রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের ১৪ সদস্য গ্রেফতার
মহসীন আহমেদ স্বপন : বিভিন্ন কিশোর গ্রুপ দিন দিন রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের হাতে একের পর এক হত্যাকান্ডসহ নানা ধরনের নৃশংস অপরাধ ঘটছে। কম বয়স ও অতীত অপরাধের তথ্য না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা নিতে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। বর্তমানে রাজধানী ও আশপাশ এলাকায় কিশোরদের ৫০টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। ওসব গ্রুপের সদস্যরা এলাকার আধিপত্য বিস্তার, স্কুল-কলেজে র্যাগিং, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, ছিনতাই, উচ্চ শব্দ করে মোটরসাইকেল বা গাড়ি চালিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা, অশ্লীল ভিডিও শেয়ার করাসহ এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করা এবং এলাকার নিরীহ ও মেধাবী যুবক-কিশোরদের চাপে রেখে জোরপূর্বক দলে আসতে বাধ্য করছে। এমনকি কোনো কোনো গ্রুপ তাদের নিজস্ব লোগো পর্যন্ত ব্যবহার করে। যা দেয়াল লিখন ও ফেসবুকে ব্যবহার করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
রাজধানীর উত্তরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ‘ফার্স্ট হিটার বস’ (এফএইচবি) নামে একটি কিশোর গ্যাং গ্রুপের ১৪ সদস্যকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ন (র্যাব-১)।
রোববার তাদেরকে আটকের বিষয়টি জানান র্যাব-১ এর স্কোয়াড কমান্ডার (সিপিসি-২) সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) সালাউদ্দিন।
আটকরা হলেন- বিশু চন্দ্র শীল (২০), নাঈম মিয়া (১৮), ইয়াসিন আরাফাত (১৮), আসিফ মাহমুদ (২০), ফরহাদ হোসেন (২১), আল আমিন হোসেন (১৯), বিজয় (১৯), শাওন হোসেন সিফাত (২১), ইমামুল হাসান মুন্না (১৯), তানভীর হাওলাদার (১৮), আকাশ মিয়া (১৮), মেরাজুল ইসলাম জনি (২০), হযরত আলী (১৮) ও রাজিব (১৮)।
এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি এসবিবিএল অস্ত্র ও দুটি ধারালো ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে।
এএসপি সালাউদ্দিন জানান, সম্প্রতি কিশোর গ্যাং গ্রুপের আন্তঃকোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কয়েকটি হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এর ভিত্তিতে গোয়েন্দা নজরদারির ধারবাহিকতায় ১৪ জনকে আটক করা হয়েছে।
আটকদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তিনি জানান, আটক প্রত্যেকে কিশোর গ্যাং গ্রুপ এফএইচবি’র সক্রিয় সদস্য। তারা গ্রুপের সদস্য বাড়ানোর কৌশল হিসেবে একটি ড্যান্স একাডেমি পরিচালনা করে আসছিলো। আদতে উঠতি বয়সের কিশোরদের তাদের গ্যাং গ্রুপে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে এই ড্যান্স ক্লাব পরিচালনা করা হতো।
উত্তরা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকারী এফএইচবি গ্রুপটি দীর্ঘদিন ধরে অধিপত্য বিস্তার করে আসছে। তারা মাদক সেবন, স্কুল-কলেজে বুলিং, র্যাগিং, ইভটিজিং, ছিনতাই, ফেসবুকে অশ্লীল ভিডিও শেয়ারসহ বিভিন্ন অনৈকিত কাজে লিপ্ত ছিল। আটকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান এএসপি সালাউদ্দিন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত বিভিন্ন কিশোর গ্রুপের দখলে দেশীয় অস্ত্র রয়েছে। হাতের নাগালের মধ্যে থাকা ওসব অস্ত্র সস্তা ও বহনেও সুবিধাজনক। যে কারণে আগ্নেয়াস্ত্রের চেয়ে দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে চলেছে। দিন দিন দেশীয় অস্ত্রের ব্যবহার ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। ছুরি, কাঁচি, হাঁসুয়া, চাপাতি, কুড়াল, দা, বঁটি, বল্লম, তীর ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্রের মধ্যে পড়ে। এর বাইরে লাঠি, ঠ্যাঙ্গাও দেশীয় অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়, যদি তা দিয়ে মানুষের জীবননাশের হুমকি থাকে। মূলত কিশোর গ্রুপের কর্মকান্ডের মধ্যে রয়েছে পশ্চিমা চলচ্চিত্র অনুসরণ করে গ্যাং চালানোর কলাকৌশল।
সূত্র জানায়, বর্তমানে রাজধানী এবং এর আশপাশে কিশোর-তরুণদের ৫০টি গ্যাং শনাক্ত করা গেছে। তারা ইভটিজিং, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক সেবন, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে রাজধানীর উত্তরায় ৫টি, উত্তরখানে ৩টি, দক্ষিণখানে ৫টি, আশুলিয়া ও তুরাগ এলাকায় ৫টি, ধানমন্ডিতে ৩টি, পুরান ঢাকার বংশাল-চকবাজার এলাকায় ৫টি, ডেমরা এলাকায় কমপক্ষে ৩টি, তেজগাঁওয়ে দু’টি এবং কাফরুল, মোহাম্মদপুর, নিউ মার্কেট, কাঁঠালবাগান, হাতিরপুল, যাত্রাবাড়ী, কেরানীগঞ্জ, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও এলাকায় একটি করে গ্রুপ সক্রিয় আছে। প্রতিটি গ্রুপে ১০ থেকে ১৫ জন কিশোর অপরাধী রয়েছে। এসব কিশোর অপরাধীর মধ্যে স্কুলছাত্র ও পথশিশুও রয়েছে। তাদের বয়স ১৬ থেকে ২০-এর মধ্যে।
এদিকে অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, শুধু গ্রেফতারসহ আইনি ব্যবস্থা নিয়ে এসব কিশোরকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। সেজন্য মা-বাবাকে সচেতন থাকা জরুরি। পাশাপাশি ওসব কিশোরকে কাউন্সেলিং করাতে হবে। সামাজিকভাবেও এদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন বিট পুলিশিং ও কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা জোরদার করা এবং নিয়মিতভাবে বিভিন্ন মহল্লায় উঠান বৈঠক করা। কোনো কিশোর ছোট অপরাধে জড়িত হওয়ার তথ্য পেলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উচিত তার মা-বাবা ও অভিভাবকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে তাদের বোঝানো। কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে কিশোরদের অপরাধের জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনা।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানান, নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশে কিশোর গ্যাং কালচার তৈরি হতে দেখা গেছে। যাকে আইনের ভাষায় বলা হয় জুভেনাইল সাব-কালচার। অনেক সময় বঞ্চনা থেকে কিশোরদের মধ্যে এমন দল গড়ে ওঠে। আবার কোথাও কোথাও বীরত্ব দেখাতেও ছেলেরা মাস্তানিতে যুক্ত হয়। পাড়ায়-মহল্লায় আগেও এমনটা হতো। এখন সেটার সহিংস রূপ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।