ক্ষতির মুখে বিআরটিসি!

অর্থনীতি এইমাত্র জাতীয় বানিজ্য সারাদেশ

বিশেষ প্রতিবেদক : সড়কে বিআরটিসির বাসে সিট মেলে না। যাত্রী দাঁড়িয়ে বা ঝুলে যাচ্ছেন এমন চিত্র হরহামেশা দেখা যায়। তারপরও বিআরটিসির শ্রমিকরা মাসের পর মাস বেতনহীন। এমনকি এ বছর ভারত থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩শ নতুন বাস আসার পরও শ্রমিকরা বেতনহীন পড়ে আছেন। ঢাকাসহ দেশের ২০টি ডিপোর শ্রমিকদের বেতন বকেয়া আছে ছয় থেকে প্রায় এক বছর পর্যন্ত। এ পরিস্থিতির মধ্যেই বিআরটিসির চেয়ারম্যানকে বদলি করা হয়েছে। তবে তাকে অফিস ছাড়তে দিচ্ছে না বেতনের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিক-কর্মচারীরা।
জানা গেছে, শুধু জোয়ারসাহারা ডিপোর শ্রমিকরা বেতন পাচ্ছেন না ১১ মাস ধরে। এ বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বেতনের দাবিতে তুমুল আন্দোলন শুরু করে বাস চালক শ্রমিকরা। তখন তাদের ৮ মাসের বেতন বকেয়া ছিল। ডিপো তালা দিয়ে আন্দোলনের এক পর্যায়ে সেখানে আসেন করপোরেশন চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূইয়া। তাকে ‘ভুয়া’ ও ‘দুর্নীতিবাজ’ আখ্যা দিয়ে শ্রমিকরা আন্দোলন অব্যাহত রাখে। এক পর্যায়ে তিনি ঘটনাস্থল ত্যাগ করে চলে যান। শ্রমিকরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এমন অবস্থায় পরে ঘটনাস্থলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান জোনের ডিসি মোস্তাক আহমেদ ও র‌্যাবের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত হন। তারা আন্দোলনরত শ্রমিক কর্মচারী ও ডিপোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে বেতন পরিশোধের আশ্বাস পাওয়ায় শ্রমিকরা আন্দোলন তুলে নেয়।
ওই সময় বিআরটিসি শ্রমিকদের আশ্বাস দেওয়া দেয়, চলতি মাসে এক মাসের বেতন এবং পরের মাস আরেক মাসের বেতন পাবেন তারা। আর ডিপোতে নতুন বাস যুক্ত হওয়া সাপেক্ষে প্রতি মাসে দুই মাসের (এক মাসের বকেয়াসহ) বেতন দেওয়া হবে।
কিন্তু শ্রমিকদের দেওয়া সেই আশ্বাস আর বাস্তবে রুপ দেননি বিআরটিসি চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূইয়া। উল্টো যারা আন্দোলন করেছিলেন তাদের শাস্তি দেওয়া শুরু করেন। ঢাকার বাইরে বদলি করে দেন ৪০ জন চালককে। জোয়ার সাহারা ডিপোর চল্লিশটি বাস ছেড়ে দেন বহিরাগতদের হাতে। এদিকে ভারত থেকে নতুন ৩০ টি বাস বাস ডিপোতে যোগ হলেও বেতন আগের মত বকেয়া পড়তে থাকে। আরও তিন মাসের বকেয়া বেড়ে ১০ মাস বেতনহীন হয়ে পড়ে বিআরটিসির শ্রমিকরা।
বিআরটিসি প্রধান কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জোয়ারসাহার ডিপো ম্যানেজার ছিলেন (বিআরটিসি সচিব) নুর আলম। তার সময়ে মতিঝিল আব্দুল্লাপুর রুটে ১৩ টি এসি বাস চলতো। টঙ্গী মতিঝিল রুটে দ্বিতল বাস চলতো ২০টি। বিশ্বরোড কড়িল রুটে চলতো ৫টি এসি, স্টাফ বাস ২২টি, আর রমিজ উদ্দিন স্কুলের জন্য ৪টি বাস দেওয়া হতো। এই চারটি বাস বাবদ মাসে ৪ লাখ টাকা ভর্তুকি দিত ডিপো। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে জোয়ারসাহার ডিপোতে সচল বাস ছিল ৬৪টি।
এসময় বেতন ভাতাদি পরিশোধ হয় ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। জোয়ারসাহারা ডিপোতে তখন প্রতি মাসে নিয়মিত বেতন ও অন্যান্য ভাতাদি পরিশোধ করা হতো ৪০ লাখের মত। তার সময়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত বকেয়া পড়া বেতন পরিশোধ করা হয়েছে।
কিন্তু এ বছরের মার্চ মাস থেকে এই ডিপোতে ধারাবাহিকভাবে ১০ টি এসি ২০ টি ডাবল ডেকার নতুন বরাদ্দ দেওয়া হয়। শ্রমিকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ি, প্রতি মাসে চলতি মাসের বেতন ও বকেয়া এক মাসের বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হচ্ছিল না। আগের মত একমাস করে বেতন পাচ্ছেন বিআরটিসির শ্রমিকরা।
এছাড়া রমিজ উদ্দিন স্কুলে দেওয়া ৪টি বাস এখন ডিপোতে যুক্ত হয়েছে। স্কুলকে আলাদা করে বিআরটিসি প্রধান কার্যালয় থেকে নতুন ৪টি বাস দেওয়া হয়েছে। এ হিসেবে ডিপোতে বাস সংখ্যা বাড়লেও রাজস্ব বাড়েনি। চালকদের ডিপো থেকে অন্যত্র বদলি করায় বেতন-ভাতাদি কমে আসে প্রায় ২৪ লাখে।
এতে দেখা যায়, আগে যেখানে মাসে চার লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়েও ৬৪ বাসের আয় দিয়ে শ্রমিক কর্মকর্তাদের নিয়মিত ৪০ লাখ টাকা বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হতো। সেখানে এখন প্রায় ১০০ টি বাস দিয়ে ২৪ লাখ টাকা আয় হচ্ছে না। এ প্রশ্নের জবাবে ডিপো ম্যানেজার বলেন, আয় আরো বেশি হচ্ছে। আর চালক বদলির কারণে সব বাস সড়কে চালানো যাচ্ছে না। ডিপোতে চালক সংকট এখন বেশি। বিআরটিসি’র চালক শ্রমিকদের আন্দোলনের পেছনে অন্য কারণ আছে বলে জানান তিনি। চালকদের বদলি এর মধ্যে একটি কারণ। আর অন্য কারণগুলো বলতে চান না তিনি।
আর বিস্তারিত জানতে বিআরটিসি প্রধান কার্যালয়ের ডিজিএম অপারেশন মনিরুজ্জামান বাবুর সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। ডিপোর থেকে বাস চালাতে বহিরাগত লোক নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদেরকে আউটসোর্সিং করতে হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পুরাতন বাসগুলো জোয়ার সাহারা ডিপোতে অলস বসিয়ে রাখা হয়েছে। রাস্তায় চলাচল উপযোগী এসব বাস বসিয়ে রাখায় রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। আর নুতন বাস ডিপোতে এনে বহিরাগতদের হাতে পরিচালনার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যে কারণে লাভ পাচ্ছে না বিআরটিসি। ডিপোর নতুন ভারতীয় ২০ টি ডাবল ডেকার পরিচালনা করছেন হোটেল রিজেন্সির মলিকদের একজন আরিফ মোতাহের। এই একই ব্যক্তি মতিঝিল আব্দুল্লাহপুর রুটের এসি বাস পরিচালনায় রয়েছেন।
বিআরটিসিতে এরকম বাস পরিচালনায় বহিরাগতদের নিয়োগ দেয়ার বিধান নেই। নতুন করে ইজারা না দিতে সেতুমন্ত্রীর কড়া নির্দেশনাও রয়েছে। তারপরও বহিরাগতদের হাতে বাস ছেড়ে দেওয়ার কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খোদ বিআরটিসির প্রধান কার্যালয়ের ডিজিএম অপারেশন মনিরুজামান বাবুর নাম পাওয়া যায়। অভিযোগ আছে বহিরাগতদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বাস দেন তিনি। নতুন ভারতীয় যতগুলো বাস এসেছে সবগুলো বাসই টাকা দিয়ে বহিরাগত লোকদের পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন বাবু। বহিরাগতদেরকে তিনি বুঝিয়েছেন এই টাকা চেয়ারম্যানকে দিতে হয়। বাস পরিচালনার সাথে যুক্ত বিআরটিসি’র বহিরাগত একজন এ তথ্য জানিয়েছেন।
মনিরুজ্জামান বাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগে আরও জানা যায়, বহিরাগত বাস পরিচালক সিন্ডিকেট সদস্যের কাছ থেকে টাকা নিয়েও বাস দেননি। ওই সিন্ডিকেট জানায়, বিআরটিসির নতুন আনা বেশিরভাগ ভারতীয় বাস মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ‘আরিফ মোতাহের ও লিটন’-এই দু’জনের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিআরটিসিরি নিজস্ব লোক থাকতেও অবৈধ টাকা আয়ের জন্য মনিরুজ্জামান বাবু এসব করছেন। অজ্ঞাত কারণে বিআরটিসি চেয়ারম্যান বাবুর কথা অনুযায়ি চলতে গিয়ে মন্ত্রণালয়ের রোষানলে পড়েছেন।
বিআরটিসি ডিজিএম অপারেশন মনিরুজ্জামান বাবু’র মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
মনিরুজ্জামান বাবুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন টাকার বিনিময়ে ভারতীয় বাস বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এটা সত্য নয়। তিনি কোনো ডিপোর ম্যানেজার নন তিনি প্রধান অফিসের কর্মকর্তা। প্রধান অফিসের কর্মকর্তা হয়ে তার দায়িত্ব কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৪টি বাস ডিপো দেখেন তিনি। এই ডিপো গুলোতে ভারতীয় বাস বরাদ্দে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আর কথা বলতে রাজি হননি। এ বিষয়ে সরাসরি কথা বলতে চান।
এছাড়া বিআরটিসি’র বাস বহিরাগতদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার যে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে সেটিও অস্বীকার করেন তিনি। চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিআরটিসি কর্মকর্তা কর্মচারীরা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে একাধিক প্রমাণপত্রসহ লিখিত অভিযোগ দেয়।
আন্দোলন করার কারণে শ্রমিক ঢাকার বাইরে বদলি করে দেওয়ায় এ বাসগুলো চালানোর মত চালক নেই ডিপোতে। বিআরটিসি চেয়ারম্যান কেবল বেতনের দাবিতে আন্দোলনে কারণে ডিপো থেকে ৪০ জনের বেশি চালকে বদলি করেছেন ঢাকার বাইরে।
আন্দোলনের পর ডিপোর বেশ কিছু চালককে বদলির বিষয়টি স্বীকার করেছেন জোয়ার সাহারা ডিপোর বর্তমান ম্যানেজার নাহিদ জামান।
বিআরটিসি সূত্র জানায়, চেয়ারম্যানের এমন সিদ্ধান্তে একদিকে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার অন্যদিকে বকেয়া বেতন পাচ্ছেন না শ্রমিকরা। যে প্রতিশ্রতি দিয়ে আন্দোলন থামানো হয়েছিল তা মানা হয়নি। আবারও ডিপোগুলোতে দেখা দিয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ। এসব পরিস্থিতির মধ্যেই বিআরটিসি চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূইয়া কে বদলি করা হয়েছে। এখন তাকে ভেতরে আটকে বাইরে তালা দিয়ে একদিন বিক্ষোভ করেছেন বিআরটিসি’র চালক শ্রমিকরা। বিষয়টির এখনো সমাধান হয়নি।
বিআরটিসি প্রধান কার্যালয়ের আশেপাশেই চালক শ্রমিকদের অবস্থান নিতে দেখা গেছে। তাদের দাবি বিআরটিসির চেয়ারম্যান বেতন ভাতা না দিয়ে গেলে তাকে বের হতে দেওয়া হবে না।


বিজ্ঞাপন
👁️ 3 News Views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *