আইনী পদক্ষেপ নিবে হোমিও ও দেশজ চিকিৎসায় সম্পৃক্তরা

আইন ও আদালত

‘ডাক্তার’ পদবী ব্যবহার নিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা


বিজ্ঞাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘ডাক্তার’ পদবী ব্যবহার নিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনায় সক্ষুব্ধ হোমিও ও দেশজ চিকিৎসায় সম্পৃক্তরা। তারা এটিকে বিনা মেঘে বজ্রাঘাত বলে অভিহিত করে বলেছেন, হাইকোর্টের এ রায় একতরফা। তাদের মতে, আদালতে পূর্ণাঙ্গ তথ্য উপস্থাপন না করার কারণেই এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এর ফলে প্রাচীন আমল থেকে চলে আসা চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থায় চিড় ধরার আশঙ্কা রয়েছে। একই সঙ্গে হোমিও ও দেশজ চিকিৎসা সেবায় সম্পৃক্ত লাখ লাখ মানুষ সামাজিক ক্ষেত্রে বিব্রত হওয়া ছাড়াও তাদের ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনী পদক্ষেপ নেয়ার কথাও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, হাইকোর্ট সম্প্রতি এক রায়ে বলেছেন, “আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) নিবন্ধনভুক্ত মেডিকেল বা ডেন্টাল ইনস্টিটিউট কর্তৃক এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রিধারী ছাড়া অন্য কেউ তাদের নামের আগে ডাক্তার পদবী ব্যবহার করতে পারবেন না। তবে হোমিও-ইউনানী-আয়ুর্বেদিকসহ বিকল্পধারার চিকিৎসা (অল্টারনেটিভ মেডিসিন) পদ্ধতির পেশাধারীরা নামের আগে ভিন্ন পদবী ব্যবহার করতে পারবেন।” এক্ষেত্রে আদালত চারটি বিকল্প পদবী উল্লেখ করে ভারতীয় মডেলে (মিনিস্ট্রি অব আয়ুশ গভর্ণমেন্ট অব ইন্ডিয়া) একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করার পরামর্শ দিয়েছেন।
জানা গেছে, ন্যাশনাল মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং ওই সংগঠনের ৯৬ জন সদস্য বিকল্পধারার চিকিৎসা পদ্ধতির পেশাধারীদের নামের আগে ডাক্তার পদবী ব্যবহারের অনুমতি এবং বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য পৃথক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা গঠনের নির্দেশনা চেয়ে ২০১৯ সালে ওই রিট আবেদনটি করেন। আদালত প্রথমে রুল জারি করেন। ওই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গতবছর ১৯ নভেম্বর তা খারিজ করে রায় দেন হাইকোর্ট। গত ১৪ আগস্ট ৭১ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দিয়েছেন।
রায়ে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০ এর ২৯ ধারা অনুযায়ী বিএমডিসি-এর নিবন্ধনভুক্ত মেডিকেল বা ডেন্টাল ইনস্টিটিউট কর্তৃক এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রিধারী ছাড়া অন্য কেউ তাদের নামের আগে ডাক্তার পদবী ব্যবহার করতে পারবেন না। সেখানে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের ২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তারিখের সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে অলটারনেটিভ মেডিসিন কেয়ার শীর্ষক অপারেশনাল প্লানের বিভিন্ন পদে কর্মরত হোমিওপ্যাথি, ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক কর্মকর্তাদের স্ব-স্ব নামের আগে ডাক্তার (ডা.) পদবী সংযোজনের অনুমতি প্রদান করেছে, যা এক কথায় বেআইনি ও দুঃখজনক। এ ছাড়াও বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ড কর্তৃক ২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জারী করা বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন শাখায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকগণকে তাদের নামের আগে পদবী হিসেবে ডাক্তার ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করাও বেআইনি।” রায়ে ‘সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২ মোতাবেক চিকিৎসা পাওয়া প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার’ উল্লেখ করে এ ব্যাপারে বেশ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তবে ‘ডাক্তার’ পদবী ব্যবহার নিয়ে আদালতের নির্দেশনায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন হোমিও ও দেশজ চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, রিটকারীরা অনুমোদন বিহীন প্রতিষ্ঠান থেকে এ্যালোপ্যাথিতে ডিগ্রিপ্রাপ্ত এমবিবিএস (এএম)। অন্যদিকে ‘এএম’ বা অল্টারনেটিভ মেডিসিন নামে কোন ডিগ্রি বা কোর্স বাংলাদেশ এমনকি ভারতেও সরকার স্বীকৃত অনুমোদিত নয়। এখন সেই অনুমোদন বিহীন প্রতিষ্ঠান হতে ডিগ্রিপ্রাপ্তদের সাথে আইনীভাবে স্বীকৃত এবং প্রাচীনতম চিকিৎসায় সম্পৃক্তদের গুলিয়ে ফেলা কতটুকু আইনসম্মত, তা বিবেচনার দাবি রাখে।
সক্ষুব্ধরা বলেন, আদালতের রায়েও বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিকে পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন উল্লেখ করে এর উন্নয়নে যথাযথ এবং সঠিকভাবে পঠন এবং প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তাছাড়া সহজলভ্যতা, স্বল্প খরচ ও প্রচলিত চিকিৎসার তুলনায় পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কম থাকায় বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশেই বিরাট জনগোষ্ঠী বিকল্প ধারার চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। তারা আরো বলেন, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) আইন অনুযায়ী হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি সিস্টেম চলে না। এ জন্য পৃথক আইন রয়েছে। অন্যদিকে হোমিও চিকিৎসা সেবায় সম্পৃক্তরা সরকার কর্তৃক স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত। এক পরিসংখ্যান মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত দুইটি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে প্রায় দেড় লাখ রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালসহ বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতে হোমিও চিকিৎসার অবদান তুলে ধরে সরকারী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সাবেক সহকারী অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম ভূূঁইয়া বলেন, হোমিওপ্যাথি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বীকৃত একটি পদ্ধতি। এ চিকিৎসা বিশ্বের উন্নত এবং উন্নয়ণশীল অন্তত ১১০টি দেশে চালু রয়েছে। আমাদের দেশে হোমিওপ্যাথিতে ডিগ্রিপ্রাপ্তরা বিভিন্ন উপজেলা ও জেলা সদর হাসপাতালে সরকারী চিকিৎসক হিসাবে কর্মরত। এখন আদালতের আদেশে হোমিওপ্যাথদের ‘ডাক্তার’ পদবী ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশে ১৯৬৫ সালের একটি আইন দ্বারাই হোমিও ও দেশজ চিকিৎসা চলে আসছে। পাকিস্তান আমলের সেই আইনে হোমিওপ্যাথদের ‘ডাক্তার’ পদবী ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। পরবর্তীতে ‘বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক প্র্যাকটিশনার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩’ দ্বারা এটি আরো কার্যকর করা হয়েছে। সর্বশেষ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮-এর প্রথম অধ্যায়ে ‘চিকিৎসক’ সংজ্ঞায় অন্যান্যের সাথে ‘হোমিওপ্যাথিক’ উল্লেখ রয়েছে। কাজেই আদালতে পূর্ণাঙ্গ তথ্য উপস্থাপন করা হলে এ বিতর্ক সৃষ্টি হতোনা বলে তিনি মনে করেন।
সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে আলোচনা করে শিগগিরই আইনী পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়ে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি বোর্ডের রেজিস্ট্রার কাম সেক্রেটারি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘দি হোমিওপ্যাথিক প্র্যাকটিশনার্স অর্ডিন্যান্স-১৯৮৩’ এর ৩৩ নং ধারা এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ১৯৯৬ সালের ১ জুন প্রকাশিত নীতিমালা অনুযায়ী নিবন্ধিত ডিএইচএমএস ও বিএইচএমএস সনদপ্রাপ্ত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসগণ তাদের স্ব স্ব নামের পূর্বে ডা. (ডাক্তার) লেখার অধিকার ও প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করার অধিকার সংরক্ষণ করেন। তাছাড়া জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি-২০১১, ঔষধনীতি-২০১৬, জাতীয় মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮সহ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক জারিকৃত বিভিন্ন আদেশ, প্রজ্ঞাপন, নীতিমালায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের নামের পূর্বে ডা. পদবি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার হোমিও চিকিৎসার উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। গত ৩১ মে মন্ত্রিসভায় ‘হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষা আইন-২০২১’ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সরকারের এ মহতী উদ্যোগকে নস্যাত করতেই কারো কারো ইন্ধন থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন।