়েন্টে ১১ সেন্টিমিটার কমে গিয়ে ৮৩ সেন্টিমিটার এবং ধরলা নদীর পানি ব্রিজ পয়েন্টে ৪৫ সে.মি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বন্যা দুর্গতদের জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে ৮৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। ৫টি ওয়াটার ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়াও পানি বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট ও স্যালাইন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বিতরণ করা হচ্ছে বলে কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. এসএম আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন।
বন্যা দুর্গতদের সহযোগিতায় প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদ সামর্থ্য অনুযায়ী ত্রাণ বিতরণ করছেন।
ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান জানান, সকল বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসন থেকে ৮শ’ মেট্রিক টন জিআর চাল, ১৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৩ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও ঈদুল আজহা উপলক্ষে ৬ হাজার ৪২৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।